সাদা কার্বন (পর্ব-৯) ॥ ইসমত শিল্পী


সাদা কার্বন (পর্ব-৯): যা বলছিলাম, আমার মা রাজেশ্বরী। দৈনন্দিন দুঃখস্রোত বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা নদী। গাঁও গেরামের টুকটুকে ঠোঁট টিয়া। আমার মা আমার কাছে নীল রঙের গল্প। আদর না পাওয়া অনাড়ম্বর মাটির পুতুল।

আমার মা মাত্র সাত বছরে দূর গাঁয়ে বৌ হয়ে আসা অবনত মুখর কিশোরী। সাত চড়ে রা করতো না, খেতো না যখন তখন। ওপার এপার পুকুর সাঁতরে পার হতে পারতো। কিন্তু হুকুম ছিলো না। রান্নাঘর থেকে গোয়াল ঘর। বড়জোর উঠোন পেরিয়ে উত্তরের পুকুর পাড়ে ঝিঁঝির ডাক শুনতে যেতে পারতো, এটুকুই। তাও আবার বাছুর দেখার ভান করে। নানা মশাই তাঁর মেয়েকে বাছুর সমেত গাই গরু উপহার দিয়েছিলেন। মেয়ে তাঁর দুধভাত বড্ড পছন্দ করে। নানা মশাই অনেক বেশি ভালোবাসা দিয়েছিলেন মেয়েকে। সেই সাথে সুখের সংসার সাজাতে অনেক কিছুই।

আসবাবপত্র আর বড় বাড়ি সুখের জন্য সবকিছু নয় এটা কি তিনি জানতেন? শুধুমাত্র শিক্ষিত ও নামকরা পরিবারের মধ্যেই সুখ সীমাবদ্ধ নয় এও বুঝতেন না! ভালোবাসাকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া যেতো না। দেবার মতো হলে হয়তো দিতেন। চল ছিল যা- সবকিছু দিয়েছিলেন। যা তাই চাওয়া যায় না। মা কোনোদিন চায় নি তেমন কিছু। না চাইলে কিছু পাওয়া যায় না। মা ভাবতো তাঁর কপালে যা আছে তাই পাবে। কপাল খুব ভয়ংকর জিনিস।

আমার মা কপালের কাছে সবকিছু সপে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন কাটিয়ে দিলো। এত সাধারণ ভাবে! অসাধারণ একটা হৃদয় নিয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে প্রকৃতির সাথে মিশে গেলো; রাজেশ্বরীর মতো। জানেন তো রাজেশ্বরী সে যে!

আমিও কিংবদন্তী হতে পারতাম। কিংবদন্তী হতে পারতো আমার মা! কী বলেন পিতা ?
আপনি থেমে গেলেন? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। বাবা-মাকে তুমি বলতে পারার তুপ্তি আনন্দ বা স্বাদ কোনও বয়সেয় আমি পাইনি। স্বাদ না পাবার এই অপূর্ণতা অনুভব করলাম যৌবনে। মা’কে যখন ‘তুমি’ করে বলতাম।

হ্যাঁ, এটাও নিজেই নিজেকে শিখিয়েছিলাম। রপ্ত করেছিলাম নিজেই। রপ্ত হয়েছিলো দিনে দিনে। আপনি জানতেন না, বোঝেননি। মাও বোঝেনি; সরলতার দিনপঞ্জি বুকে নিয়ে জন্মেছিলো আমার মা। সরল সহজ মানুষ সংসারে মূল্য পায় কম। মা’ও তেমনি। কী অভাবী গোছের গোছালো একটা জীবন কাটিয়ে দিলো! কোন চাওয়া নেই, পাওয়া নেই।

অভিযোগ নেই। নেই উদ্দীপনা। আফসোস ছিলো না কোনো কিছুর অথচ পাবার আঁকূতি ছিলো ঢের। নিরেট ভালো মানুষ ছিলো মা। একটা আস্ত জীবন, বিরাট না পাওয়া নিয়ে নিরবে চলে যায় কীভাবে মানুষ! ইস্, অথচ কতকিছু পেতে পারতো সে! সেই সামর্থ্য তো আপনার ছিলো! ছিলো না ? জানি, ছিলো। সামর্থ্য তো অর্থ দিয়ে বিচার হয় না। অর্থ মানুষকে ধনী বানায়, সামর্থ্য মানুষের অর্জিত সম্পদ। তা শুধু অর্থে বা টাকা-পয়সায় সীমাবদ্ধ না। শিক্ষায় প্রতিপত্তিতে ঐতিহ্যে আপনার যশ সুনাম মর্যাদা কতকিছু ছিলো! মায়ের ছিলো না প্রাপ্য; শুধু দিয়েই গেলো সেই মানুষ। নিলো না কিচ্ছু।

অবিশ্রান্ত মমতার ভিটেভরা ফুল ছিলো আমার মা। তাঁকেও আম্মা বলতে শিখেছিলাম। শৈশব হতেই বুঝেছি, পারিবারিক শিক্ষার আবহে সহজাত কিছু শব্দ মানুষ শিখে নেয়। ইচ্ছের বাইরেও মানুষ কতকিছু শেখে! সেগুলো সহজাত শিক্ষা। বড়বেলা সেগুলোকে এড়াতে পারেনা। অপছন্দ হলেও পারে না। আমি এডিয়েছিলাম। মাকে আপনি থেকে তুমি করে ফেলেছিলাম।

আপনার দুটো সন্তানের আরেকজন আমার ভাই। আপনার পুত্র। মা-বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান। আমার ৮বছর পরে জন্ম। ওই পরিবারে কন্যা সন্তান হিসেবে আপনি বরং কিছুটা অবহেলা করতেন আমায়। আর কেউই করেনি কখনও। মা আমায় ভালোবাসতো, আমিও মাকে। এ নিয়ে আপনার পুত্র সন্তানের ক্ষোভ ছিল খুব, পুত্র বধূরও। কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। তা তো আপনার অজানা নয়! কিন্তু উপেক্ষিত। ঠিক আমি যেমন। যেমন আমার মা।

আমি আর আমার মা পরবর্তীতে একটা অনুভবে মিশে গেলাম। আপনার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মায়া মমতা মেনে চলাতে আমার কমতি ছিলো না। বরং বেশিই ছিলো। ঠিক মায়ের মতোই। কষ্টগুলোও একইরকম। সময় সবথেকে বড় বন্ধু আবার বড় শত্রু। কিন্তু আমাদের বেলায় বন্ধু হলো সময়। আর চিন্তা ও অনুভব। আমাদের ভাবনা চিন্তা আমাদেরকে মিলিয়ে দিয়েছিলো একসাথে। অনুভব বয়স মানে না। অনুধাবন শক্তি হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা শূন্যতা। বস্তুতে বস্তু না মিললেও শূন্যতা একে অপরের সাথে মিলে মিশে যায়। জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকে। আমরাও তাই। মা চলে যাওয়ার পর থেকে আরও বেশি।

মা চলে যাবার সময় হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে শুয়ে ছিলাম আমি। আমার বাম হাতের তালু স্পর্শ করেছিলো মায়ের হুদয়। কী বিশাল হৃদয়! কী বৃহৎ জলাশয়! কী মহান মানবী আমার মা! সেই শুষ্ক কণ্ঠ, শীর্ণ হাত, সেই মাংসহীন শরীর, রানীর মতন মন- আমার রাজেস্বরী-মা!

আপনার কাছে সামান্য স্ত্রীর ভূমিকায় জীবন কাটিয়ে দেওয়া একটা মানুষ। এত বিশাল পৃথিবী বুকে পুষেছিলো কীভাবে ? প্রশ্ন হয়.. কতকিছু জেগে ওঠে, মরে যায়। আবার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
সে কী রাজেশ্বরী বলেই..?
উত্তর দেবেন।