আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ছোটগল্প (পর্ব-৪) ॥ রকিবুল হাসান


‘দুই শরিক’ গল্পের বিষয়বস্তু একেবারেই আমাদের চেনা-জানা।বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনচিত্র, স্ত্রীদের বংশ-অহমিকা, সম্পদের প্রতি লোভ-লালসা, স্ত্রীর পরামর্শ-প্ররোচনায় ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার, সহজ-সরল উপায়ে শঠতাবাণিজ্য- এ গল্পের উপজীব্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।গ্রামীণ সমাজে পরিবারে বহুকাল আগে থেকেই এসব সমস্যা চলে আসছে।এখনো আছে।শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ঘটলেও সমাজচক্ষুর আড়ালে কখনো প্রত্যক্ষভাবেই এসব সমস্যা বিরাজিত।গল্পটির বিষয়বস্তুতে কোনো নতুনত্ব না থাকলেও লেখকের ভাষা আর উপস্থাপনা শৈলীগুণে গল্পটি পাঠকের মনোযোগ কাড়ে।

লেখকের আর একটি কৃতিত্ব হলো গল্পটি ইয়াসিন ও ইউসুফ এই দুই সহোদর অর্থাৎএকটি পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা একটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।একটা বৃহৎ সমাজ ব্যবস্থাকে আকরভাবে ধারণ করার চেষ্টা লক্ষ করা যায়, সে সঙ্গে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত সমস্যাগুলোকে তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন।আবার এভাবেও বলা যায়, গল্পটিতে একটি সময়কে ধারণ করা হয়েছে- যে সময়ে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা, নিজস্ব প্রভাব ও ক্ষমতাগিরি দেখানোর যে অসুস্থ মানসিকতা তৈরি হয়েছিল সেটিই মূলত ‘দুই শরিক’ গল্পটির মূল বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে।

‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রেমের গল্প।সহেলি আর রিজভির প্রেমকে কেন্দ্র করে ‘কৃষ্ণপক্ষ’ গল্পের কাহিনি তৈরি হলেও প্রয়োজনে আরো অনেক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে।সেহেলি ও রিজভি একে অপরকে ভালোবাসলেও বাস্তবে দুজনের কেউই কাউকে পায়নি।সেহেলির বিয়ে হয়েছে মমতাজ নামক এক যুবকের সঙ্গে।রিজভি বিয়ে করেছে মুশতারিকে।কিন্তু জীবন চলার পথে সেহেলি স্বামীকে হারিয়েছে,রিজভি হারিয়েছে স্ত্রীকে।অর্থাৎ জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে মধ্য বয়সে এসে দুজনেই আবারা একা।সেহেলি একটি স্কুলের শিক্ষক।স্কুলটি করুণানগর টিলার উপর মোহনীয় অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় এক পরিবেশে অবস্থিত। চমৎকার এই পরিবেশে বহুদিন পর দুজনের দেখা হয়।দুজনই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে।কিন্তু বিপত্তি ঘটায় মমতাজের ছবি।বেগম সুরতুন্নেসা ফখর বানুর জীবনের সঙ্গে যেন নিজের জীবনের কোথাও একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায় সেহেলি।ফখর বানু ক্লিওপেট্রা ক্যাসলের সম্রাজ্ঞী ছিলেন।

আধুনিকতাকে ধারণ করে তিনি গড়ে উঠেছিলেন।বিয়ে করেছিলেন করুণানগর এস্টেটের জমিদার সেকান্দার খানকে।বিয়ের পর যখন তিনি বুঝলেন স্বামীর চিন্তাভাবনা ও রুচির সঙ্গে তাঁর কোনো মিল নেই। তিনি তখন এস্টেটের তরুণ ম্যানেজারের প্রতি অনুরক্ত হন। সেকান্দার খান স্ত্রীর এ বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং আকস্মিকভাবে তিনি মারা যান।স্বামীর মৃত্যুর পর ফখর বানুর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তরুণ ম্যানেজারকে বিতাড়িত করেন।স্বামীর নামে স্কুল-লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে থাকেন এবং এক সময় তিনি আত্মহত্যা করেন।সেহেলি ট্রাজিক এ কাহিনি রিজভিকে শোনায়।রেস্ট হাউসের একটা রুমে শোভাবর্ধন করছে একটি গ্রীক ভাস্কর্য।শরীরে সুশোভিত একটি বাঙালি মেয়েল তৈলচিত্র।নিচে নাম লেখা : বেগম সুরাতুন্নেসা ফখর বানু। ট্রাজিক এ কাহিনির প্রসঙ্গ এখান থেকেই ওঠে।ফখর বানুর জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পায় সেহেলি।ফখর বানু দাম্পত্যজীবনে সুখী ছিলেন না।

সেহেলির দাম্পত্য জীবনও তাই-ই। মমতাজ তাকে ভালোবাসলেও সেহেলি তাকে ভালোবাসতে পারেনি।এর কারণ হয়তো বিবাহের পর সে রিজভিকে ভুলতে পারেনি।রিজভিকে সে সবসময় ভেবেছে।সে কারণে রিজভিকে একান্ত করে পাবার জন্য পারিবারিক সব ঝামেলামুক্ত হয়ে নিজেকে যখন তৈরি করে সেহেলি- তখন মমতাজের ফটোর দিকে তাকিয়ে মেঘমেদুর সন্ধ্যায় ঘণীভূত অন্ধকারে রিজভির মুখ স্পষ্ট ঠাহর করতে পারে না।ফলে তাদের মিলন সম্ভাবনা পূর্ণবার তৈরি হলেও তা সফল হয়নি।সে কারণে ফখর বানুর প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভূত হয়।রিজভিকে ফখর বানুর জীবন কাহিনি শোনানো থেকেও এর সত্যতা অনুধাবনযোগ্য।সেহেলি ও রিজভির কাহিনির মূলস্রোতে ফখর বানু সংযোজিত হয়ে কাহিনির গতিকে ও বিষয়বস্তুকে আরো অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণতা দান করেছে। ব্যর্থ প্রেমের একটি গল্প হিসেবেই ‘কৃষ্ণপক্ষ’কে চিহ্নিত করা যায়।

কুলিদের বেদনার্ত জীবনচিত্র ‘বৃত্ত’ গল্পটির মূল উপজীব্য।গল্পটিতে কুলিরা অমানবিক পরিশ্রম করে যা আয় করে তার একটা মোটা অংশ কুলি সর্দারের জন্য জমা বরাদ্দ থাকে।অথচ কুলি সর্দার সাধারণ কুলিদের কোনো সহযোগিতা করে না, কোনো সহানুভূতিও দেখায় না। বরং তাদের উপর যখন তখন অত্যাচারের স্টিম রোলার চালায়। কুলিদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র গল্পটিতে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন লেখক।গল্পের নায়ক পাঁচুর যে জীবনচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে- তা শুধু একজন পাঁচুর জীবনচিত্র নয়, সব কুলিদেরই জীবনচিত্রের প্রতীকি চিত্র হয়ে উঠেছে।সর্দারের অত্যাচারে পাঁচুর ভেতর যে ক্ষুব্ধতা, সংগ্রাম, বিদ্রোহ, প্রতিশোধপরায়ণতা জন্ম নেয়- তা শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রামেরই চিরায়ত রক্তাক্ত আর্তচিৎকার।পাঁচুর ক্ষেত্রে সে চিৎকার তার বুকের ভেতর আর্তনাদ করে আছড়ে মরে, রক্তাক্ত হয়, কিন্তু বাস্তবে সে কিছুই করতে পারে না।

‘বৃত্ত’ গল্পটিতে কুলিদের দৈনন্দিন জীবনচিত্রই মূল বিষয় হিসেবে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে।তবে শ্রেণি-বৈষম্য বা শ্রেণি দ্বন্দ্ব- এ গল্পের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।