গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে আকলিমা খানম বুবলিকে বললেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?
: জানি না তো? কোথায় যেতে চান?
: আজ কি আমার যেতে চাওয়ার দিন? আমার বড় ছেলে তার বউ-বাচ্চা দুটো নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে…।
: সেই জন্যই তো আপনাকে তুলে নিয়ে এলাম, তারা দেখুক, আপনি তাদের যাওয়াকে থোড়াই কেয়ার করেন!
: মাকে যে সবই কেয়ার করতেই হয়!এই যে বউয়েরা ফুসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের, যা বেতন পায়, তার থেকে বাসা ভাড়া দিয়ে, কাজের মানুষ রেখে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করবে, তার খরচ। আমি আসলে সেসব ভেবেও কষ্ট পাচ্ছি।কেউ তো অত বড় চাকরি করে না!তারপর বউয়েরাও কিছু করে না। অথচ আমার স্বপ্ন ছিলো, আমার বউমারা সবাই চাকরি করবে, আর আমি মা দুর্গার মতো তাদের সব সামলাবো!
: তারা আপনার উদারতার জন্য আপনাকে একটা অসহায় মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবে না। মনে করে আপনি তাদের দাসীবৃত্তি করে খেতে চান। আপনি নিজের জন্য যদি নগদ কিছু রাখতেন, তাদের বাজার করা খাবারের ওপর আপনাকে নির্ভর করতে না হতো, দেখতেন, আপনার কপালের ঘাম, চোখের জল সবই তারা নিজের হাতে মুছে দিতো!
:বাড়িটা তো আমার নামে?
:সেটা আগেও বলেছেন।কিন্তু তারা জানে বাড়ি বিক্রি করে আপনি খুচরো খরচ করবেন না।ওটা করা যায় না।যতদিন আপনি বাঁচেন,বসবাস করবেন। কিন্তু মরে গেলে সবই তাদের।মেয়ে-মানুষ কোনোকালে তাদের সম্পত্তি দরাজ কলিজা নিয়ে নিজের জন্য খরচ করতে পারে না! আঙ্কেল না মরে আপনি মরতেন, দেখতেন আরেকটা বিয়ে করে নতুন করে নিতো, আর জোয়ান বউয়ের প্ররোচণায় তিনটের একসাথে বাড়ি ছাড়া হতে হতো। আর তখনি হতো মায়ের কদর। সরি আন্টি।কথাগুলো আমার নয়, মানুষে বলে তাই শোনা কথা! কিন্তু এখন আমি না বলে পারলাম না।কারণ একটা বয়স পেরিয়ে গেলে কেউ আর ছোট থাকে না!
এলোমেলো কোথাও ঘুরতে ইচ্ছে করছে না। আকলিমা খানমের অনুমতি না নিয়েই ড্রাইভারকে বললো, বাসায় চলো।
আকলিমা খানম বললেন, তোমাদের বাসায় যেতে হবে? আমার ফিরতে দেরি হবে না?
: দেরি করতেই তো বাসা থেকে বের করে নিয়ে এলাম! আপনার বড় ছেলে তার পরিবার নিয়ে বেরিয়ে গেলে তন্ময় নিশ্চয় ফোন করবে আপনাকে!
: তন্ময়ের তো ফোন নেই। আর কারো ফোন থেকে ফোন করবেও না!
: তন্ময়ের ফোন আগে ছিলো না।কিন্তু এখন আছে!
ফোনের বিষয়টি আকলিমা খানম অনুমানে বুঝে নিলেন।এর ভেতর বাসায় ঢোকার আগে বিউটি পার্লারের দিকে নজর পড়ে বুবলি ড্রাইভারকে বললো, পার্লারে গাড়ি ঢোকাও। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যাই!
আকলিমা খানম বিউটি পার্লার নামটাই শুনেছেন। কিন্তু কখনো ভেতরে ঢোকেননি। আজ বুবলি তাকে নিয়ে তার জোর আপত্তি সত্ত্বেও ফেসিয়াল করা থেকে মাথার চুলগুলো পর্যন্ত কেটে বিন্যন্ত করে দিতে বললো। আকলিমা খানম প্রথমে না না করলেও পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। বিউটিশিয়ানদের কাজ শেষ হলে বুবলি আকলিমা খানমের চোখেমুখে বহুদিনের জমানো ক্লান্তির ক্ষয় দেখতে পায়।সে আকলিমা খানমকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে বললো, দেখেন কেমন লাগছে?
আকলিমা খানম তার প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে বললেন,ওটা আমি?
বুবলি বললো, না, আমি!’ বলে দুজন সমবয়সী মানুষের মতো জড়িয়ে ধরে কয়েকটা পাক খেলো।
আকলিমা খানম বুবলিদের বাড়িতে ঢুকে দেখলেন, বিশাল ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। মানুষের অভাবে ফ্ল্যাটের ভেতরজুড়ে খা খা করছে। তবে সবার ছবির সমারোহ ফ্ল্যাটের প্রতি কোনা জীবন্ত করে রেখেছে। কাজের মানুষদের জন্য থাকার আলাদা জায়গা।তাই না ডাকলে তারা সামনে আসে না। বুবলি যখন বাড়িতে ঢোকে বেলা তিনটা পেরিয়ে গেছে। কাজের মানুষের কাছে খাবার চাইলো এবং তাদের কাছে জানতে পারলো তার বাবা খেয়ে বিশ্রাম করছেন। আজ ছুটির দিন বলে তিনি বাড়িতে। নাহলে সপ্তাহের অন্যান্য দিনের এসময়ে তিনি অফিসে থাকেন!
বুবলি আকলিমা খানমের পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে বলতে লাগলো, খেয়ে দেখেন, এগুলো যতোই দামি হোক, আপনার ডিম ভাজি আর ডাল চচ্চড়ির মতো হয়নি!
: আসলে এখন কিছুই ভালো লাগবে না। এখন না খেতে পারলে ভালো হতো!
: লিমা আন্টি, এরকম উসখুস করলে কিন্তু আমি আর আপনার বাসায় যাবো না। আর এখন তাহলে ড্রাইভার আপনাকে পাঠিয়ে দেবো। সম্পর্কটা আজই শেষ হয়ে যাবে। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, যে বেদনা লাঘব করা যায়, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি সেখানে কোনো ভূমিকা না রাখতে পারি, তাহলে কেন সেখানে গিয়ে নিজেকে ভারাক্রান্ত করা!
:তুমি যে কোনোদিন আমার জীবনে ছিলে না, এটা আমি ভাবতে চাই না! একটা মেয়ে, যে এখনো পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠেনি, সে আমার এতটা শক্তি হয়ে কাছে আসবে, এ আমার কত জনমের পূণ্যের ফল!
: আমি যেটুকু করলাম, এটুকুর জন্য বয়স লাগে না। লাগে সাহস। আর সব সাহসী পদক্ষেপই যে সুফল দেয়, তা কিন্তু নয়।
তাই সাহস দিয়ে কেনা দুর্গতিতেও কখনো কখনো ধূপধুনো ছোঁয়াতে হয়!
: জানো, ছাত্রী খারাপ ছিলাম না। বিএ পাস করেছিলাম। রেজাল্টও ভালো ছিলো।
: তো বোঝেন এবার? ছুরি-কাঁচিও ব্যবহারের ভেতর না থাকলে তার ধার থাকে না। আর অব্যবহারে বিদ্যার তো থাকেই না!
: ছেলেদের মনোযোগ দিয়ে মানুষ করবো বলে নিজে চাকরি-বাকরি করার কথা ভাবিনি। তন্ময়ের বাবাও চাইতেন, সংসারে টানাপোড়েন নিয়ে হলেও সন্তানদের যত্নে মানুষ করি!
: আমার মাও বলতেন, একটা বাচ্চা মানুষ করতে একজন মায়ের পরিপূর্ণ মনোযোগ লাগে!
:সত্যিই তাই!
:চা খাবেন? দিতে বলবো?
:চা আমি খুব একটা খাই না।তবে বানাতে ভালোলাগে! তন্ময় তো আমাকে কল করলো না?
: হয়তো সিম কেনেনি এখনো! আমি তো ফোন কিনে দিয়েছি, সিম তাকেই কিনতে হবে! বাবা উঠলেন কি না দেখে আসি!
আকলিমা খানমের বড় অস্থির লাগছে। যদিও ভয়ে তা বুবলির সামনে প্রকাশ করছেন না। তার বড় সন্তান তার আশীর্বাদ ছাড়া পরিবার নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, এটা তিনি কখনো ভাবেননি! আর সন্তান, যে একবার বাড়ি থেকে বের হয়, সে আর ফেরার গন্য বেরোয় না, এটাও তিনি ভালো জানেন। এখনো তিনি যা ভাবেন, সবার জন্য ভাবেন। ছেলেদের শৈশবের স্মৃতিগুলো সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকে। তিনি হয়তো সেসব দিনের কথা আপতত মনে করে বিভোর হয়ে ভাবছেন, এরই ভেতর ছেলেরা বাড়ি ঢুতে যার যার রুমে ঢুকে যায়। যেতে যেতে ফিরেও দেখে না মা কী করছে! অথচ তাদেরই পুরনো কত কত কথা তাদের কাছে বলতে ইচ্ছে করে।নিজের কত অসুখ-বিসুখের কথা বলতে মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু যারা জিজ্ঞেসই করে না, আম্মা কেমন আছো?’ তাদের কাছে কোন মুখে বলা যায়, আমার শরীর ভালো নেই!
এখন তিনি বোঝেন, সন্তান আসলে নিজের ছত্রচ্ছায়ায় রাখার নয়। মা-বাবার অস্তিত্ব ফুঁড়ে তাদের জন্ম হবে।তাদেরকে লালন-পালন করতে করতে তাদের সাথে স্মৃতি ঘনঘটা বাড়বে।তাদের প্রতি মায়া বাড়বে।তারপর তাদের যে বউ আসবে, সন্তান-সন্তুতি হবে তাদের জন্য আরো মায়া বাড়বে, আর তারা এভাবে না হয়, ওভাবে সরতে থাকবে। তাদের মনে নতুন স্বপ্ন এসে শেকড় ছাড়বে।তাতে ডালপালা গজাবে। আর তারা পিছনের কথা ভুলে সে নতুনগাছ ও ডালপালার পরিচর্যা করবে। সেখানে পিছনের কথা ভাববার অবকাশ তাদের কই!এই মেয়েটির সাথে পরিচয় না হলে নিজের ভুল তিনি কোনোদিন বুঝতে পারতেন না!অন্যকে দিয়ে নিজের জীবন ভরানো যায় না। হোক না সে সন্তান! কারণ সন্তান তো মায়ের সম্পত্তি নয়। তার উচিৎ ছিলো এমন কোনো একটা কাজ করা, যাতে তার অর্থও আসবে। সময়ও কাটবে। তখন যার ইচ্ছে তাকে দেখতে আসবে, তার নিজের ইচ্ছে হলে নিজে গিয়ে দেখে আসবে। এখন এই পঞ্চাশ ছুঁই ছুই বয়সে নতুন করে কিছু করার উদ্যম তার নেই। তবু যদি ছোট ছেলেটার কোনো গতি হতো, নিজেকে নিয়ে না ভাবলেও তার চলতো!