আজ শরতের কাশের বনে ॥ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


‘শরৎকাল আসিয়া পড়িয়াছে সন্দেহ নাই।
নদীতীরে কাশের বন এবার সাদা হইয়া উঠিবে।’
– মানিক বন্দোপাধ্যায় (পদ্মা নদীর মাঝি)

ছোটবেলায় প্রকৃতিতে ঋতু পরিবর্তন হতো আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত একের পর এক তাদের সৌন্দর্য মেলে ধরতো। কিন্তু বর্তমান কালটা ভিন্ন। কখন যেকোনো ঋতু এসে চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। মনে হয় এদের ক্রমটাও নষ্ট হয়ে গেছে।

গত সপ্তাহ যাবত চলছে ক্রমাগত মরুভূমির উত্তাপ। ঢাকা শহরের বুকে। সাথে চরম আর্দ্রতা। ঢাকা শহরের কথা বললাম এ কারণে যে, চতুষ্কোণ অফিস বা বাসস্থানের ভেতরেই আমার বর্তমান জীবন সীমাবদ্ধ। যদিও মাঝে মধ্যে ক্লান্ত-বিষণ্ন বিকেলে আমি, আমার স্ত্রী এবং মেয়ে গাড়িতে ঘুরতে যাই ৩০০ ফুট রাস্তায়। এখানে প্রকৃতি ধ্বংস করে আমরা গড়ে তুলছি নতুন নগর। একবিংশ শতাব্দীতে ঢাকা সরে এসে বাসা বাঁধবে এখানে।

সুতরাং আমার প্রকৃতি দর্শন মূলত ফেসবুক থেকে। এখানে উঁকি দিলেই আমি বুঝতে পারি বার্ষিক গতিতে পৃথিবীর অবস্থান।

গত বছর আমার এক বন্ধু তার টাইমলাইনে পদ্মা তীরের কাশবনের ছবি পোস্ট করেছিলো।গতকাল করেছে আমার অন্য এক ফেসবুক বন্ধু। আজ সকালে আমার ক্যাডেট কলেজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। ছবিগুলো থেকে আমি বুঝতে পারছি শরৎকাল এসে চলে যাচ্ছে। আমার অজান্তে।তবে ছবিগুলো আমার পূর্ব-স্মৃতিকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। পিঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে। ফলে এক এক করে স্মৃতির পাতা খুলে যাচ্ছে আমার!

সময়কাল আমার ছেলেবেলা। আমাদের বাড়ি থেকে একটু পশ্চিমে ঝাড়কাটা স্কুল। ঝাড়কাটা নদী থেকে একটা ধূলিধূসরিত রাস্তা ঝাড়কাটা স্কুল পেরিয়ে তেঘরিয়া বাজার, চর পাকেরদহ, চর নগর হয়ে বালিজুরি হাটে পৌঁছেছে। প্রতি বুধ ও শনিবারে এই হাট বসে। হাট শেষ হবার পর পুনরায় একটা ধূলিধূসরিত রাস্তা দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ মাদারগঞ্জ থানার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। হাট থেকে আধা মাইল দূরে এসে এই রাস্তা দুই খণ্ড পথে বিভক্ত হয়ে গেছে।

একটা বিশাল বট বৃক্ষের ঠিক সামনে এসে। হাটবারে বালিজুরি বাজার এই বটগাছ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে।

প্রথম পথটি বটগাছকে পশ্চিমে রেখে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে। মাদারগঞ্জ আশেক মাহমুদ স্কুলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার পর খরকা বিলকে বাঁয়ে রেখে এই পথ সুখ নগরী গ্রামের নিবিড় অরণ্যানীর ভেতরে ঢুকে গেছে। এই গ্রামেই ছিলো আমার নানাবাড়ি। ১৯৮৮ সনের বন্যার সময়ে নদীর ভাঙনে এই গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে।

দ্বিতীয় পথটি বট বৃক্ষটিকে হাতের বাম পাশে রেখে ধূলিধূসরিত প্রশস্ত মেঠো পথ হিসেবে চাঁদপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিম দিকে। চাঁদপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে এই পথ আলতাফুর রহমান তালুকদারের বাড়ির পাশ দিয়ে যমুনা নদীর দিকে চলে গেছে। অতঃপর নদী থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নদীর সমান্তরালে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। মাইলের পর মাইল।

এই রাস্তাটিই আমাদের থানা অতিক্রম করে সরিষাবাড়ি আলহাজ জুটমিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট বা বন্দরে। এখান থেকে যমুনা অতিক্রম করে সিরাজগঞ্জ ঘাট হয়ে আপনি রেলপথে ঈশ্বরদী জংশন হয়ে কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে আসা যেতো।

আবার সরিষাবাড়ি থেকে আপনি চাইলে এই রাস্তা ধরে জামালপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা হয়ে সিলেট অথবা চট্টগ্রামে চলে যেতে পারবেন। অতঃপর কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ। পরিশেষে নাফ নদী অতিক্রম করলেই মায়ানমারের আরাকান রাজ্য।

দ্বিতীয় পথ অর্থাৎ বটগাছের পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে আধা মাইল সামনে গেলেই এক বিশাল অমল ধবল প্রান্তর। যমুনার তীরে। এই প্রান্তরে আমি ছেলেবেলায় অনেকবারই গিয়েছি। চার দশক পরেও ছবিগুলো দেখে সেই প্রান্তরের দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এতটাই স্পষ্ট এই দৃশ্য যে, মনে হয় ইচ্ছে হলেই আমি সেগুলোকে ছুঁতে পারি!

পরের রাস্তা এবং যমুনার জলের মধ্যবর্তী স্থানে এক বিস্তীর্ণ বালুর প্রান্তর। প্রাকৃতিক। ৩০০ ফুট রাস্তার পাশের মতো প্রকৃতি ধ্বংস করে এটার সৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতিই তার খেয়ালখুশি মতো একে সৃষ্টি করেছে। শরৎকালে এই প্রান্তর কাশফুলে ভরে যেতো। মনে হতো শরতের শ্বেত শুভ্র মেঘকে আকাশ থেকে নামিয়ে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে প্রান্তরের বুকে! কাশবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে আছে নদীর জলে। যেনো আর্শিতে মুখ দেখছে উদ্ভিন্ন যৌবনা কোন নারী!

এতগুলো স্মৃতি একসাথে মনে পড়ে গেলো। এতকাল পর! মনের ভেতরে গুন গুনিয়ে উঠছে ছেলেবেলার সেই বিখ্যাত কবিতা:
‘চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’