পর্ব-৮
আলী আকবর খান ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন। তিনি নজরুলের বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। তিনি কিছুতেই নজরুলের চলে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। তিনি পরিবারের সবার কাছে ছোট হয়েছেন। যে মানুষটির কারণে দৌলতপুর গ্রামে খান পরিবারের মান-মর্যাদা উচ্চস্তরে পৌছে গেছে; সেই মানুষটিই আজ পরিবারের কারো সামনে মুখ দেখাতে পারছেন না। লজ্জায় তার মাথা হেড হয়ে গেছে। তিনি কারো সামনে যান না। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। একঘরে হয়ে যাওয়া লোকের মতোই তার অবস্থা।
আলী আকবর খান মনে মনে ভাবেন, এভাবে চলতে পারে না। আলী আকবর খান পরাজিত হবে তা কিছুতেই হতে পারে না। গ্রামের লোকেরা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে তা কি করে মেনে নেবেন তিনি! এসব ভাবতে ভাবতে তার মাথা বিগড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। তিনি নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেন। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে আলী আকবর। একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কথায় বলে না; রেগেছ তো হেরেছ! কাজেই রাগা যাবে না।
আলী আকবর খান কলকাতায় যাবেন বলে মনস্থির করলেন। তিনি কলকাতা থেকে নজরুলকে ফেরাবার ব্যবস্থা করবেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, কাবিননামায় নজরুলকে ঘরজামাই করার শর্ত জুড়ে দেয়াতেই সে গোস্সা করেছে। অভিমান করে সে চলে গেছে। তার অভিমান ভাঙাতে হবে। যে করেই হোক তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য যদি টাকা খরচ করতে হয় তিনি করবেন। সেই সিদ্ধান্তও মনে মনে নিয়ে রেখেছেন।
আলী আকবর খান নার্গিসকে কাছে ডাকলেন। নার্গিসের সঙ্গে আসমাতুন্নেসাও তার কাছে গেলেন। নার্গিসকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বললেন, মা তুই কোনো চিন্তা করিস না মা। আমি যে করেই হোক নজরুলকে ফেরাবো। তুই তার বিবাহিত স্ত্রী। তোকে ফেলে রেখে সে নিরুদ্দেশ হবে তা হতে পারে না। এ আমি হতে দেব না।
নার্গিস কোনো কথা বলল না। সে মাথা নীচু করে রইল। আসমাতুন্নেসা বললেন, ভাই আপনি তারে জোর করতে যাইয়েন না। বুঝাইয়া কইয়েন। আমার মেয়েটা..
আসমাতুন্নেসার কান্না চলে আসে। তিনি আর কথা বলতে পারেন না। তার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে শুরু করে। তিনি আঁচল দিয়ে চোখের পানি মোছেন। তারপর আবার বললেন, চিন্তায় চিন্তায় মেয়েটা কেমন যেন হইয়া গেছে। মেয়েটার দিকে তাকাতে পারি না!
আবারও আসমাতুন্নেসা কেঁদে ওঠেন। তিনি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। আলী আকবর খান বোনের চোখে পানি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি আবেগজড়ানো কণ্ঠে বললেন, তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। আমি তো যাচ্ছি। তাকে নিয়েই আমি বাড়ি ফিরব।
আশায় বুক বাঁধেন আসমাতুন্নেসা। নার্গিসও তার মামার কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়। আলী আকবর খান রওয়ানা হন কলকাতার উদ্দেশে। নার্গিসকে সঙ্গে নিয়ে তাকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন আসমাতুন্নেসা। তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে নার্গিসকে তিনি সান্ত্বনা দেন। দেখ, তোর মামা তো বলল, তাকে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনবেন। আর মন খারাপ করে থাকিস না মা! তোর কথা ভেবে ভেবে আমিও রাতে ঘুমাতে পারি না।
ধরা গলায় নার্গিস বলল, আমাকে একটু সময় দাও মা। আমি আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিব। তুমি দেখ।
আসমাতুন্নেসা মেয়েকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন। মেয়েকে আদর করেন। তারপর আবার হাঁটতে থাকেন। বাড়িতে গিয়ে নার্গিসকে নিয়ে তিনি নিজের ঘরে বসলেন। নার্গিসের এলোমেলো চুল আচড়ে দেন। আলমারি থেকে নতুন একটা শাড়ি বের করে নার্গিসের হাতে দিয়ে বললেন, যা গোসল করে আয়। কদিন ধরে তো ঠিক মতোন নাওয়া খাওয়া করিসনি। এবার নাওয়া খাওয়া কর। আর নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর। তিনি যেন মন-বাসনা পূরণ করেন।
নার্গিস আসমাতুন্নেসার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। সে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে। আসমাতুন্নেসা আবার বললেন, আর আল্লাহর কাছে কি বলবি জানিস? আল্লাহর কাছে বলবি, হে আমার প্রভু, আমি যদি জীবনে কোনো ভুল করে থাকি, যদি কোনো পাপ করে থাকি তা হলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার মা বাবা কিংবা আমার পরিবারের কেউ যদি পাপ করে থাকে তাহলে তাদেরকেও ক্ষমা করে দিও। হে আমার ভাগ্য বিধাতা, অন্যের পাপে আমাকে পুড়িও না। অন্যের আঘাত আমাকে দিও না। আমি যদি কোনো পাপ করে থাকি তাহলে তোমার কাছে ক্ষমা চাই। তুমি ক্ষমা কর, ক্ষমা কর!
ঠিক বলেছ মা। আমি বিধাতার কাছে এই প্রার্থনাই করব। আজ থেকে নামাজ পড়ে এই প্রার্থনাই করব।
নার্গিসের কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেলো আসমাতুন্নেসার। তিনি মেয়েকে আবারও আদর করতে করতে বললেন, আমার লক্ষি মা। যা এবার গোসল করে আয়।
তুমি গোসল করবে না?
করব।
তাহলে চলো। গোসল করে আসি!
আমি রান্না শেষ করে করব।
আমি তোমার সঙ্গেই করব না হয়!
আচ্ছা, চল তাহলে রান্না ঘরে যাই। দুজনে মিলে রান্না শেষ করি।
আসমাতুন্নেসা ও নার্গিস রান্না ঘরে যায়। আসমাতুন্নেসা চুলায় মাছ বসিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। মেয়ের ছোটবেলার কথা মনে করেন। নার্গিস কিভাবে কথা বলত, কিভাবে হাঁটত আর কিভাবে খেলা করত সেসব গল্প শোনান মেয়েকে। অতীতের সেই স্মৃতি তার মনে দারুণভাবে রেখাপাত করে। কিছুক্ষণের জন্য সে ভুলে যায় সব দুঃখ কষ্ট। সে একটার পর একটা প্রশ্ন করে। আর আসমাতুন্নেসা এক এক করে মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেন। নার্গিস গুণমুগ্ধ স্রোতার মতো সেই কথাগুলো শোনে। অনেকদিন পর তার মনটা অন্যরকম এক আনন্দে ভরে ওঠে।
(চলবে)