আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি ॥ আমিনুল ইসলাম


যেদিন প্রথম দেখা, রাজশাহী নিউ মার্কেটে,
ভালো লেগেছিল,
দেখতে তো তুমি সুন্দরই ছিলে,
লম্বা, ছিপছিপে, মাথাভর্তি চুল
বোতামের ফাঁক দিয়ে
বুকভরা লোমের উঁকিঝুঁকি;
কিন্তু আমাকে মুগ্ধ করেছিল তোমার কথা,
যেন নজরুলের কবিতা,
অবিশ্বাস করবো-
এমন কোনো ফাঁক ছিল না উচ্চারণে।
অবশ্য তখন আমার বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা নয়,
তখন আমার প্রেমে পড়ারও সময় ছিল না হাতে।

তখন আমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে-অ্যাপ্রন-উজ্জ্বল দিন;
তখন আমার বাস্তবের বারান্দায় কল্পনার হাওয়ার দোলা;
তখন আমার উঠোন জড়িয়ে-
একটি স্বপ্নমাখা ভবিষ্যতের ভূগোল;
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বুঝতে পারি
বিধাতার বাসনায় প্রচুর প্যারাডক্স থাকে,
সেদিনও ছিল; আজও কি নেই?

তো অতঃপর আমার অন্তরঙ্গ আনন্দিত হওয়ার পালা শুরু
অতঃপর আমার নিবিড় বিস্মিত হওয়ার পালা শুরু
অতঃপর আমার অভূতপূর্ব চাপাকান্নার অঘোষিত উদ্বোধন;

তুমি চরাঞ্চলের কৃষকের ছেলে ছিলে বলে
কৃষকদের প্রতি তোমার বাড়তি পক্ষপাত দেখে বিস্মিত হইনি;
কিন্তু রিকশায় উঠেই রিকশাওয়ালার সাথে
ছোট পরিবার আর শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে
আলাপ জুড়ে দেয়া,
‘বুঝলে, কোনোভাবেই দুটোর বেশি সন্তান নেবে না,
আর যতই কষ্ট হউক, তাদের লেখাপড়া করাবে!’
দোকানে গিয়ে ধূর্ত দোকানির সবকথাকেই
মুহূর্তে বিশ্বাস করে ফেলা,
‘ঠিক আছে, এটা প্যাক করে দিন।’
অফিসের কেরানী আজিজ বাসায় এলে
তাকে আপ্যায়নে বাড়াবাড়ি,
পিওন শফিককে পাশে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে
একসাথে ডিনার করা, সত্যি বলতে কি আকাশ,
এসব আমার ভালো লাগতো না;
আফটার অল, আমি তখন শহরের
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা
এক কলেজ-যুবতী যার শরীরে
দুটি জোতদার রক্তের ক্ষয়িষ্ণু ধারা,
যার আবেগ ও রুচির প্রশ্ন
নির্বাচিত সিলেবাসের সাজেশন নিয়ে তৈরি।

অথচ আমার চোখের ভাষাকে অগ্রাহ্য করে
প্রৌঢ়া এক কাজের মহিলাকে তুমি
এমনভাবে খালা বানিয়ে তুললে যে-
পড়শি ভাবীরা পযন্ত বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন-
তিনি তোমার সত্যিকারের খালা,
গরীব হয়ে পড়ায় রান্নাবান্না করেন আমাদের বাসায়!

আমার মনে আছে, তোমার অধর থেকে
তখনো বেরিয়ে আসতো ছাত্রজীবনের বামপন্থী ঘ্রাণ
যদিও বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনে
মুকুল ভাইয়ের মতো শোকাহত ছিলে তুমিও।

কিন্তু যেই পন্থী হও, তুমিও পদোন্নতি চাইতে;
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কীসব বিদঘুটে ধরনের
বইপত্র পড়তে! হায় পদোন্নতি!
এদেশের সরকারি চাকরিতে কখন কীভাবে
কেন পদোন্নতি হয়, আর কেন যে হয় না,
এত বোঝো, অথচ আজ পর্যন্ত এই ছোট্ট বিষয়টা
বোঝাতে পারলে না আমাকে!
তোমার নাকি এসিআর ভালো; সবকিছু ক্লিয়ার;
তাহলে বাধা কোথায়!
আচ্ছা আকাশ, এসএসবি জিনিসটা কী?
সেটা কি বোদলেয়ারের বিড়াল
কিংবা টেড হিউজের কাক
অথবা জীবনানন্দ দাশের
মহিনের ঘোড়াগুলোর লাহান কিছু?
তুমি তো অন্তত আমাকে একবার দেখাতে পারতে!
তোমাদের সরকারি চাকরিজীবীদের বাইবেল-
অই যে ফিরোজ মিয়ার ‘চাকরিবিধি’ বইটি,
যেটা প্রায়শই পড়তে তুমি অফিস যাওয়ার আগে,
সেটি পড়া ছেড়ে দিয়েছো তুমি সেই কবে! কেন?

অবশেষে চল্লিশোর্ধ্ব নাহার খালার বিয়ের মতো
বঞ্চিত সেই তোমার পদোন্নতি হলো একদিন;
আহা পদোন্নতি!
গাড়ি পেলে, সাথে ইয়ং এক ড্রাইভারও;
আমার তো আনন্দ; সায়মাও খুশি;
আর কয়েকমাস যেতে না যেতেই
আমাদের ছোট্ট শিমুল
ড্রাইভার আজিজুলকে বানিয়ে নিলো
তার সবচেয়ে আপনজন;
সায়মা-শিমুল আজিজুলকে পাশে নিয়ে
ডাইনিং টেবিলে বসে খায়
আর কোথায় কোথায় যাবে
তার অগ্রিম ট্যুর প্রোগ্রাম বানিয়ে
মেতে ওঠে উচ্ছলতায়;
শিমুল বড় হয়ে ড্রাইভার হবে,
আজিজুলের মতই তার একটি গাড়ি থাকবে,
ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই সে লিখে ফেললো
তার মাই এম ইন লাইফ রচনা
আনকোরা শৈশবের স্লেটে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে
আসে বেগম রোকেয়া দিবস,
নারী স্বাধীনতার লম্বা মিছিল,
উচ্চকিত স্লোগান:
‘নারীর প্রতি বৈষম্য, মানি না, মানবো না!’
আমাকে সাথে নিয়ে তুমি মেতে ওঠো
সে-মিছিলের নেতৃত্বে,
অনভ্যস্ত সেই আমাকে বক্তৃতা দিতে হয়
আলোচনা অনুষ্ঠানে;
প্রাইমারির সুরাইয়া আপা নতুন বাঁধা ভাওয়াইয়া গানে
ভাসিয়ে দেন নারী বৈরিতার যাবতীয় জঞ্জাল!
এমনই হাততালি, মনে হয়
হাততালির শব্দে ফেটে যাবে
পুরুষতন্ত্রের পুরানো কান !
অভ্যস্ত স্থানীয় মাননীয়দের না নিয়ে,
জেলা প্রশাসকদের বাদ দিয়ে,
তুমি স্থানীয় বিশিষ্ট নারীদের প্রধান অতিথি,
বিশেষ অতিথি বানাও-
সে-সকল সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে!
তোমার পুরুষ সহকর্মীরা,
যারা সংখ্যায় ছিল প্রায় নব্বই ভাগ,
এসব মন থেকে মেনে নিতেন না,
সেটা আমি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে
ঠিকই টের পেতাম; জেনেও ছিলাম;
আমার একধরনের ভয়ও হতো।
কিন্তু ক্যাম্পাসের আমন্ত্রিত ভাবীগণ,
স্কুল-কলেজের ম্যাডামবৃন্দ,
অংশগ্রহণকারী এনজিও-নারীরা
সর্বোপরি স্লোগানে সোচ্চার ছাত্রীরা
গভীরভাবে উচ্ছলিত হয়ে উঠতেন;
অবসরের দেয়ালে হেলান দিয়ে
ফেলে আসা দিনের দিকে তাকালে-
তাদের চোখমুখের সেই উদ্ভাসিত ছবি-
আজও আমি দেখতে পাই।

নারী স্বাধীনতার ইঞ্জিনে তুমি কতটুকু অকটেন দিতে পেরেছিলে,
সে-হিসাব আমার কাছে নেই,
হয়তোবা সে কথা ভুলে যেতে বসেছেন
সেদিনের সেই নারীরাও;
তবে একথা আমি আজও ভুলিনি-
সেদিনের সেই তুমি, যাকে বলে হিরো-,
তাই-ই হয়ে উঠেছিল
বেশকিছু নারীর চোখে,
যাদের-কেউ ছিলেন চাকরিজীবী,
কেউ এনজিওকর্মী,
কেউ ছাত্রী,
কেউবা আমার মতো কক্ষচ্যুত নক্ষত্র।
আমি এসব, বলা যায়, এনজয়ই করতাম,
বলা যায়, এক ধরনের গর্বও হতো আমার যদিও
মুখ ফুটে সেসব কাউকে বলতাম না,
তোমাকে তো নতো নয়ই।

পুরোহিত সময়কে পিছে ফেলে, তুমি আর আমি,
হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম-
সকালে, সন্ধ্যায়, রৌদ্রে, বৃষ্টিতে, শীতেও;
আর ছুটির দিন পুকুরঘাটে বসে সিলেবাসহীন আড্ডা!
ক্যাম্পাসের ভাবীরা প্রথম প্রথম অবাক হতেন,
পরে তারাও কেউ কেউ যোগ দিতেন আমাদের সাথে;
আমরা যখন লক্ষীপুরে, ডিসিভাবী তো দেখামাত্রই
‘এই যে এসে গেছে মানিকজোড়’- বলে আমাদের
পাশে বসিয়ে আদর করতেন,
আমরা উৎসাহিত হতাম, ধন্যবাদ দিয়ে বলতাম,
‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন, ভাবী!’
অবশ্য তোমাকে ঘিরে ব্যাচমেট ভাবীদের
কারও কারও মুগ্ধ দৃষ্টি, নিবিড় প্রশংসা
মাঝে মাঝে সন্দেহের মেঘ জমাতো
আমার মনের আকাশে,
কিন্তু তোমার প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল বলে
সেসবকে পাত্তা দিতাম না মোটেও।

আমরা বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ পেতাম,
আমরা রৌদ্রে পুড়ে আনন্দ পেতাম
আমরা সচ্ছল সহবাসে আনন্দ পেতাম
আমরা একটা ছোট্টো চুমুতে আনন্দ পেতাম
আমরা পাতানো ঝগড়ায় আনন্দ পেতাম
আমরা প্রাপ্তিতে আনন্দ পেতাম
আমরা অপেক্ষায় আনন্দ পেতাম
আমরা সাফল্যে আনন্দ পেতাম
আমরা ব্যর্থতায় আনন্দ পেতাম।

এভাবেই চলতে পারতো জীবন-
এভাবেই চলতে পারতো সবকিছু;
কিন্তু আবারও বিধাতার বাসনার প্যারাডক্স!
সহসায় আমার নিবিড় বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে
একবার একটা বিল ক্লিনটন করে বসলে!
আর কাঁদোমাদো চোখ রেখে আমার উৎকণ্ঠিত চোখে-
হাতজোড় সত্যবাদিতায় স্বীকার করলে সবকিছু
‘আমাকে বাঁচাও সাগর! আমাকে বাঁচাও!
প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!
আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে চাই না!’
আমি কোনো কথা বলার আগেই
পলাশীর আম্রকানন ছোঁয়া সেই
ঐতিহাসিক বেদনা ও গালি সিডর হয়ে
তোলাপাড় জুড়ে দিলো
মেঘনার পাড় ছুঁয়ে থাকা আমার ছায়াঢাকা বুকে!

ঘৃণা শব্দটিকে তার পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনায়
সেই প্রথমবারের মতো আবিস্কার করলাম আমি!
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো
কী ভয়ানক কুৎসিত একটা মুখ! তাহলে আমি কি
এ মুখেই চুম খেয়ে এসেছি এতদিন?
চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল আমার!
কীসের ক্ষমা! ইচ্ছে হলো, থাপ্পড় থাপ্পড়ে
তোমার বাম গালটা বাঁকা করে দিয়ে,
পার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ের ওপর নির্মিত
এশিয়ার একাদশ বৃহত্তম সেতু,
একটানে চলে যাই বেগম রোকেয়ার বাড়ি,
একটি ভুল মানুষের জন্য
যেখানে ফেলে এসেছি আমি আমার
সারাজীবনের স্বপ্ন ও ভালোবাসার সিলেবাস!

কিন্তু বিধাতা বোধহয় পুরুষ!
তিনি তোমার পক্ষ নিলেন;
আমার এজহারহীন চোখের জলে-
ধুয়ে গেল
ভেসে গলে
ডুবে গেল
সাংসারিক ইমপিচমেন্টের ভাবনা!

তুমি চাকরি করো, কবিতা লেখো, বক্তৃতা দাও
হাঁটো, খাটো, ঘুমাও-
সবখানেই তোমার একটা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে
মানবতার পক্ষে অনড় তোমার অবস্থান;
বসরার গুলবাগিচায় মার্কিনীদের বোমা পড়ে,
উত্তরাধুনিকতার বেড়া ভেঙে-
তোমার কবিতায় ঢুকে পড়ে নজরুলীয় আবেগ;
আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশু ও শকুনের ছবি
কেভিন কার্টারের ক্যামেরা নয়,
তোমার হাতে তুলে দেয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের হারানো কলম;

রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে-ঘুমের মধ্যে
জেগে ওঠো তুমি, ঘুম ভেঙে যায় আমারও;
আসামের বাঙালিদের তাড়াতে অন্যায় এনআরসি হয়,
তুমি ছটফট করো, তোমার হাতে রচিত হয়-
গণতন্ত্রের জঙ্গলায়ন নামক প্রতিবাদের কবিতা;
অথচ আবার ভেতরের ও বাইরের অনেক চাপের কাছে
মাঝে মাঝে হেরে গেছো তুমি,
মাঝে মাঝে সারেন্ডার করেছো,
মাঝে মাঝে পিছু হটে এসেছো;
এটা তোমারই কথা, বাল্যে পড়শির বরইগাছে ঢিল ছোড়া
ছিল তোমার দ্বিতীয় আনন্দ;

হয়তোবা তারই প্রভাব
তাই মাঝে মাঝে ভুলের চাররঙা ঠোঁটে
চুমু দিয়ে দেখতে গোপনে;
অথবা হয়তো এটাই আসল কারণ যে-
নিয়তিও তোমার পক্ষে থাকেনি কখনও
একটানা কয়েক বছর;
যখনই বড় কোনাকিছু করতে চেয়েছি আমরা,
তখনই মুহম্মদ বিন তুঘলকের ভাগ্য এসে
দাঁড়িয়েছে বাস্তবায়নের পথে;
নদীপাড়ে জন্ম তোমার; নদীই তোমার প্রথম প্রেমিকা
তোমার কবিতা মানেই-
স্রোত, ঢেউ, ছলছল, কলকল আর পাড়ভাঙার শব্দ!

কিন্তু কেবল নদীর কবিতাই নয়, নদীপাড়ের ভাগ্যও তোমাকে
ছেড়ে যাইনি কোনোদিন!
একথা ওকথা বলে তুমি আমাকে বোঝাতে চাইলেও
আমি আসল ব্যাপারটা ঠিকই টের পেয়ে যেতাম।
কিন্তু তুমি কষ্ট পাবে বলে বলিনি তোমাকে কোনোদিন।
আমি এও বুঝি-
সরকারি চাকরি একটা অন্য জিনিস;
আর চাইলেও নজরুল হওয়া যায় না;
বিদ্যাসাগরেরাও একবারই জন্মান দুনিয়ায়।

এটা ঠিক, শুরু থেকেই নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে
তোমার সোচ্চার ভূমিকা
ধাক্কা দিয়ে গেছে পুরুষতন্ত্রের প্রাসাদে ;
আমি এও বুঝি-সারাদিন, সারামাস, সারাবছর-
তুমি আমাকেও গভীরভাবে ভালোবাসো,
সাগরবিহীন জীবন তুমি কল্পনাও করতে পারো না,
যারা তোমার কাছাকাছি অন্তত একবার এসেছে,
যারা পড়ে দেখেছে তোমার অসংখ্য কবিতা,
তারা সবাই জানে এবং বিশ্বাসও করে–এসব।
আমি তো করিই।

শুধু আমাকে খুশি করতে, আমাদের যৌথজীবনের
প্রথমদিন থেকেই, তুমি ছেড়ে দিয়েছো-
তোমার দেড়যুগের ভালোবাসা:
প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই!
না, শেষপর্যন্ত আর ঠোঁট ভিড়াওনি তার ঠোঁটে;
এমনকি বন্ধনের কোনো পিকনিকে গিয়ে
গাছের আড়ালেও তাকে ছুঁয়ে দেখোনি
পুরাতন একটিবার;

অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে,
সেই তোমার জীবনে
আমি ছাড়াও অনেক নারী এসেছে,
যারা তোমার কবিতায়
কখনো সমুনা
কখনো জোয়ানা
কখনোবা পপি
কখনোবা সুমি
কখনো আবার হে শ্যামাঙ্গী অধ্যাপিকা;
এবং এমন আরও কত!
এদের কাউকে কাউকে আমি নিজেও দেখেছি।
তুমি লিখেছো-
‘আমি কবি, ভালোবাসা আমার বদাভ্যাস।’
আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমি জানি,
এটা শুধু কাব্যিকতা নয়; এটা কেবল কথার কথা নয়।

আমি জানি না, এসব নারীর সাথে তোমার সম্পর্কের
একচুয়াল ধরন কিংবা পরিধির কথা
কিন্তু তুমি নিজেই লিখেছো,
‘ভালোবাসা অনিয়মের নদী।’
হয়তো এসব অনিয়মের নদীতে-
দু’একবার ডুব দিয়েছো তুমি,
হয়তো দাওনি,
কিন্তু আমি টের পাই, সুযোগ পেলেই তুমি
নদীর কলতানে কান পাতো,
তীরে বসে ঢেউ গোনো,
জলের আঁচল উড়ে এলে,
হাতে নিতে হাত বাড়াতে যাও!
একদিন নয়, দুদিন নয়, এক-দুছরও নয়,
তোমার সাথে একটানা ছাব্বিশ বছর
আমি আজ নিশ্চিত যে-
তুমি কোনোদিনও শাহরুখ খানের মতো
একনিষ্ঠ ছিলে না;
আজও তা হয়েছো কি না, জানি না;

অথচ আমার প্রতি তোমার টানেও
ঘাটতি দেখিনি কোনোদিন
কোনোদিনও মনে হয়নি, এমনকি আজও নয়-
তোমার কাছে এতটুকু ফুরিয়ে গেছি আমি;
দেশের ভেতরে বা বাইরে, যেখানেই যাও,
আমাকে সাথে নেয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠো,
তোমার পাগলামির কাছে হার মানতে হয়
দোটানায় পীড়িত এই আমাকে;
পিকনিকে, অথবা অন্য কোনো গেট টুগেদারে,
আমাকে নিয়ে যৌথতায় আবৃত্তি করো কবিতা,
পাশে দাঁড়িয়ে গলা মেলাও আমার গানের সাথে;
আমি যতখানি নই, তারচেয়ে বড় জানো আমাকে
এবং সেভাবেই উপস্থাপন করো-
তোমার কবিতায়, বক্তৃতায়, পারিবারিক আড্ডায়,
অন্যদের সাথে আলোচনায়।

অথচ সবকিছুর যৌথ-অংশীদার হয়েও
আজও নিশ্চিত হতে পারিনি-
কী তোমার ভালোবাসার কেন্দ্র,
কোথায় তার পরিধি!
একবার মনে হয়, তুমি অসম্ভব ভালো;
আবার মনে হয়-অনেকখানি খারাপ;
একবার মনে হয়-সত্যিই ভালোবাসতে জানো তুমি,
আবার মনে হয়, তোমার সবকিছুই বোগাস,
মনে হয়, তোমার সবকিছুই-
হাওয়ায় দোলা অদ্ভুতচারিতা!
কী গ্রন্থিল স্ববিরোধ তোমার মাঝে!
কী এক অমীমাংসিত মানুষ তুমি!

তুমি তো জানো, আমি বরাবরই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত,
পরিমিত আর পরিশীলিত আমার প্রতিটি মুহূর্ত
অথচ তুমি তোমার প্রিয় নজরুলসঙ্গীতের রচয়িতার মতো
বাসনায় এলোমেলো, স্ববিরোধে সার্বভৌম;
মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়-যখন ভাবি-
আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি
তুমি আসলে কি চাও!
আমি তো তোমার জীবনের কোনো সিলেবাস খুঁজে পাইনি!
মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে
ওদের একবার জিজ্ঞাসা করি!
কিন্তু ওরাও কি জানে কিছু!

হায়, পদ্মাপাড়ের দুরন্ত মার্বেলবালক,
সোনালী ব্যাংক শাসিত শহরে এসেও
আজীবন মার্বেল বালকই রয়ে গেলে;
খেলে গেলে নিজের জীবন নিয়ে
সে-জীবনে জড়িয়ে রইলাম আমিও;
জড়িয়ে রইলো-অনাগত হাজারো রাত ও দিন
জড়িয়ে রইলো- কত অন্তরঙ্গ অনিশ্চয়তা!
জড়িয়ে রইলো- আরও কত কি!

না। আমি রবিশঙ্করের অন্নপূর্ণা হওয়ায় বিশ্বাসী নই;
কোনোদিনও তা ছিলাম না।
তারপরও জেনেশুনে তোমার সকল কাজে সহায় হয়েছি
দুঃসময়ের চাকায় তোমার এক পা ভেঙে গেলে
আমি তোমার ক্র্যাচ হয়েছি
লক্ষ্য ঠিক রেখে, যাতে করে তুমি,
তোমার প্রিয় ক্রাচের কর্নেলের মতো
এগিয়ে যেতে পারো বাকিটা জীবন।
কবিতা ভালোবাসো বলে বিজ্ঞানের ছাত্রী এই আমি
আইনস্টাইনের ভক্ত হয়েও মুখস্থ করেছি
জীবনানন্দ-আল মাহমুদ-আবুল হাসানকে।

তুমি তো জানো, যাকে বলে গড়পড়তা নারী,
কোনোক্রমেই আমি তা নই;
সেই অবলা-অসহায় প্রাণীও ছিলাম না কোনোদিন,
যেখানে মিলেছে যৌথতায়, তোমার সহায় হয়েছি
কিন্তু একটিবারও ভুলে যাইনি,
এজীবনে আমারও রয়েছে নিজস্ব ব্রত;
সম্মিলিত পায়ে, অথবা একলা-
আমারও রয়েছে গন্তব্যগামী পথচলা;
তোমার এত নামধাম হওয়া সত্ত্বেও
আমার নামের ডানপাশে-
রচিনি তোমার নামের উজ্জ্বল উপনিবেশ।

অধিকন্তু অনেক টেকসই সৌন্দর্য নিয়ে জন্ম আমার;
তুমিও জানো, বিয়ের আগে এবং পরে-
আমাকে ভালোবেসে এসেছে অনেক পুরুষ,
কত সহকর্মী, ব্যাচেলর অথবা বিবাহিত,
আমার সাথে শুধু দুটো কথা বলার জন্য
আমাদের বাসায় এসেছে-
ছুটির বিকেলে, উৎসবের সন্ধ্যায়,
কখনোবা তোমার সাথে অফিসিয়াল বিষয়ে
জরুরি পরামর্শ করার অজুহাতে,
অনেকখানি অসময়ে।
আর এখন তো আমার মহাবিশ্বে যোগ হয়েছে-
আরো দুটি নতুন পৃথিবী;
তসলিমা নাসরিনের প্রতিটি বই, একের পর এক
তুমিই এনে দিয়েছো;
সেসবের-
প্রতিটি বাক্য,
প্রতিটি শব্দ,
পড়েছি আমি;
আমার বিড়ম্বিত বিশ্বাসে গেঁথেও রয়েছে
সেসবের অনেকগুলো;
অথচ তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না
তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে গেলে
না! না!-করে ওঠে আমার অন্তরঙ্গ অস্তিত্ব;
আকাশ, আমি কি তোমাকে ভালোবাসি?