কবিতা অমত্র্য, দৈব এবং অলৌকিক।কবিতা লোকোত্তর পরিতৃপ্তি দান করে।আজ যে কবির তিনটি কবিতা নিয়ে সামান্য পর্যালোচনা করবো, তার নাম নাফিসা ইসলাম।নিজেকে পরিচয় দেন শুধু একজন পাঠক হিসেবে।তবে তিনি একজন বই-ভিক্ষু, যেমন পড়েন, তেমনই পাঠ-ধ্যান, খুব সামান্যদিনই জানি তাকে এবং তার বিষয়ে।তবে এই অল্পদিনে এতটুকু বুঝেছি-তিনি একটি অন্তর্বাহী উপনদী, বইছেন নিজের ভেতরে নিবিড়ভাবে।
নাফিসা ইসলামের ভাব-নির্ঝর-১:
কোন উচ্চ অভিলাষ নেই;
কণ্ঠা, অনামিকায় স্বর্ণখণ্ড চুমু
আমার জন্য নয়
মর্মর ইমারতের জৌলুশ
সে তোমাদেরকেই মানায় ভালো;
আমার জন্য, শুধু এক টুকরো সবুজ চাই
দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত
ভেজা রোদ্দুরের আকাশ
আর লাল মাটিপথ ধরে হেঁটে যাওয়া
মায়ের নিশ্চিন্ত কাঁধে মাথা রেখে
নিদ্রাচ্ছন্ন শিশুর স্বর্গীয় যে হাসিটি
পেয়েছি উপহার-ওইটুকু,
শুধু ওইটুকু নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারি
তিন তিনটি নশ্বর জীবন।
একটা জীবনই কি যথেষ্ট!
নরম রোদে ভেজা শঙ্খচিলের ডানার কাছে
কত দেনা আছে ফেলে যাওয়া পালকের!
অপ্রতুল সময়ের কাছে
খণ্ড খণ্ড অস্তিত্ব বিকিয়ে বসে আছি।
ভেবোনা যে, মৃতঃঅর্থে শেষ হয়ে যাবো;
মগ্ন তরুর ঝলমলে পাতার শিষে জেগে উঠবো আবার
ফিরে আসবো সমাধিক্ষেত্রের কোলাহল থেকে
শিশির জ্বলা সবুজ ঘাসের কোমল শরীর
একটুও না মাড়িয়ে
ফিরে আসবো বাউল হাওয়ায় টানটান ফুলে ওঠা পালে
শঙ্খচিলের সাথে ছুটে যাবো পাল্লা দিয়ে
অনিকেত মেঘ থেকে বৃষ্টির ফোঁটায়
নেমে এসে ছুঁয়ে দিবো শিশুর স্বপ্নাবিষ্ট চোখ
অমল শিশুর গাঢ় স্বপ্নের ভেতর ঘুমিয়ে থাকবো-
অনন্তঃ…
সাধারণভাবে কবিতা হলো কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ শিল্পভাবনা; কবির মনোজগতে যা আসে তা ভাবনাতেই ছিলো ভাব আকারে, বস্তুতে প্রতিফলিত হয়নি আগে।কিন্তু কবি তাকেই রচনা প্রতিভার গুণে কাব্য হিসেবে নতুন রূপ দেন- ‘ভেবোনা যে, মৃতঃঅর্থে শেষ হয়ে যাবো’;
কিংবা, ‘অনিকেত মেঘ থেকে বৃষ্টির ফোঁটায় নেমে এসে ছুঁয়ে দিবো শিশুর স্বপ্নাবিষ্ট চোখ
অমল শিশুর গাঢ় স্বপ্নের ভেতর ঘুমিয়ে থাকবো
অনন্তঃ’- কবি নাফিসা ইসলাম সৌন্দর্য ভাবনার দারুণ স্ফূরণ ঘটিয়েছেন, বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ভাব ও বোধের।
নাফিসার দ্বিতীয় ভাব নির্ঝর পদ্যটি:
উপমাহীন দূরত্ব থেকে দেখি
নিয়ত ভেঙে পড়ছো; আবারও
সহজেই বেড়ে উঠছো কোষে-কলায়।
ছুঁতে চেয়ে পা বাড়াই যতটা
সময়ের সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছ
তারচেয়েও বেশি-
এমনঃ নখেও পড়েনা ছায়া কোনো।
সময় পেছনে হেঁটেছে কখনো!
অ্যালবামে জমিয়ে রাখা ছবিদেরও
সজ্জা খসে পড়ছে নিয়মিত-
অবিশ্রান্ত জলদ বাতাসে; দিনান্তে;
অপেক্ষমাণ কথাদের নিরবতা
নিঃশ্বাস গর্জনে, আরও গাঢ় হয়ে
জমে ওঠে নিষুপ্তির পরিপাটি চাদরে।
আজকাল দেয়ালের আয়নাটিকেই
মনে হয় সবচেয়ে কাছের;
সামনে দাঁড়ালেই আশ্বস্ত-হেসে বলে
দেখেছো:তোমাকে…এই ঘরে,
কেউ চেনে…এখনো।
এই কবিতায় তার কাব্যের ভেতর দিয়ে বাস্তববোধের উন্মোচন ঘটেছে; পাশাপাশি আমরা তো জানি কবিতা হলো-কবি মনে স্থিতিভাব ও ভালোবাসার জাগরণ।নাফিসা ইসলামের লেখা উপরের দুটো কবিতা পাঠের পরে যেমন নির্মন আনন্দ পেলাম, আমার মন প্রাণও সমৃদ্ধ হলো। এইটি সত্য যে, বিশেষ মুহূর্তেই কবিতা লেখা হয়।মনের অস্থিরতাবোধেও কবিতা লেখা যায় না।
‘শব্দার্থৌ সাহিতৌ কাব্যম’,- বলেছেন আলংকারিক আচার্য ভামহ।এর অর্থ শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ে কাব্য গড়ে ওঠে।নাফিসা ইসলামের কবিতাগুলো সরল সুন্দর আনন্দের কথা বলে। সবুজ ডেকে আনে মনের বনে।বাক্যের শব্দ আর অর্থকে আটপৌরে না রেখে সাজসজ্জায় সাজিয়ে দিলেই বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে।এই সাজসজ্জার নাম অলংকার।কি চমৎকার এক ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন-
‘অপ্রতুল সময়ের কাছে
খণ্ড খণ্ড অস্তিত্ব বিকিয়ে বসে আছি’।
এখানে নাফিসা বলছেন যেন- সময়হীনতায় পৌঁছে ঊনতায় বিলিয়ে দিলাম আমার বিদ্যমানতাটুকু,
টুকরো, টুকরো, ছিন্ন কর্তিত ভগ্নাংশে।
নাফিসা ইসলামের কবিতাগুলোর মতন একই ধরনের মোহ বা ভাব বিরাজিত একটি বিদেশি অণুগল্প পাঠ করেছিলাম কিছুদিন আগে – ‘ইন আ হাউজ বেসিজড’ নামে, লিখেছিলেন লিডিয়া ডেভিস।
মার্কিন লেখিকা লিডিয়া ডেভিসের ফ্ল্যাশ ফিকশন ‘চতুর্দিকে ঘিরে রাখা ঘর’, আর নাফিসা ইসলামের পঙক্তি ‘অমরতা খোঁজে সহজ স্পর্শ’ ঐকতান ও উপমিতির কথকতা:
আমেরিকান গল্পকার লিডিয়া ডেভিস তার Flash Fiction বা অণুগল্পগুলোর জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।একবার এক ফোরামে লেখক হওয়ার পেছনের গল্প নিয়ে বলতে গিয়ে মজা করে বলেছিলেন- ‘লেখা ব্যাপারটা আমার প্রথম প্রেম নয় কিন্তু লেখক হয়েই আমি যেন পুরো প্রেমে ডুবে গেলাম।লিখতে ভালোই লাগে।’
তিনি বলেন, ‘আমার অণুগল্পগুলো এক একটি গগণচুম্বী দালানের মতন, যার চতুর্দিকে শূন্যতা দিয়ে ঘিরে আছে।’
আসুন আজ তার এমন একটি অণুগল্পের ভাবান্তর পড়ি এবং তার সাথে নাফিসা ইসলামের তৃতীয় পদ্যটির খেয়াল সাদৃশ্যতা নিয়ে ভাবনায় ডুব দেই।
অণুগল্প : অবরুদ্ধ বাড়ি
এক বিশেষ ধরনের পরিস্থিতিতে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রাখা ছোট্ট একটি বাড়িতে এক দম্পতি থাকেন।তাদের রান্নাঘরে ডিনার-টেবিলে খাবারের সামনে বসলেই আশপাশ থেকে ছোট ছোট বিস্ফোরণের শব্দ পেতেন রোজ।
প্রায়দিন এইসব শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে স্ত্রীটি বলতেন- ‘তুফান এলো বুঝি, তাই এইরকম বাতাস বইছে’। তার কথা উড়িয়ে দিয়ে স্বামীটি বলতেন- ‘নাহ! তুফান নয়, মনে হয় ডাকাত দল এলো, লুটপাট শুরু করেছে’।এমন উদ্ভট কথা শুনে স্ত্রীলোকটি তার স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন- ‘তোমার সব বাজে ভয়।আমার মনে হয় বৃষ্টি পড়ছে।তার আগে তুফান এলো’।স্বামী লোকটা এবার বিরক্ত হয়ে বলল- ‘তুমি যত্তোসব ফালতু বকো।যদি ডাকাত না পড়ে, আমার মন বলছে, সৈন্যরা এসেছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, বোমা পড়ছে’।
এই অণুগল্পটিতে- দেখতে পাই বা প্রশ্ন জাগে মনে:
এটি কী নারী ও পুরুষ, কীভাবে একটি ব্যাপারকে আলাদাভাবে দেখে বা উপলব্ধি করে তার মেটাফোর বা রূপক?
এর উত্তর হলো- হ্যাঁ, অনেকটা তাই। This is the metaphor of how men and women viewed and perceived thing differently.
লিডিয়া ডেভিসের এসব সাইমেট্রিক্যাল লেখাগুলোর সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো- সেখানে দুটি বিপরীত লিঙ্গের বস্তু বা মানুষের মনস্তাত্বিক জটিল বিশ্লেষণকে ছন্দবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয়ে থাকে।এখানে নারী ও পুরুষ বা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভয়ে কুঁকড়ে আছে, তারা বসে আছে একটি অবরুদ্ধ বাড়ির ভেতরে, রান্নাঘরে।পুরুষ লোকটি মানবসৃষ্ট বিপদের ভয়ে ভীতু হয়ে পড়েছে।আর স্ত্রীলোকটি প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে।দুজনই যেন থমকে আছে নাফিসা ইসলাম রচিত সেই লাইনটির মতন-
‘প্রেম-গন্ধী ফুল থেমে আছে সময়ের নির্দিষ্ট বাঁকে’।
নাফিসা ইসলামের তৃতীয় পদ্য:
যাবতীয় স্মৃতির অসুখ
ভুলে গেছে পরিক্রমা
আমাদের অখণ্ড আবাসে
প্রেম-গন্ধী ফুল থেমে আছে
সময়ের নির্দিষ্ট বাঁকে
জল অথবা জলহীনতায়
পরিবর্তনহীন; প্রগাঢ় স্থিরতায়-
কথকতার সুনিপুণ ভাঁজ খুলে
ছড়িয়ে রাখি, রৌদ্রের উঠানে
অমরতা খোঁজে সহজ স্পর্শ
এসো, আমাদের নির্বাচিত স্বপ্নসমূহ
গাঁথতে গাঁথতে জুড়িয়ে নিই প্রাত্যহিকতায়…
লিডিয়া ডেভিসের ওই গল্পে একটা বাড়ির ভেতরে আটকা পড়ে স্ত্রীলোকটি বুঝতে পারে- তার বাড়িটি তার বিশাল হৃদয়ের ভেতরেই কোথাও আছে। সেই বাড়ির উপর দিয়ে ঝড়ো বাতাস বয়, বৃষ্টিরা ঝরে পড়ে এবং এরপর বাগানে ফুল ফুটবে, পাখিরা আসবে, গাইবে, সুর দিয়ে ভরিয়ে দেবে চারপাশ, এত কিছুর ভাবনাতে ডুবে নারীটি যেন বাড়িতেই ডুবে যায়। অথচ সেই বাড়িটিতেই সে বাস্তবে বসে আছে। যার চারপাশ অবরুদ্ধ কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।নাফিসা ইসলাম তাই তো ভেবেছেন- ‘পরিবর্তনহীন; প্রগাঢ় স্থিরতায় কথকতার সুনিপুণ ভাঁজ খুলে ছড়িয়ে রাখি, রৌদ্রের উঠানে অমরতা খোঁজে সহজ স্পর্শ, এসো, আমাদের নির্বাচিত স্বপ্নসমূহ গাঁথতে গাঁথতে জুড়িয়ে নিই প্রাত্যহিকতায়’।
কিন্তু পুরুষ লোকটির ভাবনা যেন অন্যরকম। তার কাছে নিজ বাড়িতে থেকেও বাড়ি যেন নিরাপদ স্থান নয়।বিস্ফোরণের শব্দে মনে হয় কোনো ডাকাত এলো, সন্ত্রাসীরা বুঝি হামলা করবে, বা সৈন্যবাহিনীর দল এসেছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, বোমা পড়ছে।
এই গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তা হলো- পুরুষরা ধ্বংসের দিকে (যুদ্ধ, শিকার) আর নারীরা সৃষ্টির দিকে (প্রকৃতি) প্রস্তুত হয় বা এগিয়ে যায়। লোকটা যেন বাড়িতে থেকেও নেই, যেন সে এখানে থাকেই না।কিন্তু স্ত্রী লোকটির বিশাল হৃদয়ে বাড়ি আছে। সেখানে বাতাস বয়, বৃষ্টি পড়ে আর পাশের পুরুষ লোকটিও ছায়া-সঙ্গী হিসেবে সে বাড়িতে থাকছেই তো।