বইমেলার গল্প ॥ হাসানআল আব্দুল্লাহ


এই তরুণের বয়স সতের বছর।এসেছিলো কুমিল্লা থেকে।একুশ তারিখে আমাকে মেলায় খুঁজে গেছে। বাইশ তারিখে সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর আমাকে আবিষ্কার করেছে অনন্যার সামনে। শব্দগুচ্ছ থেকে সম্ভবত রনি বা রিজভি ওকে আমার অবস্থানের ধারণা দিয়ে থাকবে।

সবে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র। কবিতা পাগল নাহলে কি আমার মতো কবিতায় বদ্ধ উন্মাদকে কেউ খোঁজে! স্বভাবতই ওকে আমার চেনার কথা নয়। বললো, ‌‘আপনি আমার নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন।’ আমি অবাক হই, ‘আমি আপনার নাম…!’ ও আমাকে ধরিয়ে দেয়, ‘ইউটিউবে আপনার সাথে কথা হয়ে ছিলো, আমি জাবির মিরাজ!’

মনে পড়ে গেলো যে সে আমার ইউটিউব চ্যানেলে কবিতার ছন্দ প্রশিক্ষণ ক্লাসের একনিষ্ঠ ভক্ত। ব্যাগ থেকে মোটা মোটা দুটি বই বের করে দিলো, ‘কবিতাসমগ্র-২’ ও আমার সম্পাদিত ‘বিশশতকের বাংলা কবিতা’!

আমি অটোগ্রাফ দিলাম। ওর সাথে আলাপে বিরতি দিয়ে পাঠক সমাবেশে নীল ও সূচনা যুগলের লাইভ আড্ডায় বসতে হলো।এই চমৎকার আলাপচারিতা সেরে শব্দগুচ্ছর দিকে যেতে যেতে ওকে বললাম, ‘তুমি এতো দূর থেকে এসেছো, তোমাকে কী উপহার দেবো!’ বলেই মনে হলো, ওর ব্যাগে কবিতাসমগ্র প্রথম খণ্ডটি নেই।বললাম, ওটি তোমাকে উপহার দেই। জাবির জানালো যে ওই বইটি সে ইতিমধ্যে পড়েছে, তার সংগ্রহে আছে। আমার এবার আরও বেশি অবাক হবার পালা। ওকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে বললাম, ‘আমার কবিতাসমগ্র প্রথম খণ্ডটি তুমি পড়েছো এবং সেটি তোমার সংগ্রহে আছে!’ ওর মাস্কে ঢাকা উজ্জ্বল মুখটি আমি দেখতে পারিনি, কিন্তু আলোকিত চোখ দুটি আমার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়নি।

২০১৯ সালে পোলিশ কবিতা উৎসবে পোল্যান্ডের একটি কলেজে আয়োজিত এক দুপুরের কবিতা সেশনে ঠিক ওর মতো আরেক তরুণ আমার ‘ঈশ্বর যখন মৃত’ কবিতাটি পোলিশ ভাষায় মুখস্থ আবৃত্তি করে আমাকে একইরকম আনন্দ দিয়েছিলো। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে অন্য কোনো বই!’ জাবির বললো, ‘কবিতার জন্মদাগ’! আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার ঘুরে দাঁড়ালাম, তুমি এই বইটির কথাও জানো! শব্দগুচ্ছ-এ এসে রনিকে বললাম মাওলা থেকে বইটি এনে দিতে। জাবিরকে শব্দগুচ্ছ’রও বেশ কটি কপি উপহার দিলাম। আমার কাছে ওর অনেক প্রশ্ন।রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ ওর প্রশ্নের সাথে ঘুরে ঘুরে উঠে আসেন।

একপর্যায়ে ওকে এগিয়ে দিতে গেলাম।গেটের দিকে কিছু দূর গিয়ে বললো, ‘স্যার আমার আরো কিছু প্রশ্ন ছিলো, কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাস করতে ভয় লাগে।’ আমি বললাম, ‘ভয় কেনো, অকপটে বলো।’

আমরা আবার ফিরে এলাম শব্দগুচ্ছ স্টলে। এবার তার প্রথম প্রশ্ন, ‘স্যার, আমি কি বলতে পারি যে আপনার কারণেই শহীদ কাদরী আবার কবিতায় ফিরেছিলেন?’… আমি একে একে তার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকি, কারণ জাবিরদের খুঁজে বের করতেই তো আমি প্রতি বছর আট হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বইমেলায় আসি।

এখানে বলে রাখি, প্রথম ছবি ঢাকায়, দ্বিতীয় ছবি পোল্যান্ড, জাবিরের মতো আরেক তরুণ মুখস্থ পড়ছে আমার কবিতা।