মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-৪) ॥ আরিফুর রহমান


পর্ব-৪

ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে যাওয়ায় ছেলেগুলো প্রথমে বুঝতে পারেনি কে কাকে ধাওয়া করবে।কিন্তু মুহূর্তেই পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে তিনজন ওদের তিনজনকে ধাওয়া করতে গিয়ে পলির পেছনের ছেলেটা পা পিছলে চিৎপটাং হয়ে গেল।আবছা অন্ধকারে সে দেখতে পায়নি ঘাসের নিচে ফিচফিচে কাদা আছে।

ঝুমা কিছুটা কোণাকুণি দৌড়াচ্ছিল বলে ওর পেছনের ছেলেটা ওকে ধরতে গিয়ে একটা গাছের নিচু ডালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।
পলি ও ঝুমা পুকুরের পার ধরে দৌড়ে দ্বিতীয় পুকুরটা অতিক্রম করে হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেল এবং পেছন ফিরে বুঝল ছেলেগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছে।কিন্তু মনা! মনা কোথায়? বোকাটা পূর্বদিকে দৌড় দিল কেন? ছেলেগুলো ওকে ধরে ফেলেনি তো? এমন অনেক প্রশ্ন ওদের অস্থির করে তুলল।কিন্তু কী করবে, সহসা কেউই বুঝে উঠতে পারল না।আতঙ্কে ওদের মুখ মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তখনই গেটের নিরাপত্তা প্রহরী সাজু মিয়া পেছন থেকে ওদের ডাকল, আপারা আসছেন? ঝড় শুরু হওয়ার আগেই বের হয়ে আসবেন না?
পলি ও ঝুমা প্রহরী সাজু মিয়াকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল।ওরা হাউমাউ করে ওকে বলল, তিনটা বাজে ছেলে..ওখানে আমাদের.!
আমরা দৌড়ে..চলে এসেছি.।
আমাদের আরেকজন আছে মনা, ওকে ওরা হয়ত ধরে..!
ঝড়ো বাতাস আর মেঘেদের গর্জনের ভেতর ওদের দুজনের ভাঙা ভাঙা বাক্যগুলো শুনে যা বুঝবার বুঝে গেল সাজু মিয়া।চোয়াল শক্ত করে বলল, চলেন তো দেখি, তাড়াতাড়ি।

কীভেবে মনা পূর্বদিকে দৌড়াতে শুরু করেছিল ও জানে না।কিছুটা দৌড়ে যখন বুঝল যে, সে ভুল দিকে দৌড়াচ্ছে, তখন ঘুরে আবার সঠিক দিকে দৌড়াতে গিয়ে পড়ল চাকুঅলা ছেলেটার সামনে! মুহূর্তে যেন ওর শরীরের সমস্ত রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল।ও হাতব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল, ঝুমা, পলি!
কিন্তু ঝড়ো বাতাস সেই শব্দ উল্টোদিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
ছেলেটা আবার দাঁত খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, চুপ চুপ, শ্যাষ কইরা ফালামু!
মনার গলা শুকিয়ে গেছে।ওর হাত পা ভীষণ কাঁপছে।বুঝল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
তক্ষুনি কোথা থেকে একজন মানুষ এসে মনা ও চাকুঅলা ছেলেটার মাঝখানে দাঁড়াল! মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।সেই আলোয় মনা কেবল তার পেছন দিকটা দেখতে পেল, লম্বা ও সুঠাম দেহের মানুষটার গায়ে ফুলহাতা চেক শার্ট।

চাকুঅলা ছেলেটা মানুষটাকে ওর সামনে দাঁড়াতে দেখে আবারও দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কে? কে বে তুই? ভাগ!
মানুষটা কোনো কথা না বলে শার্টের হাতা গোটাচ্ছে দেখে ছেলেটা চাকু উঁচিয়ে তাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এল।চোখের পলকে মনার সামনের মানুষটা ছেলেটাকে ধাক্কা দিলে সে অনেকটা উড়ে যাবার মতো করে ছিটকে গিয়ে সাত-আট হাত দূরের একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল! সেটা দেখে পলি ও ঝুমাকে ধরতে না পেরে মনার পিছু নেওয়া ছেলে দুটো ভয় পেয়ে থমকে গেল।মানুষটা ওদের দিকে দৃষ্টি রেখেই হাত দিয়ে ইশারা করে মনাকে পুকুরপাড়ের দিকে যেতে বলল। সাথে সাথে মনা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেদিকে।কিন্তু পারে উঠতে গিয়ে বুনো কাঁটার গাছের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।তক্ষুনি আবার উঠে দৌড়াতে লাগল।ও পুকুরের পাড়ে উঠতেই শুরু হলো বৃষ্টি।তবে ও থামল না, পার ধরে পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলল।তখনই ও শুনল ওর বান্ধবীরা ওকে ডাকছে, ম-না, মনা।

ও যেন কিছুটা সাহস পেল।কোনোমতে বলল, এইদিকে।
পুকুরের পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ওরা আবার মিলিত হলো।পলি ও ঝুমা দুজনই মনাকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করতে লাগল।
তুই ঠিকাছিস তো?
তোর কিছু হয়নি তো?
মনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ ঠিকাছি।
তুই ঐদিকে দৌড়লি কেন?
ওরা তোকে ধরতে পারেনি, তাই না?
মনা কোনো কথা বলবার আগেই ওদের পেছন থেকে সাজু মিয়া বলল, ওসব পরে শোনা যাবে।আগে চলেন, ভিজে গেলাম সবাই।
ওরা আবার দৌড়াতে লাগল।

ফুলবাগানের কাছে এসে সাজু মিয়া বলল, আপনারা আমাদের অফিসে চলেন।বৃষ্টি কমলে যাবেন।
ওরা তিনজন একসাথে কলকলিয়ে উঠল!
না না, আমরা চলে যাই।
আমাদের এখন যেতে হবে।
ভাই, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।ভিজতে ভিজতে হলেও চলে যেতেই হবে।
সাজু মিয়া বলল, কিন্তু এখন এই বৃষ্টির মধ্যে তো কোনো গাড়ি পাবেন না!
ঝুমা বলল, কিচ্ছু করার নেই। হেঁটেই চলে যাব। অ্যাই, চল তোরা।
অগত্যা সাজু মিয়া ওদের পিছু পিছু গেট পর্যন্ত এল।তারপর ওদের অনুরোধ করে বলল, এই ঘটনা যেন কেউ না জানে আপারা।মালি ব্যাটা থাকলে এমন অঘটন ঘটত না।কিন্তু ও বাজারে গেছে, আর আমিও আপনাদের ঢুকতে দিছি।এসব জানাজানি হলে আমাদের দুজনেরই চাকরি চলে যাবে!

ওরা সাজু মিয়াকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে পড়ল।বাতাসের বেগ কমে গিয়ে এখন বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে।তার মধ্যেই তিনটি মেয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগোচ্ছে শহরের দিকে।
আউটার স্টেডিয়ামের কাছে এসে সৌভাগ্যক্রমে ওরা একটা অটো পেয়ে গেল এবং তাতে উঠে পড়ল।
অটোতে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তিনজনই।আর তখন মনা টের পেল ওর বাম পায়ের গোড়ালির একটু ওপরের অনেকটা অংশের পায়জামা ছিঁড়ে গেছে এবং পা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে!
যে মোড় থেকে যাত্রা শুরু করেছিল পলি ও ঝুমা, সেই মোড়েই এসে নামল দুজন।তারপর দুটো রিকশা নিয়ে দুজন দুদিকে চলে গেল।মনা নেমে গেছে আগের মোড়টায়।ওখান থেকে দক্ষিণদিকের গলিতে একটু এগোলেই ওর খুশির নীড়।

বৃষ্টি থেমে গেছে আগেই।সন্ধ্যাও গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে চলেছে। বিদ্যুৎ নেই, বেশ ঝড় হয়েছে বলে আসতে দেরি হতে পারে।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ভিজে জবজবে মনা ধীর পায়ে এসে গেট ঠেলে খুশির নীড়-এ ঢুকল এবং তক্ষুনি ওকে চমকে দিয়ে বিদ্যুৎ চলে এল!
নিজের রুমের সামনে এসে মনা দেখল দরজা খোলা, ভেতরে ওর বাবা মকবুল হোসেন খান বসে আছেন!সারা শরীর কেঁপে উঠল মনার। ও জানে, এটা যতটা না বাবার ভয়ে তার চেয়ে বেশি হঠাৎ অমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে! নিশ্চয়ই জ্বর-টর এসে যাবে!
চলবে..