‘স্মৃতি আসলেই অদ্ভুত।আমি যখন সেখানে ছিলাম, তখন আমি কখনই
ভাবিনি যে, বিষয়টি আমার ভেতরে কোনোরূপ স্থায়ী ছাপ ফেলতে সমর্থ হবে।এমনকি এটাও আমি কল্পনাও করিনি যে, দীর্ঘ দেড় যুগ পর আমি এতো বিস্তারিতভাবে বিষয়টির স্মৃতি রোমন্থন করব।’ – হারুকি মুরাকামি (নরওয়েজিয়ান উড)
মাঝে মধ্যেই শৈশবের কিছু ঘটনা বা স্থানের কথা মনে পড়ে যায়।এই যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে একটা প্রান্তরের কথা।
আমাদের বাড়ির উত্তরে মাইলখানেক দূরের ঝাড়কাটা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই প্রান্তর।কখনও সবুজ, কখনও রুপালী, কখনও ধূসর, কখনও হলুদ বা সোনালী রঙ ধারণ করত সেই প্রান্তর।ঋতুতে ঋতুতে।মহাশূন্য থেকে দৃশ্যমান একটি কাঁসার থালার মতো গোলাকার ছিল সেই প্রান্তর। এর পরিধিজুড়ে ছিল নীলাকাশ।বৃত্তের পরিধির মতো।ধূসর-সবুজ গ্রামের পেছনে।বৃত্তাকারে ঘুরে যাওয়া সেই দিগন্তরেখাকে আমার কাছে মনে হতো এক অপরুপ বাগানের চারিধারের হেজলাইন।আর পেছনে অর্থাৎ দিগন্ত থেকে আরও দূরে আবছায়াভাবে দৃশ্যমান হতো নীলাভ একটা পাহাড়। অনেক দূরে। পাহাড়টির নাম গারো পাহাড়।
লিকলিকে সাপের মতো সরু একটা খাল দিগন্তের উত্তর প্রান্ত থেকে ঝাড়কাটা গ্রাম অতিক্রম করে প্রান্তর অতিক্রম করে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়েছিল। শেষ হয়েছিল আমাদের বাড়ির উত্তর প্রান্তে। কাচারিঘর, আলতাফুর দাদাদের গোয়ালঘরের পাশে, তালগাছের নীচে, পগারের ভেতরে।
প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে এই খাল পথ ধরেই বানের পানি আমাদের গ্রামে প্রবেশ করত।এমনিতে আসত না।আমন্ত্রণ করে আনতে হতো। গ্রামের সকল শিশু কিশোরেরা খুব সকালে চলে যেতাম ঝাড়কাটা নদীর পাড়ে।
সকালের নরম আলোতে নদীর ঘোলা পানি ফুলতে থাকত।এবং খালের ভেতরে ঢুকে পড়ত। প্রথমে ঢুকত খালের মেঝের দূর্বাঘাসের আস্তরণের নীচে। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে সামনের দিকে এগোতে থাকত।ধমনীর মধ্যে রক্ত প্রবাহের মতো।কখনও দুপুরের আগে, কখনও বা গোধূলির আগে প্রপাতের গর্জন নিয়ে ঢুকে পড়ত আমাদের সেই পগারে।বৈশাখের রুদ্র তাপে শুষ্ক পগার তখন মুহূর্তেই সজীব হয়ে উঠত।
একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করত প্রান্তর।বর্ষার কিছুকাল পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত পাটগাছে ছেয়ে যেত পুরো প্রান্তর।ধুসর সবুজের ঢেউয়ে সারা দিনমান কাঁপতে থাকত।খালের সমান্তরালে একটা পায়ে চলা মেঠো পথ সেই পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে থেকে ঝাড় কাটা গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
ঝাড়কাটা গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই পথ দিয়ে ঝাড়কাটা স্কুলে আসত। এই পথ দিয়েই আমি প্রতিদিন সন্ধেবেলায় প্রান্তর অতিক্রম করে ঝাড়কাটা গ্রামের একটা বাড়িতে যেতাম।একটা পরিবার থেকে এলুমিনিয়ামের জগে করে দুধ আনতে।ফেরার পথে সন্ধ্যা হয়ে যেত।
পুরো পথটাই থাকত জনশূন্য।গোধূলির আগমনে পাটক্ষেতের ভেতরে অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসত।চারদিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙ ডাকত।অজানা ভয়ে আমার গা ছমছম করত।আকস্মিক কোন শব্দ শুনতে পেলেই আমি এলুমিনিয়ামের জগটাকে বুকের সামনে জাপটে ধরতাম।তারপর ডান বাম কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড়াতে থাকতাম। ঊর্ধ্বশ্বাসে। মনে হতো পাটক্ষেতের ভেতর থেকে হাজার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ফিসফিস করে সেই চোখের মালিকেরা পরস্পরের সাথে কথা বলছে।হয়ত বা আমাকে নিয়েই।এক সময়ে পাটক্ষেতের ঘনত্ব কমে আসত।আমি অস্পষ্টভাবে আমাদের বাড়ির তালগাছটিকে দৃশ্যমান দেখতে পেতাম।বুকের ধুকপুকানি কমে আসত।কতবার যে এই সন্ত্রস্ত যাত্রায় জগ থেকে দুধ ছিটকে বের হয়ে আমার বুকের সামনের জামাকাপড় ভিজিয়ে দিত তার ইয়ত্তা ছিল না।
বর্ষায় প্রান্তরটা মনোরম দৃশ্য ধারণ করত।পুরো প্রান্তর ভেসে যেত বানের পানিতে।আমাদের বাড়িটাকে তখন মনে হতো পানির ওপরে ভেসে থাকা একটা দ্বীপ।বানের ঘোলা পানির ওপরে মাথা জাগিয়ে থাকত শুধু আমন ধানের মাথাগুলো।দূর থেকে মনে হতো সবুজ রঙের ঢেউ।কোনোদিন এই জলের প্রান্তরজুড়ে শুরু হতো নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা।৮০ থেকে ১৫০ ফুট লম্বা বাইচের নৌকাগুলো যখন একসাথে বৈঠা মেরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ঝাড়কাটা নদীর দিক থেকে ডুবে যাওয়া প্রান্তরের উপর দিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসত, তখন নৌকার বয়াতিদের গানের তালে নাচতে নাচতে আন্দোলিত হতে থাকত গ্রামের প্রতিটি মানুষগুলোর মন।
আমাকে একবার বাইচের নৌকার সামনের অংশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।আমার হৃদয়ের কম্পন আর ঢেউয়ের কম্পন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
বর্ষার শেষের দিকে অথবা শরতের প্রারম্ভে অথবা প্রান্তরের উপর থেকে জল সরে যেতে থাকত।পাতলা হয়ে আসত প্রান্তরের উপরের জলের আবরণ।শাপলা পাতায় ও ফুলে যেত জলজ সেই প্রান্তর।ডিঙি নৌকায় করে স্বচ্ছ পানির ওপর দিয়ে আমরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে যাতায়াত করতাম। আরও কিছুদিন পর জল ক্রমে নেমে আসত খালের খালের ভেতরে।
প্রবল স্রোত নিয়ে সেটি প্রবাহিত হতো আমাদের পাগারের দিকে।মাছেরা কিলবিল করতে করতে নেমে আসত খালের জলে।মাছ শিকারের উৎসবে মেতে উঠত পুরো জনপদ।
জল নেমে যাবার পর লাঙলের ফলার আঘাতে উপড়ে ফেলা হতো প্রান্তরের নরম মাটি।মৃত শামুক, ঝিনুক আর শালুক কুড়াতে বের হতো গ্রামের শিশু-কিশোর–কিশোরীরা।নতুন ফসলের বীজ রোপিত হতো। পুনরায় সবুজে সবুজে ছেয়ে যেত সমস্ত প্রান্তর।
হেমন্তে পাকা ধানের রঙে সোনালী বর্ণ ধারণ করত প্রান্তর। শুরু হত ধান কাটার উৎসব।নবান্নের আনন্দে মেতে উঠত জনপদ।প্রান্তরের সারা গায়ে জমে থাকত সোঁদা গন্ধ।অতঃপর পুনরায় রিক্ততা। শুধু মাটির নীচের ইঁদুরের গর্তগুলো পরিপূর্ণ হয়ে থাকত ধানের শীষে। প্রান্তর তখন পূর্ণ হয়ে থাকত আমন ধানের ন্যাড়া দিয়ে।প্রান্তরের রঙ ক্রমে বদলে হয়ে যেত বিবর্ণ হলুদ।কোদাল দিয়ে ইঁদুরের গর্ত থেকে এলাকার গরীব ছেলে-মেয়েরা বের করে আনত রাশি রাশি ধান।
প্রান্তরের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কয়েকটা রেইন ট্রি কড়ই ও আম গাছ নিয়ে নিশ্চুপ এক জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা।আমার জন্মের পূর্বে এই জায়গাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বলে শুনেছি। আমার বুদ্ধিলগ্ন থেকে সেই স্থানটিকে আমি পরিত্যক্ত হিসেবেই দেখেছি। স্কুল থেকে আসার পর নির্জন দুপুরে প্রতিনিয়ত আমি সেখানে যেতাম। কয়েকটা শঙ্খচিল ছিল এই জঙ্গল রাজ্যের আদি বাসিন্দা। আমি যতক্ষণ এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতরে থাকতাম, ততক্ষণ শঙ্খচিলগুলো মাথার ওপর দিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে চক্কর দিতে থাকত। কোন কোন সময়ে উড়তে উড়তে দিগন্তের ওপারে অদৃশ্য হয়ে যেত।শ্যাওড়া, আকন্দ, নিশিন্দি, বেতফলের গাছ এবং গুল্মলতা দিয়ে তৈরি ছিল সেই জঙ্গল। সেখানে বাস করত অনেকগুলো জীবন্ত প্রাণী-টিকটিকি, গুইসাপ ও বেজি। হয়ত বা দুই একটা সাপও।
আমার সামনে দিয়ে মাটির উপর দিয়ে বুকে ভর দিয়ে হেঁটে যেত গুইসাপেরা।আমাকে ভ্রূক্ষেপ করে দেখতও না তারা। জঙ্গলের শ্যাওড়া গাছের ভেতরে বাসা করে ছিল কয়েকটা কয়েকটা টুনটুনি।সারাক্ষণ আমার চারপাশে মৃদঙ্গের মত শব্দ করতে থাকত। আর ছিল অনেকগুলো হলুদ নরম পায়ের খয়েরী শালিক।প্রতিটা মুহূর্ত ভরিয়ে রাখত কিচিরমিচির শব্দে।