ছোটগল্পের বই হবে এই স্বপ্ন আমার অনেক দিনের।অণুগল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশুতোষ গল্প নিয়মিত লিখছি। ছোটগল্প লেখা ভীষণ কঠিন লাগে।আমার ছোটগল্পের সংখ্যা খুব বেশিও নয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প থেকে বাছাই করা ১২টি গল্প নিয়ে আমার প্রথম ছোটগল্পের বই “এইসব চন্দ্রমল্লিকা।”
গুণী শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রির করা চমৎকার প্রচ্ছদে বেহুলাবাংলা থেকে সদ্য প্রকাশিত এটি আমার ১২তম বই।অথচ মনে হচ্ছিল নিজের লেখা প্রথম কোনো বই হাতে পেয়েছি। সেরকমই আনন্দ হচ্ছে এখন অবধি।
চাকরিসূত্রে বহুবছর ঢাকায় থাকি।হঠাৎ ছুটিছাটা হলে জন্মভূমি প্রিয় কুলিয়ারচরে ছুটে যাই।তারই ধারাবাহিকতায় দুই দিনের ছুটি পেয়ে কিছু “এইসব চন্দ্রমল্লিকা” নিয়ে কুলিয়ারচর চলে আসি।কালী নদী, আমার শৈশবের খেলার মাঠ, স্কুল, রেলস্টেশন, পোস্ট অফিস এরকম কত কত প্রিয় জায়গা ঘুরে বেড়াবো ভেবে বেশ ফুর্তিতেই কাটছিল সময়। কিন্তু পরদিন বিকেলটাই যে আমার জন্য এত আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছে কে জানতো!
কুলিয়ারচরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন অন্যতম অভিভাবক, আমাদের সবার প্রিয় মানুষ শেখ জহির উদ্দিন ভাই “এইসব চন্দ্রমল্লিকা” বইটির ছোট করে একটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেললেন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে। এটা করতে গিয়ে পচাত্তর প্লাস বয়সের মহান মানুষটি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।নিজের চোখে দেখেছি ব্যানার করা থেকে শুরু করে মাঠ সাজানো, অনুষ্ঠানের দরকারি জিনিসপত্র যোগাড় করেছেন রীতিমত দৌড়ে দৌড়ে।সেই ছোট্টটি থেকে দেখেছি কুলিয়ারচরের সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলাসহ সামাজিক নানান কর্মকাণ্ডে জহির ভাইয়ের সরব উপস্থিতি।অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, পরিচালনা থেকে শুরু করে সংস্কৃতি কর্মীদের প্রবল ভালোবেসে কখনো কখনো একাই সামলে নিতেন সব।একই কাজ এখনো নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন।আমরা বুড়ো হচ্ছি, অথচ নিজ কর্মগুণ আর উদারতায় তিনি এখনো চির নবীন, এখনো আমদের জহির ভাই।
বদ্ধ ঘরে নয়, একেবারে কালী নদীর পাশে।খোলা আকাশের নিচে মাঠে আয়োজন৷গিয়ে দেখি গাছে গাছে বেলুন ঝুলছে আর লাল-সবুজ ফিতা দুলছে।অল্প সময়ের মধ্যে জহির ভাই যাকেই সামনে পেয়েছেন নিমন্ত্রণ করেছেন অনুষ্ঠানে এসে কুলিয়ারচরের তরুণ এক লেখককে অনুপ্রেরণা দিতে। এসেছিলেনও অনেক প্রিয় মানুষ। বিশেষ করে আমার বাল্য বন্ধুরা, পুরোটা সময় অনুষ্ঠান আলোকিত করে রেখেছিল তারা। যখন বন্ধুদের সাথে আলাদা আলাদা ছবি তুলছিলাম, আহা! আনন্দে মনটা ভরে উঠছিল।খুব মিস করেছি কুলিয়ারচরের বাইরে এবং দেশের বাইরে থাকা বন্ধুদের।তারা থাকলে আনন্দ দিগুন হতো নিশ্চয়।
আমার সৌভাগ্য কুলিয়ারচরের ছোট-বড় সকলের প্রিয়, চমৎকার ব্যক্তিত্ব আর জীবনে ভীষণভাবে সার্থক একজন মানুষ কাউসার খান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।প্রিয় কাউসার ভাই নিজেও লেখক।অতি অল্প বয়সে লুকিয়ে পড়েছিলাম তার লেখা প্রেমের উপন্যাস “প্রেমহীন ভালোবাসা”। পড়ে আমারও ইচ্ছে হয়েছিল তখন বই লেখার। ভাবি! আজকে আমার বারোতম বইটি হওয়ার পেছনে প্রেমহীন ভালোবাসার অবদান কম কিসে? ইতিমধ্যে দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে তার বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।তিনি থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়, কিন্তু হৃদয়ের সবটাজুড়ে কুলিয়ারচর।এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরে “এইসব চন্দ্রমল্লিকা” বইটি কাউসার ভাইকে উৎসর্গ করে আমি আনন্দিত হয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় পেশায় অভিবাসী আইনজীবী ছাড়াও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত রয়েছেন।অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের একটি প্রথম সারির দৈনিক এবং টেলিভিশনের প্রতিনিধি তিনি। অনুষ্ঠানের পুরো সময়জুড়ে কাউসার ভাইয়ের সদাহাস্যজ্বল উপস্থিতি সবাইকে প্রাণবন্ত রেখেছিল।
বইটির মোড়ক উন্মোচন করতে জহির ভাই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমার শিক্ষক, সংস্কৃতজ্ঞ পরম শ্রদ্ধেয় বাবু অনীল চন্দ্র সাহা স্যারকে। স্যারের কাছে মাধ্যমিকের পুরো সময়টা বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত বিষয়ে পাঠ নিয়েছি। একইসাথে স্যারের আদর ভালোবাসা তো ছিলই। সহজ সরল জীবন, সততা আর মহানুভবতার পাঠও নিয়েছি সেই ছোটবেলা থেকে স্যারকে দেখে দেখে। ভীষণ মনে পড়ছিল আমার শিক্ষক জালাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে। অনেক বছর হলো তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আমি নিশ্চিত জালাল স্যার শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলে জহির ভাই উনাকেও আমন্ত্রণ জানাতেন। এবং প্রবল আনন্দ নিয়ে স্যার উপস্থিতও হতেন। জালাল স্যার যেখানে আছেন ভালো থাকুক সেই প্রার্থনা।
অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেদিন অনীল স্যারের সঙ্গে আরো পেয়েছিলাম কুলিয়ারচর সরকারি কলেজের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ভাইকে। রফিক ভাই আমার প্রতিবেশী। আমার বাবাকে ডাকতেন চাচা বলে। সেই থেকে তিনি আমার বড় ভাইয়ের মতো। ছোটবেলা থেকে দেখতাম প্রতি ঈদের সকালে বাসায় এসে আব্বা, আম্মাকে সালাম করতেন। মুরব্বিদের সম্মান করার শিক্ষা পরিবার থেকে যেমন পেয়েছি তেমনি রফিক ভাইদের দেখে দেখেও। ছোটবেলা থেকেই রফিক ভাইয়ের আদর ভালোবাসা পেয়ে এসেছি। অনুষ্ঠানে উনার উপস্থিতি এক ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালনের উদাহরণ।
অনীল স্যার তার ছাত্রের লেখা গল্পের বই হাতে অনুষ্ঠানের শেষ দিকে কাঁদছিলেন। উপস্থিত স্যারের ছাত্ররা তখন স্যারকে পালা করে করে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সেরা সুন্দর দৃশ্য এটি। ঘরোয়া এই অনুষ্ঠানে অনীল স্যার, রফিক ভাই, কাউসার ভাইসহ সকলের আগমন আমার জীবনে অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।
পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিল আলী হায়দার। তরুণ সৎ এবং সাহসী সাংবাদিক। শুধু সঞ্চালনার দায়িত্বে নয়, অনুষ্ঠানটি সফল করতে জহির ভাইয়ের পাশে থেকে যেভাবে ছুটোছুটি করেছে সে তার তুলনা হয় না। মাতৃভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ থাকলে পরেই আলী হায়দাররা অমন নিঃস্বার্থ দৌড়াতে পারে।
এইসব চন্দ্রমল্লিকাকে ঘিরে প্রিয় কুলিয়ারচর বিএডিসির সবুজ প্রাঙ্গণে সেদিন হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছিলেন যারা তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা।