বিধান সাহার গদ্য পড়েছিলাম প্রথমে মুখবইয়ে।বইমেলা ২০২২ চলাকালীন লেখকের পোস্টে অবগত হই তার গদ্যের বই ‘এসো বটগাছ’ নিয়ে।বইটির ভূমিকা পড়েই খুব আগ্রহী হয়ে উঠি।তারপর ধীরে ধীরে ডুবতে থাকি এক শৈল্পিক চোরাবালিতে।বইটিতে লেখক মোট সতেরটি গদ্য সন্নিবেশ করেছেন।অধিকাংশ গদ্যই তিনি উত্তীর্ণ করেছেন অনন্য শৈল্পিক মাত্রায়।কিছু গদ্যের চুম্বক অংশ তুলে দিচ্ছি।
১. সূর্য পোড়া দিনে: ইছামতীর কোনো এক শাখা নদীর তীরে একটা উঁচু ঢিবির ওপর একটা একলা শিমুল গাছ।নদী আর শিমুল গাছের হৃদয় বৃত্তিক যোগাযোগ বোঝাতে লেখক লিখেছেন-‘নদীটির ঢেউ ছাড়া কেউ নেই। শিমুলেরও পাতা ছাড়া কেউ নেই।নদীটি অধ্যাপক শিমুল তার বাধ্যগত ছাত্র।’
আমার মানসপটে ভেসে ওঠে অই একলা শিমুল গাছ আর আর নদীটির ঢেউ।কখনো ঢেউ হতে ইচ্ছে করে আবার কখনো বা শিমুল গাছ।
২. এসো বটগাছ: ‘নিজেকে বলেছি, একান্নটি তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে আজ কান্না পর্ব শেষ হয়ে যাবে।অথবা, চরাঞ্চলে, কোনো এক অন্ধ বৃদ্ধার ঝুলে যাওয়া স্তন স্পর্শ করবে আধবয়সী অজগর।এইসব রূপকথার চারপাশে, জানো না তো কত উর্বশীর ঈর্ষা বয়ে যায়!’
একান্নটি তোপধ্বনি, আধাবয়সী অজগর আর বৃদ্ধার ঝুলে যাওয়া স্তন এসবকিছুই যেন সমগ্র জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দেয়।
৩. বিশ্বাসে মিলায় বস্তু: ‘ভাবছি, কোনো এক কমরেডকে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করব শ্রেণিবৈষম্য কী শুধু অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়? চেতনার নয়?’
লেখকের গভীর মনস্তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসায় আমিও নিমজ্জিত হই ভাবনার অতলে।
৪. প্রজাপতি ও অন্যান্য আগুন: ‘তুমি জানো না সমস্ত গল্পের শেষে যেখানে একটা শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানে প্রতিটি মানুষই এক-একটি সাদা বক’
কিছু পরে -‘দূর তো শুধু দূর নয়, আরও বেশি করে কাছে থাকার ছদ্মবেশ।’
আরও কিছু পরে-আমার বিষন্নতার ভেতর-প্রজাপতি-তোমার পাপড়ি দিয়ো মেলে…
আমিও হাঁটু গেড়ে করজোড়ে মহাকালকে মিনতি করি-আমার বিষণ্নতাকে হরেক ডানার রঙিন প্রজাপতি করে দিও।
৫. তুলসীগঙ্গা: ‘কেবল জানি, উপযুক্ত বয়সে বৃষ্টির ভেতর হেঁটে যাওয়ার সময়ই কান্না করা ভালো’
কিছু পরে- ‘আমার কোনো প্রযত্ন নাই।অনামী প্রান্তর থেকে তাই আলোকিত আকাশ দেখলেই ডেকে বলি-শশী-ওগো শশধর.. ’
আমার সামনে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে আমারও প্রযত্ন কেবল-অসীম আকাশ।
৬. অব্যক্ত সন্ধির দিকে: ‘কবিতা হলো ব্রহ্মতেজকে ধারণ করে, আরও এক বিপন্নতার দিকে তাকিয়ে, একা একা হেঁটে যাওয়া-অব্যক্ত সন্ধির দিকে।’
মানুষের জীবন আর কবিতা পুরোটাই একলা যাত্রা অব্যক্ত সন্ধির দিকে। সেই হেঁটে যাওয়া কোমল হোক সকল কবির।
লেখক গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছেন-‘এ এক ধরনের রচনা কারো কাছে কবিতা, কারো কাছে গল্প, কারো কাছে হয়তো ব্যক্তিগত গদ্য।’
‘মায়ের মৃত্যু, প্রেমিকার রহস্যময় নীরবতা, নিজেকে হারিয়ে খোঁজা, নিঃসঙ্গতা.. এগুলোই হয়তো লেখাগুলোর প্রাণ’
একজন মননশীল পাঠক হিসেবে আমি বলব ব্যক্তিগত গদ্য হলেও এর সার্বজনীনতা কোনোভাবেই বিনষ্ট হয়নি।শৈশব, মৃত্যু, জীবন বোধ, বহমান জীবনের গতিশীল স্রোতধারার শৈল্পিক সৌন্দর্য লেগে আছে গদ্যগুলোর পরতে পরতে।যেমন মৃত্যু নিয়ে লেখক বলেছেন-মৃত্যু আসলে এক পঙক্তির সলিড কবিতা।
‘কত অকারণ সংকোচ ঝেড়ে ফেলে আমিও পুনর্জীবন লাভ করি! তোমার সাথে যদি দেখা হয়, শোনাব, স্তব্ধতার গান,আর ভেতরে ভেতরে বয়ে যাওয়া বিপন্ন নদীটির কথা।’
নিমজ্জন আর জীবন বোধের সততা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শিল্পের সততার মুখোমুখি এবং আমি ভেতরে ভেতরে শুনতে পাই সেই বিপন্ন নদীটির ঢেউয়ের ছন্দ আর তার চলার নিজস্ব ব্যকরণ।
লেখক বিধান সাহা গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন-এই বটগাছ হয়তো মা, হয়তো প্রেমিকা, হয়তো বা পাঠক। আর আমি পাঠক হিসেবে বলি-এই বটগাছ শিল্প-সাহিত্য নিজে।যে চারা বটগাছটি রোপিত হয়েছে তা একদিন মহীরুহ হোক।আর বিশাল ছায়ায় জুড়াবে পাঠকের অতৃপ্ত, তৃষ্ণার্ত মনন আর হৃদয়।লেখক বিধান সাহাকে অপার ভালোবাসা এবং শুভকামনা।