মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-১) ॥ আরিফুর রহমান


পেইন্টিং সংগৃহীত

পাখি, অ্যাই পাখি!
উঁম, বলো।
দেখ, আকাশজুড়ে মেঘ জমেছে, তোমার মন খারাপের মতো! যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।দেখবে এসো।ওয়াও!
আ! আ! ফাঁকি দিয়ো না তো।আরেকটু ঘুমুতে দাও।
আরে সত্যি বলছি, আকাশভরা মেঘ।মেঘ জমেছে থোকায় থোকায়…।

একপলকে চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল মনা’র।আর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে থমকে গেল! বুঝল, এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল।শুনল, ফোনের রিংটোন বাজছে,‘মেঘ জমেছে থোকায় থোকায়.’!সেই না দেখা মানুষটির কল, যে স্বপ্নে তাকে পাখি বলে ডাকছিল!
হ্যালো, গুডমর্নিং।মনা বলল।
হুম, শুভ সকাল।ঘুম ভাঙল?
এই তো আপনার ফোন পেয়েই।
আচ্ছা।তোমার মন ভালো? সকাল সকাল আজ আকাশের খুব মনখারাপ।কালো মেঘে ভরে গেছে।যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
সে তো আপনি স্বপ্নেই আমাকে বলেছেন।বিড়বিড় করল মনা।
কী বললে? হ্যালো, আমি ঠিক শুনতে পাইনি।
হ্যালো।
না, কিছু না।আপনি অফিসে যাচ্ছেন? এতো শব্দ! অনেক বাতাস বইছে, না?
হ্যাঁ, এলোমেলো বাতাস।মেঘ ওড়ানো, মেঘ ঘুরানো বাতাস।তুমি বারান্দায় যাও, আকাশ দেখ।এমন আকাশ তো তোমার খুব পছন্দ। আমি রাখছি।

মনা আগেই বারান্দায় চলে এসেছে।মেঘেদের উড়াউড়ি দেখছে।বাউরি বাতাসের স্পর্শ পাচ্ছে।পাচ্ছে আত্মমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার দারুণ সুযোগ।মেঘেদের দখলে থাকা এমন আকাশ এবং এমন এলোমেলো বাতাস তার নিজের ভেতর বিভোর হয়ে থাকবার প্রধান উপকরণ। আরও একটি উপকরণ যোগ হয়েছে, বাস্তবে না দেখা স্বপ্নের ওই মানুষটা। অবশ্য স্বপ্নেও সে লোকটাকে পুরোপুরি দেখেনি।কখনো দেখেছে পেছন দিকটা, আবার কখনো একপাশ থেকে।তাই আজও লোকটার পরিপূর্ণ ছবি সে তার মনের ক্যানভাসে এঁকে নিতে পারেনি! তাই তো মানুষটির মুখ পরিপূর্ণভাবে দেখবার দুর্দমনীয় ইচ্ছে তার; তা সেটা স্বপ্নে হোক কিংবা বাস্তবে।এই ব্যাকুলতা ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে ভীষণ রকম-মনে, এমনকি শরীরেও!

প্রতিবার কথা শেষে ফোন রাখলে কিংবা স্বপ্নে মানুষটাকে দেখে ঘুম ভেঙে গেলে সে খুব দুর্বল অনুভব করে।কেমন যেন বিবশ হয়ে থাকে, অনেকক্ষণ।

মনা মানে ময়না খানম, যদিও ময়না নামটি নিয়ে ওর খুব আপত্তি আছে!এমন একটি ব্যাকডেটেড নাম রাখবার জন্য সে তার দাদুকে কোনোদিন ক্ষমা করেনি।অবশ্য বছর দুয়েক আগে ওপারে চলে গিয়ে মানুষটা ওর মনের কাঠিন্য কিছুটা নরোম-কোমল করে গেছে! ফলে এখন তবু সে তার আসল নামটি প্রয়োজনে উচ্চারণ করে।তা-না হলে এতদিন ওই নামটি কেবল কাগজে-কলমেই ছিল!

মনা এমবিএ করবার জন্য যেদিন এই শহরে পা রেখেছিল সেদিনই মানুষটি প্রথমবার কল দিয়েছিল।শেষ বিকেলে।তখন পশ্চিমাকাশ লালচে আলোয় মুখ রাঙিয়ে হাসছিল।ও মাত্রই মোড়ের রিচার্জ পয়েন্ট থেকে ফিরে তার নতুন ঠিকানা ‘খুশির নীড়’-এ ঢুকেছে।দুতলার সিঁড়ির মুখেই ফোনটা বেজে উঠল।স্ক্রিনে অচেনা নম্বর দেখে রিসিভ না করে ওপরে উঠে গেল মনা।

দ্বিতীয়তলার শেষ রুমটা ওর।অবশ্য অন্য একজনের সাথে শেয়ার করতে হবে।ওর রুমমেট তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।মনা রুমে ঢুকতেই আবার সেই কল।ও বারান্দায় চলে এল।পশ্চিমমুখী বারান্দায় এসে দেখল, সূর্য বাবু আবির মেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে!
হ্যালো, কে বলছেন? প্লিজ!
যাক, মার্জিতভাব আছে।অনেকেই তো শুধু বলে ‘কে?’ আবার অনেকে বলে ‘কে বলছেন?’ এটা তবু চলে, কিন্তু আগেরটা, উহ্!
এসব কথার অর্থ কী? প্লিজ বলুন কে আপনি, নয়তো আমি ফোন রাখব।
আমি কে তারচেয়ে বড়ো কথা হল তুমি এই মুহূর্তের পশ্চিমাকাশ দেখেছ? কী দারুণ…!
জি জনাব, আমি এই মুহূর্তে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশই দেখছি।ওর রূপে আমি মুগ্ধ! কিন্তু আপনার রূপ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না, তাই দয়া করে পরিচয় দিলে সুবিধা হয়।

মনা কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করল।কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটা তেমনই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,পুরুষ মানুষের রূপ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার ব্যক্তিত্বটাই আসল।
এবার মনা রেগে গেল, তার মানে নারী রূপ সর্বস্ব? তার গুণ, তার ব্যক্তিত্ব…!
তুমি রেগে যাচ্ছ, প্লিজ, আমি কিন্তু এসব মিন করে কথাটা বলিনি। আসলে আমার মতে, পুরুষ ব্যক্তিত্বে ও কর্মে ঐশ্বর্যবান এবং নারী রূপে ও গুণে মাধুর্যময়ী।আর যোগ্যতা উভয়কেই আত্মবিশ্বাসী করে তুলে।
হুম।আচ্ছা, আমি কি আপনাকে চিনি ?
কোথা থেকে শুরু করি, কোথা থেকে শুরু করি, আচ্ছা পেয়েছি।যদি আদম হাওয়া’র দিক থেকে বলি তাহলে মানবজাতির সবাই সবার পরিচিত।আরেকটু পরের দিকে এসে, ইব্রাহিম (আ.) এর দিক থেকে বললেও আমরা বর্তমানের সবাই সবার পরিচিত।আর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও নবী তো বলেই দিয়েছেন….।
আপনি জানেন আমি হিন্দু না মুসলিম?
ধর্ম বুঝা যায় ধারণে এবং যাপনে, তো কে কোন ধর্ম ধারণ করে কিংবা যাপন করে তা টের পাওয়া কষ্টকর নয়।
তখনই, মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিনের ফুঁ ও কাশির শব্দ হলে ফোনের অপরপ্রান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবার শব্দ শুনল মনা।তড়িঘড়ি করে মানুষটা বলল, এখন রাখি পরে কথা হবে!

কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা দ্বিধা এবং অবিশ্বাস মিলে ওই অচেনা মানুষটাকে কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে মনা’র।এড়িয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না, আবার জড়াতেও অস্বস্তি হচ্ছে।

রাত একটু নিরবতার দিকে এগোলে আবারও কল দিয়েছিল মানুষটা।দোটানায় থেকেও মনা’র বাম হাতের বুড়ো আঙুলটা ওর অজান্তেই চলে গেছিল মোবাইলের সবুজ বোতামটায়।মনা বলেছিল, এবার কিন্তু আপনি আগে পরিচয় দেবেন তারপর কথা বলব। বলুন না, আপনি কে? প্লিজ, প্লিজ!
বলেই চমকে উঠেছিল মনা, সে এভাবে কথা বলছে কেন? কেমন যেন স্বপ্নাবিষ্টের মতো!
অপরপ্রান্তের মানুষটা খুব মায়াভরা কণ্ঠে বলেছিল, আমি পূরণ।আমায় বিশ্বাস করতে পার।
আমি অবিশ্বাসের কথা বলছি না, বলছি স্বস্তির কথা।অচেনা মানুষের সাথে কথা বলতে আমার খুব অস্বস্তি হয়।তাই তো আপনাকে চিনে নিতে চাইছি।

আবারও চমকাল মনা!মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল, চিনে নিতে চাইছি মানে কী? আমি কথা বলতে চাই? উফ্!এভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি কেন?
কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে প্রশ্ন করল, আপনি শুধু পূরণ, আগে-পিছে কিছু নেই?
চলবে..