অতীত মানেই তো স্মৃতি।বরফে চাপা পড়া নিটোল, নিখুঁত, অক্ষত আনন্দ-বেদনার রূপ। কিন্তু অতীতের সব স্মৃতি কি অক্ষতভাবে সংরক্ষিত থাকে ? স্মৃতি-বিস্মৃতির লড়াইয়ে বরফের চাঁইয়ের ভেতরে টিকে থাকা অক্ষত অতীতই তো প্রকৃত স্মৃতিলেখা।
‘The Iceman’ এর নিজের কোনো অতীত নেই।অথচ সে সবকিছুরই অতীত জানে ও তা ধরেও রাখে। জাপানের বিখ্যাত সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির গল্পের বরফ মানুষ কারো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগ্রহী না। বরফ ভবিষ্যৎ ধারণ করতে পারে না। বরফ কেবল চাপা-পড়া অতীতকে ধারণ করে বা সংরক্ষণ করে।বরফ মানুষও তাই করতে পারে।
‘The Iceman’ এর মতো মানুষ পৃথিবীতে বিরল। মানুষ বর্তমানে থেকেও আশ্চর্যজনকভাবে ভবিষ্যৎমুখী হয়ে থাকে সবসময়।তবে মানুষকে কোনো না কোনোভাবে জীবনের কোনো না কোনো প্রান্তে থেকেও কিন্তু অতীতমুখী হতে হয়।বরফ মানুষও হতে হয়।বরফের আড়াল সরিয়ে খুঁজে আনতে হয় স্মৃতির নুড়ি। আর স্মৃতির টানেই মানুষ ফিরে যেতে চায় অতীতে।
মানুষ আদৌ তার অতীতের সকল কিছুরই পুনরাবৃত্তি চায় কি ? আমার তো মনে হয় অতীত থেকে বেছে নিতে বললে মানুষ কেবল তার সুখস্মৃতিই বেছে নিতে চাইবে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবু স্মৃতি খুঁজে ফিরলে দেখি অক্ষত স্মৃতিগুলোতেই অঢেল বেদনার ভার। সুখস্মৃতিগুলো যেন হাওয়ায় কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেছে।তখন কানামাছি খেলার মতো নিজের চোখ বেঁধে ফেলি।দেখতে চাই না সব।কিন্তু ভুলটা সেখানেই হয়, মুদিত চোখেই ঘটে স্মৃতির বিস্ফূরণ। ভাবি সময় করে বসে টুকটুক করে লিখে ফেলবো সব। কিন্তু যতটা ভুগি স্মৃতির উৎপাতে ততটা ভোগান্তি কলমকে আর দেওয়া হয় না।
অথচ মফস্বলী এই জীবনে নিত্য যাওয়া-আসার মাঝেও হাতে থাকে অঢেল সময়।স্মৃতির সঙ্গে সময়যাপনের অবারিত সুযোগও পেয়ে যাই হাতের মুঠোয়।তাই মনকে স্থির করে সবসময় কলম ধরতে না পারলেও ভাবতে থাকি লাগামহীন।
ভাবি, এ জীবন মন্থন করে কী তুলেছি ? কী তুলছি ? স্নেহ ? ভালোবাসা ? ঘৃণা নাকি অবিশ্বাসের সুতানলি সাপ ? যেদিকে তাকাই, যেদিকেই বসি, অচেনা এক সাপ তার আগ্রাসী ফণা দোলাতে দোলাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।ফুর্তিবাজ পাখিদের কলকাকলি থেমে গেছে, সবুজ নীল হয়েছে বিষে।একলা আমি ডুবে আছি বিষাদের নুনগোলা জলে।
অস্বীকার করবো না, তবুও তীব্রভাবে ভালোবাসি এ জীবন।ভালোবাসি জীবনের সমুদ্রসমগ্র।নুনজলে ভেসে, ডুবে জীবনের সব আশ্চর্য সুন্দরকে ভালোবাসতে রোজই মরিয়া হয়ে উঠি।
পরের পর্ব পড়ুন: আমাদের সাদাকালো জাদুবাকশো