সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কিংবা অসংখ্য শাণিত কলাম রচনার জন্যই নয়; পঞ্চাশের দশকে যে কজন কথাশিল্পী জীবন ও সমাজকে পাশাপাশি রেখে সমাজবাস্তবতার অম্লমধুর গান গেয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (জন্ম ১৯৩৪) তাদের মধ্যে অন্যতম। কেননা শিল্পীমাত্রই সমাজজীবনের অনুসন্ধিৎসু দর্শক।সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচার, অনাচার, ব্যভিচার, জ্বালা-যন্ত্রণা, জীবনের উন্মত্ততা ও নগ্নতাকে পছন্দ মতো শৈল্পিক উপাদানে কলমের আঁচড়ে সাহিত্যে তুলে ধরেন।আবদুল গাফফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি সামন্তবাদ ও বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলোকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।আমরা আলোচ্য প্রবন্ধে তার গল্পের আলোকে বিষয়টি চিহ্নিত করার প্রয়াস পাব।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রকাশিত গল্প গ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। গ্রন্থগুলো হলো ‘সম্রাটের ছবি’ (১৯৫৯), ‘কৃষ্ণপক্ষ’ (১৯৬৬) ও ‘সুন্দর হে সুন্দর’ (১৯৬৭)।
‘সম্রাটের ছবি’ গ্রন্থের ‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি সামন্ততন্ত্রের এক উজ্জ্বল মাইলফলক।এ গল্পে আবদুল গাফফার চৌধুরী তৎকালীন সময়ে জমিদারদের বৃটিশপ্রীতির এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে দেশ স্বাধীনের পরও বৃশিটদের প্রতি তাদের অন্ধ প্রীতির আলেখ্য চিত্রিত করেছেন।গল্পের নায়ক যুবক জমিদার উমর আলী খান।তিনি বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ও সাহায্য সহযোগিতার জন্য পেয়েছেন ‘খান বাহাদুর’ উপাধি।এর মধ্যে তার জীবন থেকে ঝরে পড়েছে চল্লিশটি বছর।তার সংসার বড় হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে।বিলুপ্তি হয়েছে জমিদারি প্রথা। তবুও প্রাচীন ঐতিহ্যকে লালন করার জন্য তিনি বহন করছেন ‘সম্রাট জর্জ দ্য ফিফথ’ এর ছবি।সেগুন কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটি দীর্ঘসময় পাড়ি দিলেও তার জৌলুস এখনও বিলুপ্ত হয়নি।খান বাহাদুর এখনও ছবিটিকে ঋষিতুল্য ভক্তি করেন।তাইতো চাকরকে কাঁধের ময়লা গামছা দিয়ে ছবিটি পরিষ্কার করতে দেখে খান বাহাদুর হা-হা করে গর্জে উঠে বললেন-
করছিস কি, করছিস কি হারামজাদা? তোর ময়লা গামছা লাগিয়েছিস ঐ ছবিতে! শালা জানিস ঐ ছবি কার, তোর বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ যার নিমক খেয়ে মানুষ।দৌঁড়ে যা, আমার টার্কিশ তোয়ালেটা নিয়ে আয়। তারপর ফের ধুয়ে রাখিস।
অন্যদিকে তার ছেলে মনসুর সদরের তরুণ উকিল।জেলা জজের ছোট জামাই।মনসুরের স্ত্রী রিজিয়া আধুনিক শিক্ষা ও জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। মনসুর বৃটিশপ্রীতিকে উপেক্ষা করে সবার সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে। বৈঠকখানার সোফায় সাধারণ প্রজাদের বসবার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু খান বাহাদুর এসব সহ্য করতে পারেন না।তবুও ছেলের যুক্তির কাছে হার মানেন।আরও হার মানেন ছেলে ও বৌমার সুকৌশলে সামন্ততন্ত্রের আঁকড়ে ধরা শেষ চিহ্নটি উৎখাত করার সময়। তখন খান বাহাদুর রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তিনি আরো ক্ষুব্ধ হন চল্লিশ বছর আগে শয্যাগৃহে রাখা মহারাণী ভিক্টোরিয়ার যুবতী বয়সের ছবিটি সরানোর পর। বিবির অজ্ঞতা ও মূঢ়তা দেখে তিনি রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন-‘জান ছবিটি কার? রামা-শ্যামা তোমার আমার নয়, রাণীর-হারম্যাজেস্ট্রি কুইনের; যার রাজ্যে বাস কর।’
তবুও বিবি তার জিদ বহাল রাখে।কারণ মেয়ে মানুষতো।মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষকে সহ্য করতে পারে না।তারপরও আবার যুবতী রাণী। তাইতো চল্লিশ বছর পরে বাতের ব্যথায় ক্লান্ত ও মেদবহুল বিবি ছেলের বৌয়ের ঘরে ঢুকে সেই ছবিটি দেখে স্বরসতী বাঁদীকে ডেকে বললেন- ‘ওই রাণী মাগীর ছবি এখানে কেন?’ শুধু তাই নয় বৌমার ঘরে অশ্লীল ছবি দেখে বলেছেন-‘এগুলো কি ছবি বৌ! মেম সাহেবরা ন্যাংটো হয়ে নাচছে। এগুলো কি ছবি? এদের জাত, মান, পর্দাপুষিদা, ইজ্জত আছে?’
এখানেই চরিত্রটির মনস্তাত্বিক দিকের পরিস্ফুটন ঘটেছে। ‘সম্রাটের ছবি’ গল্পটি রোমান্টিক আবহে নির্মিত একটি মধুর রসের গল্প। এখানে মানবজীবনের জটিলতাকে উন্মোচিত করে একটি জীবনতত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সার্বিক বিচারে গল্পটি পাঠকনন্দিত হতে পেরেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘নীল কমল’ গল্পে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারের অভ্যন্তরীণ জীবন-জটিলতার বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।এ পরিবারের সামন্ত প্রতিভূ শমসের আলী খান।একসময় তার জমিদারির জৌলুস ছিল।কালক্রমে তা নিঃশেষ হতে চলেছে।লেখক তার ক্ষয়ে যাওয়া সামন্ত প্রাসাদের বর্ণনা দিয়েছেন এভোবে-
বসবার ঘরে পা দিয়েই বুঝলাম, জুতোর নিচে কার্পেট বিছানো।যদিও এখন ধূলি-মলিন এবং বিবর্ণ, তবু এককালে যথেষ্ট দাম দিয়ে কেনা হয়েছিল সন্দেহ নাই।… এককালে হয়তো ঘরটা ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করা ছিল, এখন চারদিকে পলেস্তারা খসে শ্যাওলা জমে বিচিত্র বর্ণ সমারহের সৃষ্টি হয়েছে।দেয়ালে নবাব-সুবাদের সাজে সজ্জিত পূর্ব পুরুষদের তৈলচিত্রগুলো অস্পষ্ট, জীর্ণপ্রায় হয়ে এসেছে।একপাশে ইংরেজ প্রভুদের অনুকরণ করতে গিয়ে তৈরি ফায়ারপ্লেসটা এখন স্তুপীকৃত জঞ্জালে ভরে রয়েছে।বসতে গিয়ে সাবধান হতে হলো।সোফার একদিকের আচ্ছাদনী সরে স্প্রিং বেরিয়ে পড়েছে।
এর কারণ শমসের আলীর চরিত্রের স্খলন।সে চাঁদনী রাতে বজরায় গিয়ে রাত কাটায়।পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স্কা কুলসুমের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এমনকি দ্বিতীয় স্ত্রী বেগম রিজিয়া বানুকে উপেক্ষা করে তার আবার নতুন বিয়ের পরিকল্পনা।মধ্য বয়সে উপনীত হয়েও শমসের আলীর পরিবারে কোন সন্তান নেই।সন্তানহীনতার বেদনায় তাকে আবার বিয়েতে উদ্বুদ্ধ করে।তাই সে পরিকল্পনার বৈরিতা নিয়ে ডাক্তারকে দিয়ে স্ত্রীকে পরীক্ষা করান।কিন্তু বিষয়টি আলাদা।যা তার স্ত্রীর কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে-
মদ আর মেয়ে মানুষের পেছনে সব উড়িয়ে এখন প্রায় ফতুর। গেটে যে দারোয়ানটা দেখেছেন, সেও যাচ্ছে না কেবল সাবেক আমলের লোক বলে।নইলে-
এগুলো তার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সন্তানহীনতার কারণ হলেও তিনি নতুন বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অটল।ডাক্তার সাহেব বেগম রিজিয়া বানুর মা হওয়ার কোন অন্তরায় না দেখে শমসের আলীকে পরীক্ষা করতে চান। কিন্তু শমসের আলী বাঁদী কুলসুমের গৌরবর্ণ পুত্রটিকে দেখিয়ে হেসে বলেন এই ছেলেটি তারই ঔরসজাত সন্তান।তখন ডাক্তার মনে মনে বলেন-
দশ বছর আগের সেই সুস্থ সমর্থ শমসের আলী আজ কোথায়? এতদিনের অত্যাচারের পরিণতিই যে এই নয়,তা কি আপনি বলতে পারেন?
সর্বোপরি ‘নীল কমল’ সম্পর্কে বলা যায় লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতারই একটি জীবন্ত গল্পরূপ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
‘নতুন গোধূলী’ গল্পটি আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি প্রেমের গল্প। এখানে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে।গল্পের নায়ক জমির একজন খ্যাতিমান গায়ক।গানের নেশা-ই তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।ঘুরতে ঘুরতে সে আশ্রয় পেয়েছে গল্পের নায়িকা হাসিনা বানুদের বাড়িতে।হাসিনা জমিরের কণ্ঠ পছন্দ করে, জমির পছন্দ করে হাসিনার রূপ ও সৌন্দর্য।দুজন দুজনকে ভালোবাসে।কিন্তু তাদের মিলনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় হাসিনার বাবা।সঙ্গত কারণেই তারা পাড়ি জমায় শহরে।কিন্তু গায়ক অবস্থায় জমিরের যে উদাসীনতা তা তাকে নতুনভাবে পেয়ে বসে।ধীরে ধীরে তার গলা বসে যেতে শুরু করে এবং শরীর ভেঙে পড়ে।জমির ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারে তার গান ছেড়ে দিতে হবে এবং পুরোপুরি অবসরে থাকতে হবে।তারপর থেকেই শুরু হয় হাসিনার প্রতি তার উদাসীনতা।কারণ জমির জানে হাসিনা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং জমিরই তার একমাত্র ভরসা।এজন্যই জমির টিউশনির উসিলা করে সারাদিন বাইরে থাকে। কেউ টিউশনির জন্য এলে তাকে নানা টালবাহানায় ফিরিয়ে দেয়। হাসিনাকে ভুলে থাকার জন্য সে মদ পান করে।হাসিনা বাধা দিলে তাকে প্রহার করে।এমনকি স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক মুহূর্তেও তাকে সোহাগ থেকে বিরত করে।
এভাবেই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জ্বলতে থাকে জমির।জীবনে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে সে এখনও টিকে আছে।শেষ পর্যন্ত তার জীবনের ট্রাজিক পরিণতি দেখা যায়।গল্পকার গল্পের শেষ পরিণতি টানার জন্য প্রথম থেকেই উত্তমপুরুষের চরিত্র আমদানি করেছেন।সে ‘আমি’র বদান্যতায় জমিরের চিকিৎসা হয়।আর হাসিনা বানু খুঁজে পায় এক নির্ভরতার প্রতীককে।জমির ভালো হয়ে ওঠে এবং এর ছয় মাস পরেই আকস্মিকভাবে তার জীবনের ইতি ঘটে।তার প্রিয়তমা স্ত্রী হাসিনা বানু এতদিন যে আশা খুঁজেছিল তার বুকের ভেতরে আজ সে পাথরের মূর্তির মতো হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে।তার নির্ভরতা ও আশ্রয় আজ কোথায়? গল্পকার সুকৌশলে গল্পের শেষে তার নির্ভরতা ও আশ্রয়ের সমাধান দিয়েছেন এভাবে-
আমাকে দেখে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন, আমি তো বহু আগেই জানতাম ওর কি হয়েছে।তবু কেন আমার কাছে লুকোল। ও জানতো, ওকে আমি বাঁচাতে পারি না। তবু কেন ও বিশ্বাস করল ওকে ছাড়াও আমি বাঁচতে পারি। আর তাই আমাকে বাঁচাতে… কথা শেষ হল না। হাসিনা আমার দু’হাত একত্র করে মুখে চাপা দিয়ে ভেঙে পড়লেন।চোখের পানিতে আমার হাত ভিজে গেল।তার এতদিনের কান্নার অর্থও আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল।হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে যে বেদনার উপলব্ধি, তার সান্ত্বনা কোথায়।এখন তাঁর সমস্ত নির্ভরতা এই হাত দু’টির উপর।
সর্বোপরি, গল্পটি মানবজীবনের জীবন- জটিলতার বাস্তব আলেখ্য। শুধু সে সময়েই নয়, আজও আমাদের সমাজে অহরহ ঘটে যাচ্ছে এ ধরনের বাস্তব ঘটনা।যা আমাদের চারপাশের জীবনধারার সঙ্গে একিভূত হয় বৈকি।