ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৬) ॥ মায়াবন বিহারিণী


তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেছিল।
কীভাবে?
ওই বিজ্ঞাপনটার বাচ্চাদের মতো আমারও ইংলিশ উচ্চারণে বাংলায় বলতে ইচ্ছে করছে, তোমার মুখটা আমার জন্য লাকি!

পূরণ সত্যি সত্যি বাচ্চাদের কণ্ঠে ইংলিশ লোকজনের মতো উচ্চারণে কথাগুলো বলল! আর হাসতে হাসতে মনার পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থা! মাঝে মধ্যে কী যে ছেলেমানুষি করে না মানুষটা, মনা ওর চারপাশ ভুলে গিয়ে হাসতে থাকে! পূরণের কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব, সৌজন্যবোধ, মানবিকতা, অনুপ্রেরণা, ছেলেমানুষি সবই ভালো লাগে মনার।এ ভালোলাগার সাথে অন্য কোনোকিছুরই তুলনা হয় না। ও হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল, বললে না তো কীভাবে? তুমি প্রথম যেদিন আমাকে ফোন দিয়েছিলে সেদিনের কথা বলছ?
জি না মহীয়সী, আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম আরও কয়েক মাস আগে।সেদিন তোমার বিবিএ-র শেষ পরীক্ষা ছিল।আমি ছোটোবোনকে আনতে কলেজ গেটে গেছিলাম, সে-ও পরীক্ষার্থী ছিল।পরীক্ষা শেষ বলে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হচ্ছিল।আমি একটু দূর থেকে নজর রাখছিলাম কখন বোনটা বের হয়।একসময় বেরিয়ে এলে তুমি, আর আমি আক্ষরিক অর্থেই হা হয়ে দেখছিলাম একটা মেয়ে এতটা সৌন্দর্য নিজ দেহে ধারণ করে!

গ্যাস, নির্ভেজাল গ্যাস! মনে মনে বলল মনা।
তুমি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলে।সেই শেষ বিকেলেও আকাশভরা কালো মেঘ ছিল।আর আমি সব ভুলে তোমাকেই দেখছিলাম।তক্ষুণি আমার মোবাইলের মেসেজ টিউন বেজে উঠেছিল। খুলে দেখি লেখা, কনগ্র্যাচুলেশন, ফাইনালি, ইউ আর সিলেক্টেড ফর দ্য….। খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছিল, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি! দেখি তুমিও খুব হাসছ, ভাবলাম, আমারই খুশিতে!

দিবাস্বপ্ন, না? আবারও মনে মনেই বলল মনা।
কখন ছোটোবোনটা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, টের পাইনি।আমি তোমার চলে যাওয়া দেখছিলাম।পরে বাসায় গিয়ে বোনটা আমাকে খুব খেপাচ্ছিল সে কথা বলে বলে।তারপর বহুদিন তোমাকে দেখিনি, কিন্তু তোমার মুখটা ঠিকই আঁকা ছিল মনের ক্যানভাসে।তাইতো যেদিন তুমি বসবাসের জন্য এই শহরে এলে সেদিন একপলক দেখেই তোমাকে চিনে নিয়েছিলাম।

মনা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,জি না জনাব, আপনার কোথাও একটু ভুল হলো, আমি বসবাসের জন্য এই শহরে আসিনি।পড়াশোনা শেষে চলে যাব।
তোমারও একটু ভুল হলো, পড়াশোনা শেষেও তোমাকে থাকতে হবে কোনো একটা জব পাওয়া পর্যন্ত।
সে-ও সাময়িক।
দেখো, তুমি এই শহর ছেড়ে যেতে পারবে না কোনোদিন।
মনাও যেতে চায় না।ওর মনটাও ইতোমধ্যে গেঁথে গেছে এই ছোট্ট শহরে। জমে গেছে অনেক অনেক মায়া।কিন্তু ওকে যেতে হবে অচিরেই! ওর বাবা মকবুল হোসেন খান ওর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছেন খুব। তিনি কোনোভাবে জানতে পেরেছেন পূরণের সাথে মনার সম্পর্কের বিষয়ে।যদিও তিনি স্পষ্ট করে জানেন না যে, সম্পর্কটা কতদূর এগিয়েছে।তবু শুনে তিনি মনে বড়ো আঘাত পেয়েছেন।মনা তার খুবই আদরের মেয়ে।একটু অন্যরকম; পড়াশোনার চেয়ে আঁকাজোকার দিকে ঝোঁক বেশি।তা তিনি মেনে নিয়েছিলেন।তাই বলে আবারও ভালোবাসাবাসির মতো বিষয়, তিনি কক্ষনো মেনে নেবেন না!

মকবুল হোসেন খান ধীরস্থির মানুষ।ব্যাপারটা জেনে তিনি ধীরে সুস্থে যাচাই করেছেন এবং সত্যতাও পেয়েছেন।তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেবেন।তিনি জানেন, ধারণাটা সেকেলে,কিন্তু যুগে যুগে এসবই কাজে লেগেছে।

পূরণের সাথে মনার সম্পর্কটা সম্পূর্ণ অন্যরকম।একটা অচেনা, অদেখা, অদ্ভুত মানুষের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সে।কিন্তু সম্পর্কটা খুবই পবিত্র আর মায়াভরা।এ যুগের ছেলে হয়েও পূরণ কখনো শারীরিক আকর্ষণ বোঝায় এমন কোনো কথা আজ পর্যন্ত বলেনি।মায়াভরা কথা শুনতে শুনতে মনাই কখনো কখনো চোরা টান অনুভব করে ওর প্রতি! কিন্তু পূরণ বরাবরই নির্লিপ্ত!এ নিয়ে বেশ ভেবেছে মনা।কথাও বলেছে ক্লোজ বান্ধবী ঝুমার সাথে।সব শুনে ও বলেছে, এত বেশি পবিত্র সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত মিলনের হয় না।তবে তোরটা সফল হলে আলাদা একটা উদাহরণ তৈরি হবে।কিছু মনে করিস না, ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ যা-ই বলিস, পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ একটা ন্যাচারাল ব্যাপার। আর সেটা একে অপরের নিকট প্রকাশের ইচ্ছেটাও ন্যাচারাল। আরে, আগেকার দিনের মুনিঋষিরাও তো কোনো একসময়….!

মনা খেয়াল করেছে মানুষটা কেবল নির্লিপ্ত-ই নয় রহস্যময়ও! মাঝে মধ্যেই কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে।কোনো কোনো ব্যাপারে ও আগে যা বলে পরে তা-ই সত্যি হয়! এই তো গতকালই, সকালে অফিস যাবার পথে হঠাৎ বলল, মনা, তুমি আমার সাথে কথা বলবার জন্য যে সিম কিনেছ সেটার কথা তোমার বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করেননি?
না।এতদিন পরে হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
এমনি, হঠাৎ মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম।

দুপুরের পরই মকবুল হোসেন খান ফোন করে মনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইদানিং তোমার ফোন বেশি বেশি বন্ধ থাকছে।বিশেষ করে সকালে এবং রাতে।কোনো সমস্যা? নাকি নতুন সিম নিয়েছ, যেটার নম্বর আমাদের কাছে নেই?

মনা বহুদিন তার বাবার এমন থমথমে কণ্ঠস্বর শুনেনি। কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। তখনই ওই প্রান্তে কে যেন ওর বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করল আর তিনি বললেন, এখন রাখি।পরে কথা বলব।
মনা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল।
পূরণ অফিস আওয়ারে কখনো মনাকে কল করে না।মনা জানে ডিসি অফিসে সবসময় লোকজন থেকেই যায়, তাই খুব বেশি ইচ্ছে না করলে সে-ও কল দেয় না।

একদিন ক্লাস শেষে হঠাৎ ওর ফোন পেয়ে কিছুটা অবাকই হলো মনা। বিস্ময় চেপে জিজ্ঞেস করল, বলুন জাঁহাপনা, অসময়ে আমাকে কেন স্মরণ করেছেন?
তুমি ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিলে?
না তো, কেন?
বৃষ্টি শুরু হলে কীভাবে বাসায় যাবে?
বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নেই বাবু।আমি এখনই বেরিয়ে যাব।আর পথে যদি বৃষ্টি নামেও, কোনো দোকানে বা গাছতলায় দাঁড়িয়ে যাব।

এই শহরে গাছতলা! বিড়বিড় করল পূরণ।তারপর বলল, বৃষ্টি শুরু হলে সুন্দরী মেয়ের কোথাও দাঁড়ানোয় রোমান্টিকতা নেই।সে হেঁটে যাবে আর তাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে কোনো ছেলে ছাতা এগিয়ে দেবে, এটাই রোমান্টিক সিন। হা হা হা!
সাহেবকে কি আজ দখিনা বাতাস ছুঁয়ে গেছে?
হুম, বৃষ্টি ভেজা দখিনা বাউরী বাতাস।

তারপর মনা কোচিং থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু করলে ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিল! ওকে ওভাবে ভিজতে দেখে একটা ছেলে দৌড়ে এসেছিল ছাতা হাতে। ওর দিকে ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমার ছাতাটা নিয়ে তুমি চলে যাও। এই-সময়ের বৃষ্টি তেমন ভালো না, জ্বর-টর হয়ে যাবে।

মনা চোখ তুলে দেখেছিল তারই পুরনো একটি অধ্যায় ছাতা হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কয়েক বছর পর হঠাৎ দেখা বলে ও কেবল মুখটুকুই দেখেছিল, কথাগুলো ঠিকঠাক শুনতেই পায়নি!
সেদিন মনা ছেলেটির সাথে কোনো কথা বলতে পারেনি, মৃদু কাঁপন লাগা হাতে ছাতাটা নিয়ে তক্ষুনি সামনে পা বাড়িয়েছিল!
এই দৃশ্য দেখে, পাশের নির্মাণাধীন একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে কয়েকটি ছেলে হাততালি দিয়েছিল।তাদের একজন তো শিস দিয়ে বলেই ফেলেছিল, শাবাশ ব্রাদার, চালিয়ে যান।

আরেকদিন, সেটা ওদের সম্পর্কের শুরুর দিকেই, পূরণ হঠাৎ মনাকে প্রশ্ন করেছিল, প্রকৃতির কোন উপাদানটা তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ?
আকাশ।
আকাশের কোন অবস্থাটা? মানে ঝকঝকে পরিষ্কার নীলাকাশ নাকি সাদা মেঘের টুকরো ভেসে বেড়ানো আকাশ?
কোনোটাই না, আমার পছন্দ ঘনকালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া আকাশ।যার কিছুটা মেঘ এলোমেলো বাতাসে উড়ছে দিগ্বিদিক।যেকোনো মুহূর্তে নামবে বৃষ্টি।
এ তো সন্তানসম্ভবা নারীর মতো মেঘবতী আকাশ তোমার পছন্দ!
হুম। আর মেঘের আড়াল থেকে তেরছা রোদ নামবে দূরে কোথাও। ছোটোবেলায় মা বলত, ওটা মেঘ পাকানো রোদ! দেখবি, মেঘ আরও ঘন হয়ে একটু পরই বৃষ্টি ঝরাবে।

তুমি কিছুক্ষণ পর ছাদে উঠলে দেখবে তোমার প্রিয় আকাশটা তোমার অপেক্ষায় মেঘেদের নিয়ে থমকে আছে!
মজা করো না তো! আমার জানালায় এখন কড়া রোদ।
তুমি ছাদে গেলেই ওই তেরছা রোদ সরে যাবে অন্যকোথাও।সত্যি সত্যি মনা আধঘণ্টাখানেক পর ছাদে উঠে দেখেছিল, আকাশের দক্ষিণাংশে কালো মেঘের কুন্ডলী! ছড়িয়ে পড়ছে সারা আকাশজুড়ে।

ছোটো ছোটো এমন অসংখ্য ঘটনা আছে।সবই কাকতালীয়? মনা জানে না!

চলবে..