ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৭) ॥ মায়াবন বিহারিণী


মনার পুরনো অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছিল পাঁচ বছর আগে।তখন ও টুয়েলভথের ছাত্রী।

ওদের বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো।কলেজের উল্টোদিকে তালুকদার বাড়ি।সেই তালুকদার বাড়ির ছোটো কর্তা আতাউর রহমান তালুকদার, লোকে বলে আতা তালুকদার, তার ছেলে আকাশ তালুকদার তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। এলাকার সাদাসিধে পড়ুয়া ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে সদরঘাট, সোয়ারী ঘাট ঘুরে ঘুরে বুড়িগঙ্গার হাওয়ায় আমুল বদলে গেল।তার মাথায় ঝাকড়া চুলের বাবরি হলো, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি হলো আর কাঁধে ঝুলে পড়ল পাটের লম্বা ব্যাগ।বিউটি বোর্ডিং ও বাংলাবাজারে তার নিত্য যাতায়াত।বাহাদুরশাহ পার্ক ও আহসান মঞ্জিল হলো আড্ডা জমানোর জায়গা।ফলে নিজ গ্রামের সাদাসিধে আকাশ তালুকদার পরিবর্তিত হয়ে ঝা চকচকে একজন উত্তরাধুনিক যুবক হয়ে উঠল!

গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে এলে আকাশকে দেখে গ্রামের সাধারণ মানুষজন কানাঘুষা শুরু করল এই বলে যে, ঢাকার বাতাসে ছেলেটা বখে গেছে! কিন্তু উঠতি ছেলেপেলে ওকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করল নিজেদের আইডল হিসেবে।ওর কথাবার্তায়, ওর চলনবলনে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় পরিচর্যার দিকে মনযোগী হয়ে উঠল ওরা!

অল্পদিনেই আকাশ কলেজ মাঠের খেলাধুলা ও আড্ডার মধ্যমনি হয়ে উঠল।ওর বাবা আতাউর রহমান তালুকদার ছেলের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হলেও ওর নেতৃত্ব গুণের ভেতরে নিজের ছায়া দেখতে পেয়ে মনে মনে সন্তুষ্ট হলেন! কেবল ওর মা প্রতিদিন ওকে নানান কথা শুনাতে থাকলেন, তা সে কানে না তুললেও।

একদিন ভরদুপুরে, মনা তখন বারান্দায় বসে পোষা বিড়ালের সাথে খুনসুটিতে মেতে ছিল আপনমনে, আকাশ ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ টানা তাকিয়ে থেকে সে মনার ভেতর যেন রবিবাবুর ছোটোগল্পের কোনো নায়িকাকে খুঁজে পেল।আর নিজের ভেতর একটা শিহরণ টের পেয়ে হাওয়ায় উড়তে উড়তে চলে এল।অথচ ও যখন কলেজে পড়ত মনা তখন কলেজের পাশের হাইস্কুলের ছাত্রী।দেখা হয়েছে বহুবার, কিন্তু ওর এরকম অনুভূতি হয়নি কখনো।

মনা দুবার তাকিয়েও আকাশকে চিনতে পারেনি।ও ভেবেছে পথচলতি কোনো অচেনা ছেলে তাকে দেখে হা হয়ে গেছে! সেতো প্রতিদিন অনেকেই হয়, ও এসব আর গায়ে মাখে না। অবশ্য আকাশ আগের মতো চেহারার থাকলে মনা নিশ্চয়ই চিনতে পারত, আর কে জানে হয়ত এগিয়ে গিয়ে কথাও বলত।কারণ ভালো ছেলে, ভালো ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ওর বেশ গ্রহণযোগ্যতা ছিল।কিংবা হয়ত মনার কাছে তার চেয়ে একটু বেশি কিছুই ছিল।সমবয়সী অনেকেই ওর চোখে আকাশের জন্য সেই দৃষ্টি তখন দেখতে পেয়েছিল যে!

পরদিন সকালে আকাশ গেল মনাদের বাড়ির সামনে, কিন্তু মনা ওর ঘরে পড়াশোনা করছে। রাস্তা থেকে আকাশ ওকে দেখতে না পেয়ে মুখভার করে ফিরে এল। দুপুরে আবার গেল, মনা তখন ওর মার সাথে রান্নাঘরে।আকাশের মন খারাপ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে এল ধীরপায়ে।

বিকেলে আকাশকে ফের দেখা গেল মনাদের বাড়ির সামনে এবং ওর মনোবাসনা পূরণ হলো।মনা ঘরের সামনের ছোট্ট ফুলবাগানের ঝরাপাতাগুলো কুড়িয়ে এক জায়গায় জমা করছিল।আকাশকে দেখে ওর ভ্রু কুঞ্চিত হলো, এই ছেলেটা প্রতিদিন এখানে কেন আসে? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে।অবশ্য উত্তর খুঁজে সময় নষ্ট না করে ও নিজের কাজ করতে লাগল।

আকাশ আগের দিনের মতোই মনাকে কিছুক্ষণ দেখে প্রফুল্ল মনে বাড়ি ফিরল।সারাদিনে একবারও কলেজ মাঠে বা চায়ের দোকানে ওকে না পেয়ে ওর অনুসারীরা সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে জমায়েত হলো।কিন্তু আকাশ খামোখা একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে সবাইকে বিদায় করল।তারপর শুয়ে শুয়ে পরের দিনের পরিকল্পনা সাজাতে লাগল।

আকাশের দেহমনে থেকে থেকে সেই শিহরণ খেলে যাচ্ছে যেটা মনাকে দেখে ওর দেহে ঢুকে গেছিল।ও এখন উন্মুখ মনার হৃদয় সীমানা ডিঙিয়ে একবার ঘুরে জেনে নিতে সেখানে তার জন্য আগের সেই অনুভূতি আজও সুপ্ত আছে কিনা।যদি থাকে তো সে সেই সুপ্ত অনুভূতি জাগাতে চায়, তাতে নতুন রং মাখতে চায়, জয় করে নিতে চায় মনার হৃদয়।আর যদি না থাকে? না না, এদিকটা সে ভাবতে চায় না। সময় তো খুব বেশি বয়ে যায়নি, মাত্র বছর দেড়েক! এতটুকু সময়ে মনাদের বাড়ির পাশের যমুনা নদী দিয়ে ক’ফোঁটা জল গড়িয়ে গেছে কিংবা মনার মন-যমুনায়? তার চেয়ে বেশি কথা কি জমেনি তার হৃদয় আঙিনার সবুজ ঘাসে? যেখানে যুগল পায়ে হেঁটে হেঁটে কথার মালায় দুজনে জড়াতে পারে অনন্তকালের বাঁধনে?

এমন হাজারো ভাবনা ওকে ঘুমুতে দিল না সারারাত! বড়ো তৃষ্ণার্ত মনে সকালেই আকাশ ছুটে গেল যমুনার পারে, খান বাড়ির সামনে; মনা তখন নাস্তার টেবিলে।যমুনার হাওয়া আকাশের শরীর জুড়িয়ে দিলেও মনের তৃষ্ণা মিটল না।এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে ঘণ্টা দুয়েক পর আকাশ আবার গেল নিজের লক্ষ্য পূরণে।দেখল মনা বারান্দায় বসে পোষা বিড়ালটাকে খাবার খাওয়াচ্ছে।কিছুটা ইতস্তত করে সে বুকের ভেতর জমা হওয়া অস্বস্তির তপ্ত বাতাসটুকু বের করে দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল।

টানা তৃতীয়দিন ছেলেটাকে বাড়ির সামনে দেখে বেশ বিরক্ত হলো মনা। আবার তার দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে ওর বিরক্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেলে উঠে ভেতরে চলে যেতে পা বাড়াল।

তক্ষুণি পেছন থেকে ছেলেটা বলল, দুঃখিত মনা, একটু শুনো। ছেলেটা ওকে নাম ধরে ডাকায় থেমে গেল মনা, কিছুটা আশ্চর্যও হলো!
একগ্লাস পানি পান করাতে পারবে?
আপনি? প্রশ্ন করলেও ছেলেটার চোখ দুটো খুব চেনা মনে হলো মনার।
আমি আকাশ।
একটু যেন কেঁপে উঠল মনা! সেই দুটো চোখ, কিন্তু মুখটা কেমন অচেনা লাগছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মনার মা রাহেলা খানম।অসহিষ্ণু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাই কে তুমি? গতকালও একবার তোমাকে বাড়ির সামনে দাঁড়ায়া থাকতে দেখছি।

আকাশ একটু লজ্জা পেল। ছোটোবেলায় এ বাড়িতে প্রায়ই আসত সে। রাহেলা কাকিমার হাতের কত মজাদার খাবার খেয়েছে! বলল, কাকিমা, আমি তালুকদার বাড়ির ছেলে, আকাশ।

আকাশ! মানে আতা ভাইয়ের ছেলে আকাশ? তোমার চেহারা এমন হইছে ক্যান? আস আস, ভিতরে আস।বস।
কাকিমা, একটু পানি পান করব।
আগে এইখানে বস বাবা। কতদিন আস না।কাকিমা রে তো ভুলেই গেছ।ময়না, যা তো মা, তোর ভাইয়ার জন্য কিছু নিয়া আয়।

রাহেলা খানমের এই এক ব্যাপার যা মনার খুব অপছন্দ।এমনিতে সারাদিন মনাকে মনা ডাকলেও বাড়িতে কেউ এলেই ডাকেন ময়না! একে তো মনার নামটা তেমন পছন্দ নয় তার ওপর ওর মা সবসময় এমন করে! এ নিয়ে ও অনেক রাগারাগিও করেছে, কিন্তু রাহেলা খানম এই ভুলটা নির্ভুলভাবে করেন!

ফিরে এসে মনা বলল, ভাইয়া, ভেতরে আসুন।
রাহেলা খানম বললেন, কারেন্ট তো নাই, ভিতরে গরম।ওকে এইখানেই এনে দে, বাতাসে বসে আরাম করে খাক।
মনা তা-ই করল, ট্রে-টা বারান্দাতেই এনে দিল।

পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আকাশ মনাকে প্রশ্ন করল, তুমি এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে না?
জি না ভাইয়া, এখনো একাদশেই আছি।ছুটির পর ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা হবে।
বাংলা প্রথমপত্রে কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পার, দেখিয়ে দেব। আমার নোটগুলো বাড়িতে থাকবার কথা, প্রয়োজনে নিতে পার।

আকাশের ভাষা, উচ্চারণ, চলনবলন এবং শরীরে এমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখে মনা ও রাহেলা খানম দুজনেই বেশ অবাক!
বাড়ির ভেতর থেকে মনা-র ছোটোভাই মেহেদীর ডাকাডাকি শুনে রাহেলা খানম উঠতে উঠতে বললেন, তুমি বস বাবা, আমি আসছি।

এবার যেন সঠিক সময়টা পেল আকাশ।দুজনের একলা থাকবার এই ছোট্ট অবসরটুকু সে কিছুতেই নষ্ট করতে চায় না।তাকে জানতেই হবে মনার মনোভাব।

সময়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল ছেলেটাও মন দেওয়া-নেওয়ার বিষয়ে কথা বলা শুরু করতে মিনিট খানেক সময় নিয়ে ফেলল। তারপর আরও একবার বুকের ভেতর জমা হওয়া অস্বস্তির বাতাসটুকু বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার হৃদয় বাতায়নে দখিনা বাতাস কোন সুর শুনিয়ে যায়?

মনাও আন্দাজ করছিল এই ফাঁকে আলাপ হয়ত এদিকেই মোড় নেবে। কিন্তু মশাইকে সে এত্ত সহজে ধরা দেবে না। উত্তর দিল, যমুনার পারে থাকি তো, আমি কেবল ওর শোঁ শোঁ আওয়াজই পাই!
সে কখনো প্রেম যমুনার নয়?
মনা লজ্জায় লাল হয়ে গেল এবং আগের মতোই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।তবে এবার চুপচাপ এবং আড় চোখে নজর রাখল তার মা হঠাৎ ফিরে আসে কিনা!
ওর মৌনভাব আকাশকে খুব একটা বিচলিত করল না। সে জানে, কোনো মেয়েই সহসা এর উত্তর দিতে পারে না।সে এবার আরও একটু এগোলো, হৃদয়ের চোখ তুলে এখনো আকাশ দেখতে পাও, সেই দশম শ্রেণির সময়ের মতো?

মনা কাঁপা কাঁপা গলায় বিস্ময় প্রকাশ করল, তখন আপনি বুঝতেন!
হুম।অবশ্য সেই আমি অন্য আমি ছিলাম।
মনা মনে মনে বলল, সে-তো দেখতেই পাচ্ছি!
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার একটু অধৈর্য হলো আকাশ।হাতে সময় কম।স্বরে গাঢ়তা ঢেলে বলল, আকাশ তার বুকে ময়না পাখির ওড়াউড়ি দেখতে ব্যাকুল!পাখিটির উড়তে ইচ্ছে করে কি?

কথাগুলো মনার হৃদয় দরজায় বসন্ত বাতাসের স্পর্শ দিয়ে গেল।কিন্তু হুটহাট করে দরজা খুলে দেবার ঝুঁকি অনেক বেশি, তা মনা এখন বুঝে। তাই সে মৌন মুহূর্ত আরেকটু প্রলম্বিত হতে দিল এবং পরক্ষণেই তাদের একান্তে কথা বলবার সময় ফুরিয়ে এল।

রাহেলা খানম ফিরে এসে দেখলেন আকাশের সামনে প্লেটের খাবার তেমনি পড়ে আছে।বললেন, তুমি তো কিছুই খেলে না বাবা!
জি না কাকিমা, আজ কিছু খাব না। অন্যদিন এসে আপনার হাতের বিখ্যাত চিংড়ি মাছের মালাইকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে যাব। এখন উঠি।

ওমা! এখনো তোমার মনে আছে? এস একদিন।তোমার মাকেও নিয়ে এস।
রাহেলা খানম ফিরে আসবার পর থেকেই মনা নিজের সাথে নিজে বুঝাপড়া করছিল।আকাশ উঠে পড়লে সে ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে আস্তে করে বলল, আপনি আবার আসবেন।

আকাশ অবশ্য মনার দিকে না তাকিয়েই হ্যাঁ বলে দিল। যদি সে-ও তাকাত তাহলে ধরেই নিত কিছুক্ষণ আগে মনাকে করা প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে এবং উত্তরটা ‘হ্যাঁ’!

সেই থেকে শুরু।তারপর অনেক সময় বয়ে গেছে, যমুনায় অনেকটা জলও বয়ে গেছে, আর ওদের সম্পর্কও পেয়েছে নতুন মাত্রা।জনপ্রিয় জুটি ব্রাড পিট-অ্যাঞ্জেলিনা জুলির যৌথ নাম ‘ব্রাঞ্জেলিনা’র অনুসরণে বন্ধুরা ওদের নাম দিয়েছে ‘মনাকাশ’।যমুনার পারে, বিলের ধারে এবং কলেজ মাঠের পূর্বকোণার কড়ইতলায় ওদের দুজোড়া পায়ের ছাপ পড়েছে বহুবার এবং বহু স্বপ্নকথার সাক্ষী হয়েছে ওগুলো!

একসময় দুজনের গার্ডিয়ানের কানেও পৌঁছে গেছে ওদের চলাফেরার কথাবার্তা। মকবুল হোসেন খান ও আতাউর রহমান তালুকদারের মধ্যে কৈশোর থেকেই বন্ধুত্ব। ফলে তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে মনে করে প্রথমদিকে কেউ-ই বিষয়টা তেমন গায়ে মাখেননি। কিন্তু বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মন্তব্য শুনতে শুনতে মনার বাবা তার স্বভাব বিরুদ্ধভাবে ওর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করলেন। জানিয়ে দিলেন, কোনোভাবেই যেন ও আর আকাশের সাথে না মিশে। কলেজ খুললে তিনি নিজেই বাইকে করে ওকে আনা-নেওয়া করবেন, তার আগ পর্যন্ত সে যেন বাড়ির বাইরে না যায়!

আকাশের বাবাও শেষ পর্যন্ত আকাশের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। তালুকদার বাড়ির অহং থেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, তুমি তালুকদার বাড়ির ছেলে হয়ে একজন মুদি দোকানির মেয়ের সাথে কীভাবে মিশলে আমি ভেবে পাই না আকাশ! হোক না ওরা খান বাড়ির, কিন্তু ওর বাবা তো পেশায় মুদি দোকানি!

আকাশও বিস্ময় চেপে রাখেনি, মকবুল কাকা না তোমার ছোটোবেলার বন্ধু!
আরে, অমন সামাজিক বন্ধুত্ব তো অনেকের সাথেই আছে!
তাই বলে কাকা কোনোমতেই মুদি দোকানি নন! তার আরও ব্যবসা আছে তো।
তর্ক করো না আকাশ।মকবুলকে তুমি আমার চেয়ে বেশি চেনো না নিশ্চয়ই? ..তোমার ছুটি কবে শেষ?
উত্তর না দিয়ে সরে গেল আকাশ; কিছুটা রাগে আর কিছুটা বিপদের গন্ধ পেয়ে। তবু বিপদ ওর পিছু ছাড়ল না। কারণ ওর বাবা আতাউর রহমান তালুকদার এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ব্যাপারটা খুব সহজে মিটে যেতে দিলেন না! ফলে মনাকাশের জীবনে নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে গেল।সব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চলা কারোর পক্ষেই সম্ভব হয় না। ওরাও পারল না।

গ্রীষ্মের ছুটি শেষে কঠোর নজরদারির ভেতরই মনার কলেজে যাতায়াত শুরু হলো।আকাশকেও ফিরে যেতে হলো ক্যাম্পাসে।কিন্তু ‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’ কথাটিকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে ওরা মনের দিক থেকে যেন আরও বেশি কাছে চলে এল।দূরত্ব, ওদের দুজনার কাছে আসবার ক্ষেত্রে বাঁধা না হয়ে বরং দুর্দমনীয় সাহস যোগাল! আর সেই সাহসে ওরা বিপজ্জনক একটা পথে পা বাড়াল এবং অবিশ্বাস্যভাবে ওদের সহায়তায় এগিয়ে এলেন দুজনের মা!

মনার মা রাহেলা খানম যেমন মন থেকেই আকাশকে পছন্দ করেন তেমনি আকাশের মা মিতা হকও মনাকে পছন্দ করেন।দুজনেই স্বামীর বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন।ছেলে-মেয়েদের ব্যাপারেও তাদের মতামত ভিন্ন।তাদের একান্ত ইচ্ছে ছেলে-মেয়ের হাত ধরে বন্ধুত্বের পুরনো সম্পর্কে নতুন রং মাখাবেন।তাই তারা নিজেদের লোকের আড়ালে দেখা করেছেন দুজন।বহুদিনের না বলা বহু কথা বিনিময় করেছেন দুজনে; যাতে বেদনা ছিল, মনোকষ্ট ছিল, ছিল অনেক অনেক দীর্ঘশ্বাস!

বাড়িতে ফিরে মিতা হক তার স্বামী আতাউর রহমান তালুকদারকে বুঝিয়েছেন।বলেছেন, ওরা এ যুগের ছেলে, ওদের পছন্দের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করা উচিত।তাছাড়া মনা ভালো মেয়ে এবং দেখতে শুনতেও চমৎকার! আপনাদের এতদিনের বন্ধুত্ব এই উপলক্ষে আরও গাঢ় হবে ইনশাল্লাহ।

আতাউর রহমান তালুকদার চিবিয়ে বলেছেন, বন্ধুত্ব! মুদি দোকানির জাতে উঠার শখ আমি মিটিয়ে দিব!
বন্ধুত্বে কালিমা লেপনের চেষ্টা করলে তার কিছুটা নিজের গায়েও লাগে তালুকদার সাহেব! এ কথা ভুলে যাবেন না।এই তো শুরু হয়ে গেল হক ম্যানশনের লাইব্রেরির জ্ঞান বিতরণ কার্যক্রম! কালিমা লেপন কী, হ্যাঁ? ও মুদি দোকানি নয়?
এই টিপ্পনিটা প্রায়ই কাটেন আতাউর রহমান তালুকদার; মিতা হক-কে তার বাবার বাড়ি ‘হক ম্যানশন’-এর লাইব্রেরি বলেন!

মিতা হক বলতে চাইলেন, আমাকে টিপ্পনি কাটবার আগে একবার ভেবে দেখুন, তালুকদার বাড়িতে সম্পদ অর্জনের জন্য যত চর্চা হয় জ্ঞান অর্জনের জন্য তার সিকি ভাগও চর্চা হয় না।কিন্তু তার রুচিতে বাঁধল বলে উত্তর দিলেন, মকবুল ভাইয়ের মুদি দোকান আছে সত্যি।তবে এখন তো তার তিন-চার ধরনের ব্যবসা, মন্দ তো নয়!

রাহেলা খানম সেই রাতেই মকবুল হোসেন খানকে অনুরোধ করেছেন যেন মনার ওপর থেকে অতিরিক্ত নিয়মের বেড়াজাল সরিয়ে নেন এবং লোকের কুকথায় কান না দেন।যাতে মেয়েটা স্বস্তিতে পড়াশোনা করতে পারে।

তারপর সাহস করে এও বলেছেন যে, তার খুব ইচ্ছে বন্ধুভাবাপন্ন দুটো পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন হোক!
মকবুল হোসেন খান অন্ধকার ঘরের সুইচবোর্ডের ইন্ডিকেটর লাইটের লাল আলোর দিকে তাকিয়ে বলেছেন, তালুকদার গাড়লটা আমাকে সরাসরি কিছু না বলে লোকের কাছে যে বদনাম ছড়াচ্ছে তার সমুচিত জবাব দেবার কথা ভাবছি আমি! আমার মাথায় নতুন সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তাভাবনা নেই! তারপরই রাহেলা খানম ও মিতা হক দুজনে মিলে দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন পারিবারিক সিদ্ধান্তের পুরোপুরি বিপরীতে!

সেদিন শেষ বিকেলে আকাশভরা মেঘ মাথায় নিয়ে আকাশ তালুকদার ঢুকেছিল হক ম্যানশনে।ওর মা মিতা হক দুপুরের আগেই পৌঁছে গেছিলেন।হক ম্যানশনের সবার প্রিয় লাইব্রেরিতে বসে মা-ছেলের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল।আলোচনা শেষে মিতা হক কল দিয়েছিলেন মনার মা রাহেলা খানমকে।পুরো পরিকল্পনা জানিয়ে বলেছিলেন, মনে রাখবেন সন্ধ্যার পরপরই আমাদের অসুস্থতার অভিনয় শুরু করতে হবে।

জি আপা, মনে থাকবে।আমার মনে হয়, আপনার ফিরে আসার সময় হইছে।
জি, আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব।আপনি সাবধানে থাকবেন এবং মনে সাহস রাখবেন।
সন্ধ্যার পরপরই দুই বাড়িতে দুজন মা-র অসুস্থতার অভিনয় শুরু হয়ে গেল।সাথে শুরু হয়ে গেল টুপটাপ বৃষ্টি, মেঘবতীর অঝোর কান্না! অবশ্য সন্ধ্যার আগেই রাহেলা খানম গোপনে মনার প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড়, গহনাপত্র ও কিছু টাকা ব্যাগে ভরে দিয়েছেন।আর মিতা হক তো বিকেলে ফেরার আগেই ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে এসেছেন এক বান্ডিল টাকা ও নিজের বিয়ের কিছু গহনা।

আকাশের কয়েকজন বন্ধু দুপুরের পরপরই বেরিয়ে গেছে সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে।আয়োজন বলতে, মনাকাশ এর বিয়ের আয়োজন! তবে সেটা হবে যমুনার জলে ভাসতে ভাসতে অর্থাৎ ইঞ্জিনচালিত বড়োসড় একটা নৌকায়!

রাত বাড়ছে।বৃষ্টি থেমে গেছে।আকাশে চলছে আষাঢ়ে পূর্ণিমার জোছনাভরা চাঁদের সাথে মেঘেদের লুকোচুরি।পরিকল্পনা অনুযায়ী আকাশের বন্ধুরা কিলোমিটার খানেক উজানের ছোট্ট একটা ঘাট থেকে নৌকায় উঠেছে কাজী সাহেবকে নিয়ে।নৌকার ছইয়ের ভেতরে আকাশি রঙের কাপড় দিয়ে ওরা দারুণ একটি বাসরঘর বানিয়ে ফেলেছে! পুষ্পশয্যাও প্রস্তুত।এখন পাত্র-পাত্রীদের উঠিয়ে নিতে নৌকা এগোচ্ছে মনাদের বাড়ির পাশের বড় ঘাটের দিকে।

রাতের ঘড়ি দশটার ঘর স্পর্শ করলে অভিনয়ের চূড়ান্ত অংকে পৌঁছল রাহেলা খানমের অসুস্থতার নাটক! হঠাৎই অভিমানভরা কণ্ঠে বললেন, আমার কোনো ধরনের অসুখ কারোর তেমন গায়ে লাগে না! নিজেকে তাই এ সংসারের ভাঙ্গা কুলার মতো মনে হয়!

তিনি শুয়ে আছেন।মকবুল হোসেন খান তার পাশে বসে টিভির সংবাদ শিরোনামে নজর রাখছিলেন।আগামী কয়েকদিন উজানে টানা ভারী বর্ষণের এবং তারপর বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভাবছেন, মুদি দোকানে শুকনো খাবার ও দুর্যোগকালীন প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্রের মজুদ বাড়িয়ে দিতে বলবেন।তাছাড়া ত্রাণ দেওয়ার মোটা চাল, ডাল, লবণ এবং খোলা তেলের মজুদও বাড়াতে হবে।দুর্যোগকালে সবার অসুবিধা হলেও তার মতো বড় ব্যবসায়ীর ব্যবসা আরও বাড়ে!

তার এসব ভাবনার ভেতরে রাহেলা খানম কথাগুলো বললেন বলে তিনি পুরোপুরি শুনতে পাননি। জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে? কী ভাঙ্গা কুলার মতো মনে হয়?
এই যে, তোমার পাশে শুয়ে আছে যে অপদার্থটা আমি তার কথাই বলছি!
এবার টিভি থেকে চোখ সরিয়ে স্ত্রীর দিকে পুরো মনযোগ দিতে বাধ্য হলেন মকবুল হোসেন খান। রাহেলা খানমের এমন অভিমানভরা কণ্ঠ তিনি বহুদিন পর শুনলেন! বললেন, শেষমেশ আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ? ঠিক করে কিছুই তো বললে না তোমার কেমন লাগছে!

কে কখন ঠিক করে জিজ্ঞেস করল?
থাক।দাঁড়াও, জব্বারকে ফোন করি।
ডা. জব্বার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।প্রথম কলেই তাকে পেয়েও গেলেন।
হ্যালো ডাক্তার, তুমি চেম্বারে আছ তো?
আরে না, আমার কিছু হয়নি। রাহেলা একটু অসুস্থ। ওকে নিয়ে এক্ষুনি তোমার চেম্বারে আসছি।
মনা ও মেহেদীকে বাড়িতে রেখে রাহেলা খানমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মকবুল হোসেন খান।তিনি অবশ্য জানেন না যে, তালুকদার বাড়িতে তখন তৈরি হচ্ছেন আতাউর রহমান তালুকদার।মিতা হককে নিয়ে তিনিও যাবেন ডা. জব্বারের কাছে! কিন্তু রাহেলা খানম জানেন! জানেন মিতা হক-ও! তারা এ-ও জানেন যে, খান বাড়ির পাশের ঘাটে ভিড়েছে ইঞ্জিন চালিত বড়োসড় একটি নৌকা!

খান বাড়ির সুখী দম্পতি পৌঁছানোর কয়েক মিনিট পরেই তালুকদার বাড়ির সুখী দম্পতিও পৌঁছে গেলেন ডা. জব্বারের চেম্বারে। কিন্তু দুই কর্তার দৃষ্টি বিনিময়ে অসুখী একটা পরিবেশ তৈরি হলো সেখানে! মনাকাশের ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবার পর এই প্রথম মুখোমুখি দুজন!

ডা. জব্বার দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।তিনি এই দুই পরিবারের তার প্রিয় সদস্যদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
মফস্বল শহরে রাত আটটা-সাড়ে আটটার পর তেমন কোনো রোগী আসে না। সাধারণত ন’টার মধ্যে তিনি উঠে পড়েন।কিন্তু আজ তার ওপর গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।বিকেলের দিকে তালুকদার বাড়ি ও খান বাড়ির দুই কর্ত্রী ফোন দিয়ে তাকে সবিস্তারে জানিয়ে দায়িত্বটা দিয়েছেন। দুজনের কথার সারাংশ হলো, লোকের কথা কানে তুলে আতাউর রহমান তালুকদার ও মকবুল হোসেন খান তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরিয়েছেন! তার কাঁধে দায়িত্ব বর্তেছে সেই ফাটল বুজে দেবার!

ডা. জব্বার তার সহকারীকে বললেন দুই রোগীকে ভেতরের রুমে নিয়ে তাদের কেইস হিস্ট্রি নোট করতে।তার সামনের দুটো চেয়ারে গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন আতাউর রহমান তালুকদার ও মকবুল হোসেন খান। অনেক ভেবেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে দুজনেই ভাবলেন দুই কর্ত্রীর একই দিনের মোটামুটি একই সময়ে একই ধরনের অসুখ হওয়াটা কাকতালীয় ঘটনা!

কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পর একটা কল এলো মকবুল হোসেন খানের মোবাইলে।এই পুরো সময়টায় তিনি একটা কথাও বলেননি! তালুকদার সাহেব দু’বার চেষ্টা করেছেন কিছু বলতে, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়েছেন ডা. জব্বার।দুই বন্ধুর মধ্যে বিভেদের যে রূপ নিজ চোখে দেখছেন তা মুছে আবার আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট তিনি।

খান সাহেব কলটা রিসিভ করলেন, মেহেদীর কল।
হ্যালো আব্বা, আপু নাই!
নাই মানে? কি বলিস?
হ, আপু বাড়িতে নাই। আমি অনেকক্ষণ ধইরা খুঁজতেছি, পাই না!
ফোন দিস নাই?
ফোন বন্ধ আব্বা।
দাঁড়া, আমি দেখছি।ফুলি কোথায়?
ও ঘুমায়া পড়ছিল, ডাইকা তুলছি। কিন্তু ও কিছুই বলতে পারে না। আমার সাথে ফুলিও খোঁজাখুঁজি করল।
রাখ, আমি আসছি।

কথা বলতে বলতে মকবুল হোসেন খান মোটরসাইকেল চালু করে ফেলেছেন এবং চলতে শুরু করলেন বাড়ির দিকে।বেমালুম ভুলে গেলেন যে, স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ডা. জব্বারের চেম্বারে এসেছেন!
তার মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা।মনা দেখতে হয়েছে অনেকটা তার বড়ো মা মানে দাদীর মতো! তাঁর নাম ছিল ময়নামতি খানম। বড়ো মা-র কাছে শুনেছেন, তার দাদামশাই জ্বীন-ভূত লালন পালন করতেন! ওদের নিয়ে দাদা মশাইয়ের নানান ভয়ংকর কর্মকাণ্ডের গল্প করতেন বড়ো মা।

ছোটোবেলায় মকবুল হোসেন খান তার বড়ো মা-র কথাগুলো বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বড়ো হয়ে সেসব মনে পড়লে তিনি মনে মনে হাসতেন। তবে একথাও সত্যি, বড়ো মা-র অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা তিনি দেখেছেন। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে বড়ো মা-কে খুব অচেনা মনে হতো। তাছাড়া এলাকার লোকজনও বলাবলি করত, খান বাড়ি’ত সত্যই জ্বীন-ভূত আছে।

তাই তো ঐ বাড়ি’ত কখনো চোর-ডাকাত ঢুকতে সাহস পায় না।
একবার একদল ডাকাত বিশাল নৌকা নিয়া হাজির হইছিল ঘাটে।কিন্তু খান বাড়ি’ত ঢুকতেই বড়ো খান সাবের পালিত জ্বীনগুলা কয়েকটার ঘাড় ভাইঙ্গা দিলে বাকিরা কোনমতে পালায়ে বাঁচছে।

ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে বড়ো মা তাকে বলেছেন, ডাকাতরা খালি টাকাপয়সা, জিনিসপত্র নিলে তোর দাদা মশাই কিছুই বলতেন না।কিন্তু ওদের একজনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া! লোকটারে আমি চিনতে পারছিলাম, আর হয়ত তো দাদাও।সে আমার হাত ধরে টান দিতেই তিনি শান্ত কিন্তু কঠিন স্বরে বলছিলেন, ওকে-সহ কয়েকজন রে খতম করে দে! শুনে আমি কেঁপে উঠছিলাম।একটু পর তার বড়ো মা অল্প হেসে আরও বলেছিলেন, আসলে তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চট করে রাহেলা খানমের কথা মনে পড়ল মকবুল হোসেন খানের। ‘আরে, আমি তো ওকে চেম্বারে ফেলে এলাম!’ বিড়বিড় করতে করতে গাড়ি থামালেন তিনি। প্রায় কিলোমিটার খানেক চলে এসেছেন। ভাবলেন ফিরে গিয়ে রাহেলাকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ডা. জব্বারকে ফোন করে বললেন, শোনো ডাক্তার, তোমার ভাবীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

তুমি হঠাৎ কোথায় চলে গেলে? ডা. জব্বার অবাক হলেন।
একটা ঝামেলা হয়ে গেছে! পরে সব বলব।শোনো, মিতা ভাবী আছেন না? রাহেলাকে না হয় তার সাথেই পাঠিয়ে দিও। আমি ওই বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যাব।

আর সময় ব্যয় না করে বাড়ির দিকে ছুটলেন মকবুল হোসেন খান।
তার বাবা মোবারক হোসেন খান বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছেন। তাঁকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ছেলে ফিরেছে বুঝতে পেরেও জিজ্ঞেস করলেন, মকবুল এলি?
জি আব্বা।আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে বসে আছেন কেন?
দুশ্চিন্তা হচ্ছে! চোখে কম দেখি নয়ত মনাকে খুঁজতে বের হতাম। মনার মা?

ওকে ক্লিনিকেই রেখে এসেছি আব্বা। জব্বার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। মেহেদী? মেহেদী!
মেহেদী উত্তর বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে নদীর ঘাট আর পশ্চিমপাড়ায় খু্ঁজতে গেছে। কিন্তু আমার মন অন্য কথা বলছে মকবুল।
মকবুল হোসেন খান মেয়ের ফোনে ট্রাই করছেন।বন্ধ বলছে! এবার তিনি মেহেদীকে কল দিয়ে তার বাবাকে বললেন, বলেন, কী মনে হচ্ছে আপনার?
আজ কি পূর্ণিমা?
জি আব্বা, কেন?
এটা কোন মাস?
জুন। মকবুল হোসেন খান মনে মনে বিরক্ত হচ্ছেন তার বাবার এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে! মেহেদী ফোন ধরেছে।তিনি ওকে বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।
আরে, ইংরেজি না বাংলা কোন মাস? মোবারক হোসেন খান আবার প্রশ্ন করলেন তার ছেলেকে।

আষাঢ় মাস আব্বা, আজ আষাঢ়ে পূর্ণিমা।সাথে সাথে তার মনে পড়ল বড়ো মা-র কথা! তিনি বারান্দায় ঢুকে পড়া জোছনায় তার বাবার মুখের পরিবর্তন দেখে কাঁপন লাগা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আব্বা, আপনি কি ওই আশংকা করছেন?
হতে পারে। ১৯৩৯ থেকে ২০১১, কত হলো? ৭২ বছর না?
জি আব্বা।
আম্মা বলে গেছিলেন একশত বছরের মধ্যে ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনি সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন প্রথম ছত্রিশ নয়তো দ্বিতীয় ছত্রিশ মানে বাহাত্তরতম বছর! প্রথম ছত্রিশে মানে ছত্রিশতম বছরে আমাদের পরিবারের কেউ ষোড়শী থেকে অষ্টাদশী ছিল না।কিন্তু বাহাত্তরতম বছরে সেটা মনা-র সাথে মিলে গেছে।তুমি লোক পাঠাও মকবুল, ওরা যমুনাতেই আছে!

টানা কথা বলে হাঁপাচ্ছেন একাত্তর বছরের মোবারক হোসেন খান।সাথে যোগ হয়েছে বাহাত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার পুনরাবৃত্তির উত্তেজনা! ফলে তাঁর শরীর কাঁপছে।
অল্প অল্প কাঁপছে মকবুল হোসেন খানের শরীরও!
তক্ষুণি মেহেদীরা ফিরে এলে তিনি উত্তেজনায় স্বভাব বিরুদ্ধভাবে চিৎকার করে বললেন, তালুকদারের ছেলের মোবাইল নম্বরটা আমাকে দে মেহেদী।আর দু-তিনটা নৌকা রেডি কর, যমুনায় যেতে হবে! ওরা এখনো খুব বেশি দূরে যেতে পারেনি!
চলবে..