নিষ্প্রভার রঙ ফিরে পাওয়া (পর্ব-২) ॥ ইসরাত জাহান


চিত্রশিল্পী: কাজী জহিরুল ইসলাম

পর্ব-২

শারমীনের হঠাৎ মনে হলো, ওর বুকের ভেতরের ডান অলিন্দ বাম অলিন্দ কিছু সময়ের জন্য রক্ত পাম্প করতে ভুলে গেলে, দুটো ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর। সত্যি কি সাজ্জাদ বসে আছে? ওদের এই বাড়িটা একটু পুরোনো আমলের। বসার ঘরে প্রবেশ মুখে এক ইট উঁচু ব্যারিকেড দেওয়া। ওখানটায় একটু অসচেতনতা জন্য হোঁচট খেয়েও নিজেকে সামলে নেয় শারমীন। আবার তাকায় ওই কর্নারে…। এবার বুঝতে পারে ব্যাপারটা।

শবনম সন্ধ্যা থেকে এক প্লেট ভাত নিয়ে ছেলের পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে। ছেলে খাবারটা কোনরকম আপত্তি ছাড়াই মুখ নিচ্ছে, পরক্ষণেই আবার ফেলে দিচ্ছে। দ্বিগুণ আগ্রহে। খাবারটা মুখ থেকে ফেলে সবার দিকে একবার তাকায়। তারপর নিজে নিজেই হাতে তালি দেয়। ও দেখে শবনমের মুখ শুকিয়ে যায়, রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। শবমন দুই বছর ধরে বাপের বাড়িতে আছে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে। ওর ছেলে জারিফ। সারাক্ষণ নানারকম দুষ্টুমি করে নানা, নানীসহ সবাইকে তটস্থ রাখার চেষ্টা করে। খাওয়া দাওয়ায় যত অনীহা দুষ্টুমিতে ততই আগ্রহ।

শবনম শারমীনের বড় বোন। ওরা দুই বোন একভাই। ভাই রাজীব পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাঁচ বছর আগেই চলে গেছে। বাবার ছোট একটা ওষুধের দোকান আছে। যার ভাড়া আর বিদ্যুৎ বিল দিয়ে বাড়িতে যৎসামান্য টাকা আসে তাই এখন এই পরিবারে শারমীনকেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এতদিন শারমীন নিজের থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয়নি। হঠাৎ করে সেইদিন ওর বোনের শাশুড়ি এসে যা-তা বলে যাওয়ার কারণে বিয়ের জন্য নিমরাজি হয়েছে।

ওর বোন দুই বছর আগে এক কাপড়ে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে শাশুড়ি ও স্বামীর সাথে ঝগড়া করে। শবমনের সমস্যাই বেশি ছিলো। কোনকিছু মেনে নিতে পারত না। তার ওপর বাবা মায়ের অতি আদরের কারণে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাবার বাড়ি এসে স্বামীবিহীন সংসার শুরু করে। প্রতি মাসের ৫ তারিখে শবনমের স্বামী ছেলে আর স্ত্রীর জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়ে যায় শাশুড়ির হাতে। সেই টাকার পুরোটাই শবনম ছেলের পেছনে অপচয় করে ফেলে। একদিন শবনমের শাশুড়ি এসে ওর বাবা মায়ের সাথে বাজে ব্যবহারের কারনে শারমীন শবমনকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করে শশুর বাড়ি ফিরে যাবার জন্য। বড় বোনকে জ্ঞান প্রদানের কারণে শারমীনে কিছু বাজে কথা ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। যার কারণে শারমীন হঠাৎ করেই মা বাবাকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে পাত্র দেখতে বলে। কিন্তু আজও শারমীন দেরি করে বাসায় ফেরে অফিসের কারণে।

রাত সোয়া এগারটা। মোট পাঁচজন লোকের সামনে বসে আছে শারমীন নিজের এতদিনকার সকল পুঁথিপত্র বিদ্যা বিসর্জন দিয়ে। পাত্রী নির্বাচনী পরীক্ষায় পাশের আশায়। পাঁচজনের ভেতরে সবচেয়ে বয়ষ্ক ভদ্রলোক শারমীনকে নাম, শখ কি, রান্না করতে জানে কিনা- এই নিয়ে জিজ্ঞেস করে। শারমীন সুশীলা নারীর মতো মাথা নেড়ে অল্প কথায় সবকিছু বলে। কিছু সময় নিজেদের ভিতরে আলোচনা করেন চারজন উপস্থিত ব্যক্তি। বাকি একজন শারমীনের থেকেও বেশি মাথা নিচু করে বসে থাকে।শারমীন চুপচাপ বসে বসে তাদের চোখের ভাষায় বোঝার চেষ্টা করে ওর পাত্রী নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল।

আপা মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমরা আজই আংটি পড়াতে চাই।

-আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নাই। আপনি সুফিয়া আপা ভাসুর, আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। আপনার কথাই আমাদের কথা। আমরা রাজি।শারমীনের মা বেশ খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে কথাগুলো বলে তার বড়বোন ভাসুরকে। এই বিয়ের প্রোপজালটা নিয়ে আসে ওর খালা। তার ভাসুরের বড় ভাইয়ের ছেলের জন্য।শারমীনের জন্য যে পাত্র পছন্দ করা হয়, সেই ছেলে ব্যবসায়ী। বসুন্ধরা মার্কেটে তিনটা দোকান আছে। ঢাকা শহরে ছয় তলা বাড়ি। বাবার বাংলামোটরে গাড়ির তেলের ডিলারশিপের ব্যবসা। ছেলে ওটাই দেখাশোনা করে। ছেলের নাম আজিজুল ইসলাম তমাল।

শারমীনকে নামিয়ে দিয়ে সাজ্জাদ কিছুসময় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। অনেকদিন শারমীনকে বলার চেষ্টা করছে ওর মনের কথাটা। ফোন নম্বর জোগাড় করে রেখেছে, বাসার ঠিকানা, অফিসের ঠিকানা সবই আছে সাজ্জাদের কাছে। কিন্তু যে কথাটা বলার জন্য এতো আয়োজন সেটা বলার সাহস এখন হারিয়ে ফেলেছে। একটা সময় ভার্সিটির সবাই যে শারমীনকে অপমান করেছিলো,ওকে চিঠি দেবার জন্য। আজ সেই শারমীনের মায়াভরা মুখখানি সারাজীবন দেখার জন্য বিদেশের পার্ট চুকে চলে এসেছে। সাজ্জাদ গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাড়ি ফেরার নির্দেশ দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে। মনে মনে ঠিক করে আগামীকাল শারমীনদের বাসায় ওর মাকে নিয়ে যাবে। ওর সাহস শারমীনের সামনে গেলে চুপসে গেলেও মায়েরটা ঠিকই থাকবে। আজই মাকে গিয়ে সবকিছু খুলে বলতে হবে। কেমন করে এতো সাধারণ চুপচাপ শান্ত একটা মেয়ে ওর মনকে দিনে দিনে অশান্ত করে তুলছে তার সবকিছুই আজ খুলে বলবে মাকে, এই পণ করে সাজ্জাদ।

ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা ১২ ছোঁয়ার আগে মিনিটের কাঁটা নবম ডিজিটে থাকাকালীন আজিজুল ইসলাম তমাল, সৈয়দা শারমীন জাহানের বাম হাতের অনামিকায় একটি হিরের আংটি পড়িয়ে দেয়। তখন চারপাশ থেকে সবাই মুখে শোনা যায় আলহামদুলিল্লাহ।

শবনম খুশিতে সবার সমানে বলে বসে আগামীকালই শশুর বাড়ি চলে যাবে। বোনের বিয়ে অনেক দায়িত্ব আছে, তাই শাশুড়িকে এই খুশির খবরটা দিতে হবে ওকে।

মেহমান চলে যাবার পরে মায়ের সাথে সবকিছু গুছিয়ে শারমীন রুমে এসে যখন শোয়ার প্রস্তুতি নেয়, তখন মোবাইল একটি মেসেজ আসে অপরিচিত নম্বর থেকে।

‘আগামীকাল মাকে নিয়ে তোমার বাসায় আসবো। তুমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো’। মেসেজটা দেখে শারমীন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। এতরাতে এই মেসেজ ওকে কে দিতে পারে। ওর মোবাইল নম্বর কি তমাল সাহেব ইতিমধ্যে জোগাড় করে ফেলেছে? ফেলতেই পারে। ব্যবসায়ী মানুষ হয়তো আগের থেকেই সংগ্রহ করেছে। লোকটাকে ওর শান্ত মনে হয়েছে। আঙুল ছোঁয়ার সময় লোকটার হাত কাঁপছিলো। হঠাৎ করে শারমীনের সাজ্জাদের কথা মনে পড়ে যায়। এই মেসেজটা সাজ্জাদ ওকে দিতে পারে। আজ গাড়িতে উঠার পর থেকে বেশ ছটফট করছিলো ওকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু সাজ্জাদের অব্যক্ত কথাগুলো শারমীন যে ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছে সেটা সাজ্জাদ বুঝতে পারেনি। একবার ভাবে মেসেজের রিপ্লাই দেবে, পরে আর সেই ইচ্ছেটাও ওর মরে যায়। আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

বোরহান উদ্দিন আজ বেশ খুশি তার ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স ছেলের জন্য ইঞ্জিনিয়ার বউ ঠিক করতে পেরেছেন। বোরহান উদ্দিন নিঃসন্তান। বড় ভাইয়ের এই ছেলেকে তিনি ছয় মাস বয়সে দত্তক নিয়ে আসেন। আজ তার বড়ভাই বেঁচে থাকলে আরও খুশি হতো। বোরহান উদ্দিন একটু পাগলাটে ধরনের। আংটি পরানোর খুশিতে মাঝরাতে বাড়ির সব বাচ্চাদের ডেকে তোলে মিষ্টি খাওয়ার জন্য। তমালদের ছয়তলা বাড়ির প্রতিটি ঘরে আজ আলো জ্বলছে।

সাজ্জাদের গাড়ি যখন গেটে এসে দাঁড়ায়, তখন ওদের পুরো বাড়ি অন্ধকার। দারোয়ান লতিফ দৌড়ে এসে গেট খোলে। সামনের লনের আলো জ্বালিয়ে দেয়। দরজা খুলে নিজের রুমে ঢোকার আগে মায়ের রুমে উঁকি দেয়। হালকা আলো আঁধারে ঘেরা মায়ের ঘরটায় কেমন যেন একটা মায়াবী ঘোর তৈরি করে। সাজ্জাদের মা সানজিদা আহামেদ ইজি চেয়ারে চুপচাপ বসে আসে।

-মা তুমি এখনও ঘুমাওনি?
-তুই কোথায় ছিলি এত রাত পর্যন্ত?
-একটু কাজ ছিলো।
-আসার পর থেকেই তো শুধু বাহিরে বাহিরে থাকিস। কোথায় কোথায় যাস এতো?
-একজনকে খুঁজে ছিলাম, কয়কদিন হলো খুঁজে পেয়েছি।
-কে?
-শারমীন, আমার সাথে পড়তো। এখন একটা ফার্মে চাকরি করে। ওকে খুঁজতেই এসেছি। মা বাবা কোথায়?
-থাইল্যান্ড।

হঠাৎ একটা নিরবতা নেমে আসে মায়াবী আলো আঁধারী ঘরটাজুড়ে।

সকালে শবমনের চিৎকার চেঁচামেচিতে শারমীনের ঘুম ভাঙে। চোখ খুলেই অনামিকায় আটকে থাকা আংটিটি একটু দূতি ছড়িয়ে ওকে জানান দেয়, বাঁধা পড়ে গেছো। মুহূর্তেই শারমীনের মনে সাজ্জাদের অসহায় মুখখানি ভেসে উঠে।

চলবে..