আজ অনেকদিন পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তাপমাত্রা দেখাচ্ছিল ০’সে। অনুভব করছিলাম -৪/-৫’ সে।গুড়ি গুঁড়ি স্নোবৃস্টি হচ্ছিল। দরজা থেকে যেই বাহিরে পা রেখেছি, একটা শীতল হাওয়া যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে গেল।যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।তারপর বাতাসের উল্টোদিকে জোরে জোরে হাঁটা শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরই ঠান্ডা ভাবটা কিছুটা কম অনুভব করতে লাগলাম । ডেরিআহী রেলস্টেশনের দিকে যাবার জন্য আমার বাসার পাশে একটি শর্টকাট হাঁটার রাস্তা রয়েছে। গল্ফ ক্লাবের পাশ দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা বেশ নিরিবিলি একটি পথ।এই রাস্তাটি দিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম।গাছগাছালিতে ভরা ছিমছাম নিরবতা।কয়েকটি কাঁঠবিড়ালিকে ছুটে যেতে দেখলাম পাশ দিয়ে।
আনমনে হাঁটছিলাম কিছু একটা ভাবতে ভাবতে।হঠাৎ আমাকে মুগ্ধ করে থামিয়ে দিল পাখির কিঁচির মিচির আর মিষ্টিসুর।আমি যেন কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম মনকে রাঙানো সেই সময়টায়, যখন বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে কোকিল ডাকত গাছের ডালে ডালে।
শিমুল ফুটতো রাঙা হয়ে।প্রকৃতি সেজে উঠত আবীর রঙে।তখন বাতাসে বসন্তের সুর বাজতো ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই। সেই সময় আমাদের পৃথিবীটা একটু বেশিই রঙিন ছিল।আমরা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করতাম কি শাড়ি পরব।চুলে কি খোঁপাকরে ফুল লাগাব? নাকি চুল ছেড়ে রাখব? কাঁচের চুড়ি পরব? না গাউসিয়ার রিনিঝিনি থেকে নতুন জিজাইনের ফ্যাশন চুড়ি কিনব?
ফাল্গুনের প্রথমদিনে হলুদ আর বাসন্তি রঙে সেজে উঠত প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণ।শহীদ মিনার, বকুল তলা, ক্যান্টিন, গাছের ছায়াতল কিংবা সবুজ মাঠ, সুন্দরীদের উচ্ছাস ও চুড়ির মায়াবী শব্দ রিনিঝিনি করে বেঁজে উঠত।
প্রিয় বন্ধুদের সাথে কাটানো শেষ বসন্ত ছিল ২০০৮-এ। এরপর তেরটি বছর চলে গেছে….বসন্ত এসেছে বসন্তের নিয়মে। আমরাও সেঁজেছি নতুন দেশে নতুন বন্ধুদের সাথে কোন কোন বসন্তে।আবার কোন বসন্ত জীবনের ব্যস্ততায় টেরই পাইনি।
খুব জানতে ইচ্ছে করছে তোদের বসন্তগুলো কেমন করে কাটে এখন? বাচ্চা সংসার সামলিয়ে শাড়ি পরার সুযোগ হয় কি? এখনো কি খোঁপায় গুঁজে দিস্ পছন্দের কোন ফুল? তাড়াহুড়ো করে প্রিয় কাঁচের চুড়ি পরতে গিয়ে কোনটা ভেঙে গেলে, এখনোকি মন খারাপ হয়? রিকশায় উঠে শাড়ির আঁচল সামলাতে এখনও আগের মতন ব্যস্ত হোস? নাকি ড্রাইভিং-এ কমফোর্ট খুঁজতে শাড়ি পরাই বাদ দিয়ে দিস?
আমার আরো অনেক, অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করেরে। খুব জানতে ইচ্ছে করে রুপার কথা।ও এখন কোথায় আছে? কেমন আছে?
নীলফামারীর মেয়ে রুপা, সে ছিল রুপের রাজকণ্যা।
এককথায় অপরুপা।ঢাকায় পড়তে এসেছিল।ভার্সিটির হোস্টেলে থেকেই পড়ত ।বাবা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।খুব আদর্শ আর পরিপাটির ছোঁয়া ছিল রুপার চলাফেরায়, কথায়, পোশাকে।অনার্স ২য় বর্ষে হুট করেই প্রেমে পরে যায় হিমু নামের এক ছেলের। না, না, এ হুমায়ুন আহমেদের হিমু নয়, এ ছিল আমাদের রুপার হিমু।তবে ছেলেটির অনেক কিছুতে হিমুর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যেতো।তারও ছিল উসকো-খুসকো চুল, চেহারাও ছিল উদ্ভান্তের মতন, সময় জ্ঞান বলে কিছু ছিল না, কোন কিছুতেই সিরিয়াস ছিল না ছেলেটি।তবে প্রতিদিন বিকাল বেলা পানজাবি পরে এসে দাঁড়িয়ে থাকত রুপার হলের গেটে।
রুপার হাত ধরে একঘণ্টা বসে থাকত রাস্তার পাশে।তা না হলে নাকি হিমু সাহেব ঘুমাতে পারেন না।প্রচণ্ড হুমায়ূন ভক্ত রুপা হিমুর এই খেলায়িপনাকে ভালোবাসতো, তার পাগলামিগুলোকে ভালোবাসতো পাগলের মতন।
সেই দিনটি ছিল ভার্সিটি জীবনের শেষ বসন্তের।আমরা সবাই হলুদ-কমলা শাড়ি, চুড়িতে সেজেছিলাম।একমাত্র রুপা এসেছিল টুকটুকে লাল রঙের শাড়ি পরে, হাত ভর্তি করে লাগিয়েছিল মেহেদী।খোঁপায় ছিল দোলনচাঁপা। ঘ্রাণে মৌ মৌ করছিল।
আমরা সবাই খুব হাসাহাসি করছিলাম ওকে নিয়ে।দুস্টুমি করে বলছিলাম আমরা সবাই আজ হলুদের কন্যা আর রুপা হলো বিয়ের কন্যা।শিউলি বলছিল আরে না ও হলো ‘বসন্তের রাঙা শিমুল’।
আমরা সবাই খুব মজা করছিলাম। হাসাহাসি করছিলাম। শুধু রুপাটা একটু অন্যমনস্ক ছিল। কি নিয়ে যেন খুব ভাবছে, অস্থির হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে, গেটের দিকে তাকাচ্ছে।
দিন গড়িয়ে বিকাল হতেই সবাই একে একে বাসা ও হলে ফিরে যেতে লাগল। আমিও বাসায় ফেরার জন্য উঁঠে পরতেই রুপা আমার হাতটি ধরে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল তুইকি আমার সাথে আর কিছুক্ষণ থাকতে পারবি? আমি তখন সিরিয়াসলি ওর কাহিনি কি জানতে চাইলাম।আমাকে অবাক করে বলল আজ ওরা বিয়ে করবে। হিমুর বিকাল চারটায় তার দুই বন্ধুসহ হলের গেটে থাকার কথা। এখন বাজে পাঁচটা, হয়ত আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। আমি যদি ওরা আসা পর্যন্ত থাকি তাহলে খুব ভালো হয়।ওর নাকি কেমন ভয় লাগছে।রুপার বাবা রুপার বিয়ে ঠিক করেছেন ওদের পাশের গ্রামের অত্যন্ত মেধাবী এক ছেলের সঙ্গে। ছেলে কানাডায় পিএইচডি করছেন। ছুটিতে বাড়ি এসেছেন, একুশের ফেব্রুয়ারির দিন বিয়ে। তাই হিমুকে এখন বিয়ে করা ছাড়া ওর হাতে অন্য কোন উপায় নেই। আমি বসে রইলাম রুপার সাথে। ও বার বার ঘড়ি দেখছে, অস্থির হয়ে ফোন করছে, হিমু ফোনটা কেটে দিচ্ছে।
আটটার সময় হলের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়।তাই আমরা বাইরে রাস্তায় বসে আছি। তখনও বসন্তের আমেজ চারিদিকে। কেউ কেউ কান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে, সারাদিনের আনন্দ শেষে, প্রেমিক যুগল হাত ধরে বসে আছে রিকশায়, ফুল বিক্রি করে যে মেয়েটি সেও সব ফুল বিক্রি করার খুশিতে হাসতে হাসতে বাড়ি যাচ্ছে। কেবল হিমুর কোন খবর নাই, হিমু আসেনি, ছয়টার পর থেকে তার মোবাইলটিও বন্ধ।যে বন্ধুকে নিয়ে আসার কথা তাদের ফোন করে জানা গেল হিমু তাদের কিছুই বলেনি। রুপা প্রচণ্ড শক্ত হয়ে বসেছিল।
রাত নয়টা বেজে গেছে। আমি রুপার হাতটা শক্ত করে ধরে সিএনজি করে বাসায় নিয়ে এলাম। সারারাত ও বারান্দায় বসে দুনয়ন বাসিয়ে কাঁদল। বাবার সাথে খারাপ আচরণ ও রাগারাগি করেছে বলে প্রচণ্ড অনুতপ্ত হলো।তারপর সকালের বাসে করে ও নীলফামারী চলে গেল। ফোন করলেই হিমুর কথা বলে অনেক কান্না করত। হিমুর ফোন তখনও বন্ধ ছিল।বন্ধুরাও কেউ ওর খবর দিতে পারেনি।
বাইশে ফেব্রুয়ারি আমাকে বিয়ের ছবি মেসেজে পাঠালো।বিয়ের সাজে রুপাকে অপরুপা সুন্দরী লাগছিল। বরটিও মাশাল্লাহ খুব হ্যান্ডসাম। ক্যামেরার শত বাল্বের আলোর ঝলকানিতেও কেবল রুপার মুখে ছিল অন্ধ বিষাদের ছায়া। তার মাস খানেক পরে ফেসবুকে বিমানবন্দরে বিদায়ের ছবি দিয়ে লিখেছিল
‘এই পৃথিবীর নিয়ম বড় অদ্ভুদ, মানুষরা সেই নিয়মের গুটিমাত্র’।
তারপর রুপা আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল, ফেসবুকের আইডিটি ডিএকটিভ করে দিয়েছিল।হয়ত নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছে। চেয়েছে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনের গোপন কোঠরিতে বন্দি করে প্রকৃতির নিয়মের সাথে তাল মিলাতে। আমি এখনো মাঝে মাঝে রুপার ফেইসবুকের আইডিটি খুঁজে বেড়াই ।খুঁজে বেড়াই ‘বসন্তের রাঙা শিমুল’-কে।