পর্ব-২
আমি আরফাতুল ইসলাম পূরণ।..যদি কখনো মনে হয়, কোনোভাবে তোমার ক্ষতি হচ্ছে তাহলে বলো আমি আর ফোন দিব না।প্রমিজ।
ওকে।এবার বলুন, আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলেন? মোড়ের রিচার্জ পয়েন্ট থেকে নিয়েছেন?
কোন মোড়ের কথা বলছ? শাহবাগ নাকি বাংলামোটর? নাকি, ময়মনসিংহের চরপাড়া মোড়ের কথা বলছ? জামালপুরের দয়াময়ী নাকি বকুলতলা ?
আপনি কোন শহরের? এই শহরের নন ?
হা হা হা! মজা করছিলাম।এই শহরেরই।আচ্ছা, এই শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কোনটি? যে যা-ই বলুক, আমি বলব, এই শহরে বিখ্যাত একটি মন্দির ও শাহী জামে মসজিদ পরস্পরের প্রতিবেশী! এমনটা তুমি সব শহরে দেখতে পাবে না।
হুম।এছাড়া আর বিশেষ কোনো স্থাপনা নেই?
আছে তো, বুড়িমার দোকান, মাজার শরীফ।তুমি কি জানো, আজিজ মাস্টার চত্বর থেকে পূর্বদিকে যাবার জন্য যে ব্রিজটা আছে, যার ওপারে এখন আর গ্রামটি নেই-ব্রহ্মপুত্র গিলে ফেলেছে-ঠিক তেমনই একটি ব্রিজের ছবি বিশ্ব পরিচয় বইয়ে স্থান পেয়েছে?
এমনই হাজার ধরনের তথ্য, এই শহর, এই দেশ কিংবা বিশ্ব সম্পর্কিত, মনা জেনেছে পূরণের কাছ থেকে।ও জানত না যে, চাঁদে কোনো বস্তুর ওজন পৃথিবীতে ঐ বস্তুর ওজনের ছয় ভাগের একভাগ! অক্সিজেন গ্রীনহাউজ গ্যাস নয়! Gastric Juice নামে এক ধরনের জুস আছে যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্রিয়ার প্রাথমিক স্তরের অংশ।বৈষ্ণব পদাবলীতে শৃঙ্গার রস-কে মধুর রস বলা হয়েছে।
মনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশভরা কালো মেঘ দেখতে দেখতে পূরণের সাথে পরিচয়ের পর দিনে দিনে জমা হওয়া স্মৃতিগুলো রোমন্থন করছিল। হয়ত ওভাবেই ওর আরও অনেকটা সময় কেটে যেত, কারণ বেশখানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে মেঘ যেমন থেকে থেকে আকাশকে আচ্ছন্ন করে রাখে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে তেমনি পূরণও কাছে না এসে, দেখা না দিয়ে, কেবল ফোনেই ওর হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে দেয় মোহন সৌন্দর্য! আর তাতে করে মনা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
বুয়া এসে দরজায় শব্দ করলে ও স্মৃতির পথ থেকে ফিরে আসে বর্তমানে।
ও খালা, তুমি এহনো ঘুমাইতাছ! আকাশ ভাইঙ্গা বিষ্টি আইল, ওঠো।
নিচতলায় দুটো পরিবার ভাড়া থাকে, বুয়া দুবেলা তাদের নানান কাজকর্ম করে দেয়।ওই দুই পরিবারের সকালের কাজ ন-টার মধ্যে সেরে মোড়ের হোটেল থেকে মনার জন্য রুটি আর ডালভাজি কিংবা অমলেট এনে দেয় বুয়া।মনা হিসাব করে অন্তত এক সপ্তাহের নাস্তার টাকা তার কাছে দিয়ে রাখে।
দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, আমি আগেই উঠেছি খালা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
অ।দুপরের জইন্য কী রানব কও।আইজ মনে হয় কোরচিনে যাইতে পারবা না, বিষ্টি আইল বলে।
না খালা, বৃষ্টি আসবে না।মেঘ পশ্চিমে সরে গেছে।আমাদের বাড়ির দিকটায় বৃষ্টি হবে।বাড়ির উঠোনে আমার লাগানো গাছগুলোতে বজ্জাত ভাইটা তিনদিন ধরে পানি দেয়নি।মেঘ সেগুলোতে পানি দিবে।
বুয়া অবাক হয়ে বলল, তুমি এমন ক্যান গো খালা? আজব আজব কতা কও, আজব আজব ছবি আঁক!
কোথায়? আচ্ছা, তুমি দুপুরের রান্না শুরু করো। সময় কম, কোচিং-এ যেতে হবে।
বুয়া দেখল জানালায় রোদ চিকচিক করছে!
এখন রুমটাতে মনা একাই থাকে।ওর রুমমেট চলে যাবার পর ও আর কাউকে সাথে নেয়নি।বাসার মালিককে বলেছিল সে একাই দুজনের ভাড়া দিয়ে থাকতে চায়।কিন্তু উপযোগ খরচ সে একজনেরই দেবে। যেহেতু গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সে একা ব্যবহার করবে।
বাসার মালিক সোহরাব হোসেন সাহেব আপত্তি করেননি।তিনি মনাকে খুব স্নেহ করেন।সংস্কৃতি সচেতন মানুষ, মনা ছবি আঁকে জেনে খুব খুশি হয়েছেন।একদিন দেখতে এসে ভুয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, আমার ড্রয়িংরুমে তোমার আঁকা একটা ছবি থাকা চাই মনা।
মনা একাধিক ছবি এঁকে দিয়েছে।সোহরাব হোসেন সাহেব সেগুলো খুব যত্ন করে টাঙিয়ে রেখেছেন ড্রয়িংরুমে।সুযোগ পেলেই বাসায় আগত অতিথিদেরকে বলতে শোনা যায়, এই ছবিগুলো আমার বাসার দোতলায় থাকে এক মেয়ে, নাম মনা, ওর আঁকা।খুবই ভালো মেয়ে, ছবি আঁকার হাতও দারুণ! দেখবেন ও একদিন খুব বড় চিত্রশিল্পী হবে।
মনা নাস্তা খেতে বসলে বুয়া ওর জন্য দুপুরের রান্না করে দিয়ে যায়।ও বেরিয়ে যায় দশটার মিনিট দশেক আগে।এমবিএ ভর্তির কিছুদিন পরই মনা একটা বিসিএস প্রস্তুতি কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে।সেটার দ্বিতীয় ব্যাচের ক্লাস চলে সকাল দশটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত।আর কলেজে এমবিএ-র ক্লাস শুরু হয় দুপুর সাড়ে বারোটায়।
কোচিং-এ ভর্তি হতে পূরণ-ই খুব চাপ দিয়েছিল মনাকে।যদিও মনা জানে তার দ্বারা এসব কিচ্ছু হবে না।কিন্তু পূরণের যুক্তি, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও অর্জিত জ্ঞান জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজে লাগবে। তাছাড়া বাড়ি থেকেও মনাকে খুব করে বলা হয়েছে জব প্রাপ্তির জন্য প্রিপারেশন নিতে।কিন্তু ওর প্রবল ঝোঁক ছবি আঁকায়।অবশ্য এই পোড়া দেশে ওতে ক্যারিয়ার তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।
পূরণের সাথে কথা বলবার বেশ কিছুদিন পরে, ততদিনে মনা পূরণকে তুমি করে বলে, একবার জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি আসলে কে? কী করো? কিছুই তো বল না। শুধু শুধু আমার পিছে সময় নষ্ট করছ, আর আমাকে মায়ায় জড়াচ্ছ।
মানুষের সবকিছুতেই মায়া।যাক সেসব।মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে কথা বলে সন্তুষ্ট নও।কেন জানতে পারি?
না, সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির কথা নয়।দেখ আমরা দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘক্ষণ কথা বলি, অথচ আমি তোমার নামটুকুই শুধু জানি আর বিশ্বাস করি তুমি খুব ভালো মনের একজন মানুষ।তবু বাকি সব জানতে ইচ্ছে করে না বল?
হুম, রাইট।আসলে আমি মধ্যবিত্ত বাবার নিম্নমধ্যবিত্ত এক ছেলে! ছোটোখাটো একটা চাকরি করি।অবশ্য সরকারি চাকরি।তাতে চলে যায় ভালোই।
আর আমি মধ্যবিত্ত বাবার বিত্তহীন মেয়ে! খুব চেষ্টা করছি একটা চাকরি জোগাড় করতে।
মেয়েদের বিত্ত বড়ো কথা নয়, গুণ বড়ো কথা।তোমার গুণ আছে।
গুণ আর আমি, একসাথে? আল্লাহ আল্লাহ! আমার কোনো গুণ নেই।
তুমি খুব গোছানো, তুমি মেধাবী, তুমি অপরূপা!
আমি গোছানো ঠিক আছে, মনে হয় কিছুটা সুন্দরী তাই মেনে নিলাম, কিন্তু আমি মোটেও মেধাবী নই।
সবারই মেধা আছে, সেটা বুঝা যায় প্রয়োগের ওপরে।তুমি তোমার মেধা ব্যবহার কর দেখবে সব পারবে।
আন্ডা! এই যে বিসিএস কোচিং করছি, আমি বাংলা, ইংরেজিতে ভালো কিন্তু সমস্যা হল সাধারণ জ্ঞান আর অংকের মানসিক দক্ষতা অংশে।
চেষ্টা কর, বারবার দেখ, হয়ে যাবে।নো টেনশন।
তারপর থেকে পূরণ সবসময় চেষ্টা করেছে দেশ বিদেশের নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য গল্পচ্ছলে মনাকে দিয়ে দিতে।যাতে সব ওর মনে গেঁথে যায়।মাঝে-মধ্যেই অংকের মানসিক দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করে।এতে দিনে দিনে মনা এসবে ওর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে নিজের অজান্তেই।
চলবে…