৪. হিম হিম আইসক্রিম দিন
সেই কখন থেকে রোদের খেলা দেখছি।বুড়ো কড়ই গাছের পাতার ঝালর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে…ঝলমল ঝলমল, ঝিলমিল ঝিলমিল সোনালি রোদ্দুর। রোদকে রোদ্দুর ভাবলে কেমন একটা আদর আদর ওম লাগে। অমন ওম ওম রোদের পরশ নিতে নিতে দুচোখ বুঁজে আসে।তখনই ঝট করে মা ডেকে ওঠেন, ‘অবেলায় ঘুমাইস না…।’
এই ভরদুপুরে এত দূরে মা কোথা থেকে এলো, ভেবে চমকে উঠি।আমার কাছ থেকে প্রায় তিনশ বারো কিলোমিটার দূরে থাকে মা।আসলে দূরে থেকেও কাছে থাকে।বার বার মনে করিয়ে দেয়,‘অফিসের কাজে অমনোযোগী হইস না।ভুলভাল সাইন করবি, তখন বিপদ হইব।তোর বাবারও একবার বিপদ হইছিল।’
বিপদের নাম শুনে নড়েচড়ে বসি।আমার মা এখনও আমার বিপত্তারিণী।বিপদকে নাশ করতে যেই মানুষটি বার বার উচ্চারণ করেন, ‘না।’
আমার তো মনে হয় কমবেশি আমাদের সবার মা-ই জীবনে সবচেয়ে বেশি বার যে শব্দটি উচ্চারণ করেন, করেছেন সেটি হলো, ‘না।’
সত্যি বলছি, আমার মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত ন আকারে ‘না’ শব্দটি হিসাব করার জন্য জগতের সব ক্যালকুলেটরকে একসঙ্গে সক্রিয় করলে সব যন্ত্রই একসঙ্গে বিকল হয়ে যেত।
এই যে এখন চুলে পাক ধরেছে, নিজেই বাচ্চার মা হয়েছি তবু মায়ের মুখের ‘না’ শব্দের সম্প্রচার বন্ধ হয়নি।বিটিভির সেই রাত আটটার বাংলা সংবাদের মতো মা আজও নিয়ম করে বলে, ‘অতো বেশি মোবাইল দেখিস না, কম্পিউটারের সামনে বেশিক্ষণ থাকিস না…অতো ঘোরাঘুরি করিস না।’
নথিপত্র, ল্যাপটপ গুটাতে গুটাতে বাড়ি ফিরি।পথে পথে সুখদৃশ্য দেখি।
নিভন্ত রোদের আমেজে বাবা-মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে একটা বালক, বাবাকে সে এটা-সেটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।সতর্ক বাবা জেব্রা ক্রসিং ক্রস করার আগেই বালককে বুকে তুলে নিয়েছেন।মা উষ্ণ কণ্ঠে বলছেন, ‘বাবার কোল থেকে নামো।এত বড় ছেলে কোলে ওঠে না।বাবার কষ্ট হয়।’ মায়ের বারণ শুনেও শোনে না বালক। নরম হাতে আরও শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে, আর মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাসে।যেন আইসক্রিমের বায়না পূরণ হলেই কোল থেকে নামবে।
আইসক্রিম!
মনে পড়ে যায়, ঐ বয়সটাতে কালেভদ্রে আইসক্রিম জুটতো।সেই আইসক্রিম আদতে ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা জমাট বরফের আয়তাকার টুকরো। মাঝে মধ্যে আইসক্রিমের ডগায় নারকেলের গুঁড়ো লাগানো থাকতো। শুনতাম ঐসব সস্তার আইসক্রিমে স্যাকারিন দেয়।চিনি আর স্যাকারিনের পার্থক্য বুঝতাম ছাই।হিম হিম কিছু খাচ্ছি সেই তো অনেক।
স্কুলগেট আর বাসার সামনে আসা ফেরিওয়ালারার বাকশের কুলফির স্বাদও নিয়েছি।এর অনেক অনেক পরে চেখে দেখেছি জিভ-ঠোঁট রাঙানো ললি আর দোকানে বিস্কুটের খোপে ঢুকানো পাহাড়ের চুড়োর মতো গোলাপি, সাদা কোন আইসক্রিম।
আইসক্রিমের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় রোজার দিনের বরফের কথা।তখন পাড়া-মহল্লার দোকানে টুকরো বরফ বিক্রি হতো।বিশাল আকৃতির বরফের চাঁই থেকে ভেঙে টুকরো করে বরফ বিক্রি করতো দোকানদার।রোজার ঈদের দিন কয়েক আগে নানা বাড়িতে যাওয়া হলে আনন্দের সীমা থাকতো না।দোকান থেকে বাটিভর্তি বরফ নিয়ে পিঠাপিঠি মামা-খালাদের সঙ্গে দিতাম ছুট।ঐ বরফ আরও টুকরো টুকরো করে ইফতারের আগে আগে শরবতে দেওয়া হতো।রোজা রাখলে শরবত জুটতো ভাগ্যে।নয়তো আবদারের পর পেতাম এক আধটুকরো বরফ।সে ছিল এক মজাদার চকলেট।ধীরে ধীরে চুষে খেতাম সেই ঠান্ডা চকলেট।ঠোঁট-জিভ ঠান্ডায় লাল হয়ে যেতো, আর তা দেখে আমাদের সে কি হাসি!
আজকাল ক্রনিক ব্রংকাইটিসটা ভোগাচ্ছে বেশ, হিম ঠান্ডা কিছু খেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ডাক্তার।ওবিসিটি কারণে-অকারণে বেকায়দায় ফেলায় চড়চড়ে রোদের দিনের ইফতারিতে চিনি গোলা শরবত আর ঠান্ডা পানীয় গ্রহণেও বাড়তি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
মাঝে মাঝে তবু সব সতর্কতা ভুলে যাই, ফ্রিজের ঠান্ডা পানিতে বানানো ট্যাং-লেবুর শরবতে মিথ্যেমিথ্যি ছোটবেলার সেই আত্মা জুড়ানো শান্তিটা খুঁজি।
পরের পর্ব পড়ুন : নারী হয়ে ওঠার দিনে