শেষ পর্যন্ত ওদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি।জসিম সর্দার হাতের ইশারায় সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, গায়ের শক্তি এবার ভালা কামে নাগাও বাহে।
কেউ একজন ক্ষোভ ঝেড়েছিল, আর আমাগো বাড়ির এক ছেমড়ি রে যে পাগলী করে থুয়ে যাইচ্চে তার বিচার হবি নে?
বিচার! হ, বিচার ত’ করাই নাগবি, তয় পরের না ঘরের মাইনষের।
তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকে ডেকেছিলেন, ময়নামতি, ময়নামতি।
ময়নামতি যে ঘরে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন তিনি সেই ঘরে ঢুকতেই তার স্ত্রী দুহাত প্রসারিত করে সামনে দাঁড়িয়ে গেছিলেন এবং বলেছিলেন, মেয়েটা সেই তখন থেকেই খালি কাঁদতিছে।আপনে ওরে বকাবকি করতে পারবেন না।
তুমি আমারে অতো বেরহম ভাবতিছ ক্যা? আমি অর সাথে কতা কইতি চাই। শুনি ময়না কী কয়।
ময়নামতি কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলেন, আপনে আমাকে অনুমতি দেন আব্বা, আমি তার কাছে যাই।
পাগল হইছ মা। সে অচেনা যুবক, চইলা গেছে।
না আব্বা, তিনি আমার অপেক্ষায় ঘাটে বসে আছেন।
জসিম সর্দার বা তার স্ত্রী, কেউ-ই মেয়েকে ঠিকঠাক চিনতে পাচ্ছিলেন না। ময়নামতি অন্যরকম স্বরে কথা বলছিলেন।
ময়নামতির মা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোকে কে বলল?
উত্তর বাড়ির কালু কাক্কুর ছেলে।
অথচ কালু মিয়ার ছেলেকে কেউ ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখেনি। সে ডাকাতিয়া ঘাট থেকে সোজা ওর বাড়িতে চলে গেছিল।
ময়নামতির মা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলেন।আর বাড়ির ভেতরের উঠোন থেকে কেউ কেউ বলেছিলেন, ঐ ছেমড়া কবরেজ, ময়নারে তাবিজ করিছে।
না রে কবরেজ না, যাদুকর।পাড়ার হগল রে যাদু করিছে।
হ হ, ঠিক। বড় কবরেজ ডাকা নাগবি।মন্ত্র কাটাইতে হবি।
জসিম সর্দার অবশ্য ওসব বিশ্বাস করেননি।তিনি বড়ো খান সাহেবের চোখে-মুখে অন্যরকম আলো দেখেছিলেন।দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলেন, বড়ো কঠিন সিদ্ধান্ত।
চল মা, ত’রে নিয়া ঘাটে যাই।
ময়নামতির মা তার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, কী বলছেন আপনে।
ময়নামতি আগের মতোই অন্যরকম স্বরে বলেছিলেন, ওনার ইচ্ছে, আমি একলা যাই।
শেষ পর্যন্ত ময়নামতি একাই হাঁটা দিয়েছিলেন ঘাটের দিকে।ততক্ষণে মাগরিবের আযান শেষ হয়ে গেছিল।কাউকে তার সাথে নিতে রাজি হননি ময়নামতি। শুধু শত নিষেধ স্বত্তেও পিছু নিয়েছিল তার চাচা তো ভাইটা। সে তার শেষ চেষ্টাটুকু করতে বদ্ধপরিকর।
ঘাটের কাছাকাছি গিয়ে তারা দেখেছিলেন তিনি নামাজ পড়ছেন।আরও কয়েক পা এগিয়ে যেতেই সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করেছিলেন তিনি।
ময়নামতি শেষ পর্যন্ত তার হাত ফসকে চলে যাচ্ছে দেখে চাচা তো ভাইটা মরিয়া হয়ে তার বাহুতে হাত দিতেই তিনি চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। আর সাথে সাথে কোত্থেকে এক ঝাপটা বাতাস এসে ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে সাত-আট হাত দূরে ফেলে দিয়েছিল। অথচ চারপাশের পরিবেশ আগের মতোই শান্ত ছিল।আর ময়নামতির কেবল ঘোমটা খুলে গিয়ে চুলগুলো উড়ছিল।
ময়নামতি একটু ঘুরে অবাক চোখে একবার তার চাচা তো ভাইকে দেখে ফের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে পৌঁছে গেছিলেন মানুষটার কাছে।
সে রাতে আষাঢ়ে পূর্ণিমার জোছনায় ঝলমল করছিল যমুনার জল, আর তাতে ময়ূরপঙ্খি নায়ে পূর্ব পারের দিকে এগিয়ে চলেছিলেন বড়ো খান সাহেব ও ময়নামতি।
মাঝ নদীর একটা চর থেকে একজন হুজুর এবং আরও চারজন মানুষ উঠিয়ে নিয়েছিলেন বড়ো খান সাহেব।তারাই সেই রাতে যমুনার জলে ভেসে চলা সেই নায়ে তাদের দুজনকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন।
পরদিন সূর্যোদয়ের আগে আগে যমুনার জলের স্পর্শে ঘুম ভাঙলে ময়নামতি দেখেছিলেন তিনি তার স্বামীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন অচেনা একটি ঘাটে।লজ্জা পেয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন, একটু দূরে বসে আছেন হুজুরসহ সেই চারজন।
এত বছর পর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় টালমাটাল খান বাড়ি। আর তার আঁচ টের পাচ্ছে তালুকদার বাড়ির লোকজনও।
মকবুল হোসেন খান যখন ফোনে আকাশ তালুকদারকে পেয়েছেন তখন ওরা যমুনার কিলোমিটার খানেক ভেতরে চলে গেছে।কাজী সাহেব লেখালেখির কাজও প্রায় শেষ করে ফেলেছেন।তিনি পাত্র-পাত্রীর পরিচয় পেয়ে আঁৎকে উঠেছিলেন এবং বিয়ের কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।অনুনয় করে বলেছিলেন, তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও।এ বিয়ে পড়ালে আমার অস্তিত্ব থাকবে না।
কিন্তু আকাশের বন্ধুরা তাকে বাধ্য করেছে।শেষ পর্যন্ত নিতান্ত অনিচ্ছায় খাতা খুলে প্রয়োজনীয় লেখালেখির কাজ গুছিয়ে এনেছেন তিনি।তখনই মোবাইলে নেটওয়ার্ক চলে আসায় মকবুল হোসেন খানের কলটা এসেছে আকাশের কাছে।তিনি খুব রাগারাগি করলেও আকাশ খুব একটা ভয় পায়নি।কিন্তু তক্ষুণি অন্য একটা মহাবিপদ ওদের নৌকার গতিরোধ করে দিল।একদল ডাকাতের কবলে পড়ল ওরা।
ডাকাত দলের সদস্যরা নৌকার ছইয়ের ভেতর বিয়ের আয়োজন দেখে বেশ অবাক হলো।দলটির সর্দার অস্ত্র দেখিয়ে ধমকে ধমকে ওদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা শুনল এবং জেনে নিল সকলের পরিচয়।তারপর কাজী সাহেবকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করল ছেলে-ছোকরাদের সাথে তিনিও তাল মিলিয়ে বিয়ে দিতে চলে এসেছেন বলে।ভয়ে কাঁপতে থাকা কাজী সাহেব একটা কথাও বলতে পারলেন না।
চলবে…