নিষ্প্রভার রঙ ফিরে পাওয়া (পর্ব-৩) ॥ ইসরাত জাহান


চিত্রশিল্পী: কাজী জহিরুল ইসলাম

সাজ্জাদের সকালের ঘুমটা ভাঙে লতিফ চাচার ডাকে। সম্পর্কটা ২৫ বছরের পুরানো হওয়ায় ছোট বাবা বলে ডাকেন তিনি সাজ্জাদকে। এক কথায় বলা যায় লতিফ নামের এই মানুষটা এই বাড়ির দুজন মানুষকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়, দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো। তবে পদবিটা তার কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান। অকৃতদার হবার কারণে সাজ্জাদকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন। তার কাছে সবসময় ছোট বাবার সাত খুন মাফ। হয়তো সে কারণেই ছোটবেলা থেকে সাজ্জাদের বাঁদরামিটা সবার থেকে এগিয়ে ছিলো এক ধাপ। প্রথমে তিনি সাজ্জাদকে ঘুম থেকে ডাকেন বেশ ধীরে ধীরে। পরে দরজায় বেশ কয়েকটা চাপড় দেন, সবশেষে দরজায় লাথি মারে বসে নিজের অজান্তে। বেগম সাহেবকে বেশি অসুস্থ হওয়ার কারণে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেন তিনি।

অনেক রাতে ঘুমানোর কারণে সকালের ঘুমটা কিছুটা গভীরই ছিলো সাজ্জাদের। তাই প্রথমে শুনতে পায় না, অনেকক্ষণ দরজায় আঘাতের পরে ওর ঘুমটা ভাঙে।

সাজ্জাদ বাবা, ছোট বাবা, তাড়াতাড়ি ওঠো। তোমার মায়ের শরীরটা আবার খারাপ করছে। হাসপাতালে নেওন লাগবো। কথাটা কানে যেতেই সাজ্জাদ পড়িমরি করে লাফিয়ে উঠে ঘুম থেকে। এতো সকালে মায়ের শরীর খারাপ! রাতে তো অনেক কথা হলো। তখন শরীরটাতো মোটামুটি ভালোই ছিলো অবশ্য একটু বিষণ্ন ছিলো। দরজা খুলতে খুলতে সাজ্জাদ গতকাল রাতের সময়টুকু মনে মনে ভাবে।

কখন থেকে অসুস্থ মা? কইতে পারি না, সকালে রাজিয়া চা দিতে গিয়া দেখে অর্ধেক শরীর খাটে অর্ধেক মাডিতে পইরা রইছে। এই কথা শুনতে শুনতে সাজ্জাদ ওর মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ে। গিয়ে দেখে মা অচেতন হয়ে পড়ে আছেন, দুজন কাজের মহিলা পায়ে তেল মালিশ করছে।

-আমাকে আগে ডাকবে তো, মাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমি গাড়ি বের করছি।
-বাবা ম্যাডাম তো অজ্ঞান, কেমনে নামামু?
কথা শোনার সাথে সাথে সাজ্জাদ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘তাহলে’?
তারপরই বলে,
-আচ্ছা দাঁড়াও। আমি আগে গাড়ি বের করছি। আমিই কোলে করে নামাবো। মহিলা দুজনেকে বলো মাকে একটু গুছিয়ে দিতো। আর ড্রাইভারকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলো। ওর জন্য অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।

এই কথা বলতে বলতে সাজ্জাদ এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে গ্যারেজে চলে আসে। মনে ভেতরে অশনিসংকেত ডাক দিতে থাকে,

‘মা ভালো হবে তো’

ওর বাবার ওপর প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে। স্বামীর অবহেলায় আজ মায়ের এমন অবস্থা। সাথে ঘিয়ে আগুন ঢালার মতো রাগ, অভিমান নামক উপকরণ। চাবির স্টাট বটনে চাপ দিতে দিতে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনো শারমীনকে অবহেলা করবো না। পরক্ষণই আশেপাশে তাকায়, ওর কথা আবার কেউ শুনে ফেললো কিনা। তবে এটা বুঝতে পারে, শারমীন এই মুহূর্তে ওর প্রতিটি রন্ধে রন্ধে ঢুকে পড়েছে। যা মায়ের অসুস্থতাকেও উপেক্ষা করে।

মাকে বাড়ি থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু সাজ্জাদ নিজের হাতে করে। তারপরে ফোন করে বাবাকে।শারমীন কিছুক্ষণ আংটিটি দিকে তাকিয়ে থাকে। কালো কার্বন থেকে সৃষ্ট এক টুকরো হীরে কত উজ্জ্বল। আংটি দিকে তাকিয়ে হীরের ভেতরে আলো পড়লে যে ধূসর ও ছাই রংয়ের আলোর ছটা ‘ব্রিলিয়ান্স’ আর বাইরের প্রতিফলিত রামধনুর রঙের আলো, যাকে বলা হয় ‘ফায়ার’ বলে সেটাই বোঝার চেষ্টা করে। কারণ জীবনে এই প্রথম ও কোন হীরা নিজের হাতে ছুঁয়েছে। শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষলে বোঝা যেতো আসল না নকল। কারণ এটাই হীরে চেনার সহজ পদ্ধতি। নকল হলে এই মুহূর্তেই ও বিয়েটা ক্যানসেল করে দিতে পারতো।

শারমীন আর কথা বাড়ায় না, অযথা বড় বোনের সাথে তর্ক করার কোন আর কারণ খুঁজে পায় না। শবনম ঠিকই বলছে, ওর কোনো ছেলেকেই ভালো লাগে না। কিভাবে লাগবে, ওর মনে ভেতরে তো শুধুই সেই ভার্সিটি প্লেয়বয় ছেলেটা।

‘কি রে তুই তো এখনই আংটির ভেতরে ডুবে গেলি। বিয়ের পর তো পুরোই শশুরবাড়ি আর তমালের ভেতরে ডুবে যাবি’।
শবনমের ডাকে শারমীন সমোহনীয় ফিরে পায়। বোনের কথায় কেন যেন ওর খুব রাগ হয়।
‘আমি যদি ডুবতে পারি, তাহলেই বেশি খুশি হবো। তোর মতে বাপের বাড়ি ওযথা বসে থাকবো না’।
‘কি…আমি এমনি এমনি বসে আছি। তুই কি জানিস না কেন বসে আছি? তুই জানিস না ওরা আমার সাথে কি কি করত’।
‘তুই ও ধোয়া তুলসী না আপা। তোরও অনেক সমস্যা আছে। আগে নিজেকে ঠিক কর। তারপরে অন্যের দোষ দিস। তুই আসলে ভালোবাসা নিতেও জানিস না দিতেও জানিস না’।
‘হুম, আমি না হয় দিতেও জানি নিতেও জানি না। তুই মনে হয় ভালোবাসার দোকান খুলে বসেছি? সেজন্যই তো একটাও প্রেম করতে পারলি না। দুনিয়ায় কোনো ছেলেকেই তোর ভালো লাগে না’।

অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খাবার টেবিলে বসতেই ওর মা আলেয়া খাতুন দৌড়ে আসে। এমনভাবে দৌড়ে আসে যেন আলৌকিক কিছু ঘটেছে আজ একটু আগে।

‘শারমীন, তমাল এসেছে। তমাল এসেছে। ’
‘তমাল কে?’
‘মানে, তোর কি মাথা ঠিক আছে? এইসব কি বলিস? তমাল কে মানে?’

শারমীন কিছু সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক দৃষ্টিতে, একটু পরে বুঝতে পারে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে।
‘মা, আমি মজা করছিলাম। এতো সকাল সকাল কেন এসেছে, তোমার হবু জামাই? কেউ কি অসুস্থ?
হবু বৌমাকে দেখেতে চায় শেষ নিঃশ্বাসের আগে।’
‘তোর মুখে আর কিছুই আটকায় না, তাই না? শবনম তোর থেকে ভালো। অনেক হিসাবনিকাশ করে কথা বলে।’
‘তোমার বড় কন্যার হিসাবের নমুনা আমাকে বলো না। নাশতা দাও।’
‘জামাইকে ডাকছি। একসাথে নাশতা কর। ছেলেটা ড্রয়িংরুমে চুপচাপ বসে আছে।’
‘মা চা দিয়ে আসো ওখানে। তাছাড়া সে এখনও জামাই হয়নি। আমার অস্বস্তি হবে। আর এসেছে কেন এতো সকালে?’
‘তোকে অফিস পৌঁছে দিতে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ বলবো! না মাশাআল্লাহ বলবো? না নাউজুবিল্লাহ বলবো। ঠিক বুঝতে পারছিনা মা’
‘এতো বুঝতে হবে না, তাড়াতাড়ি নাশতা করে, তমালের কাছে যা। তারপরে একসাথে অফিস যা।’

শারমীন কিছু সময় নাশতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে চুপচাপ টেবিল থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। কেন যেন আজ ওর আর অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না। কিভাবে এই ছেলের সাথে কথা শুরু করবে ভেবে পায় না।

শারমীনের তমালের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয় দুজনের। তমাল সাথে সাথে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ও ভেবে পায়না কি বলবে। তারপরে ভদ্রতার খাতিরে শুরু করে কথা নিজেই আগ বাড়িয়ে,যা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ।
‘আপনি এতো সকালে, কোনো সমস্যা কি হয়েছে বাড়িতে।’
‘জ্বি না।’
‘তাহলে?’
‘বাবা আপনাকে অফিস পৌঁছে দিতে বললো।’
‘আমি তো একাই যেতে পারি। কোনো দরকার নেই। আপনা শুধু শুধু কষ্ট করছেন’

তমাল আর কোন কথা বলে না। আবারও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শারমীন বের হবার জন্য পা বাড়ায় দরজার দিকে। তমালও শারমীনের পিছু নেয়। মনে মনে হাজার বার আল্লাহ নাম নিতে নিতে।গাড়ির ভেতরে দুজন বোবা প্রাণি নিজের স্বতার সাথে কথা বলতে থাকে। শারমীন খেয়াল করে তমাল বেশ ভালো গাড়ি চালায়। কিভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পায় না। অফিসে কাছাকাছি সেই মুহূর্তে শারমীন শুরু করে কথা।
-আপনি বেশ ভালো গাড়ি চালান।
-জি।
-আপনি কি কথা কম বলেন?
-জি
-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

শারমীন অনেক চেষ্টা করেও কথা আর এগিয়ে নিতে পারে না। আবার চুপ হয়ে যায়। তমাল নামক জি-বাচককে মনে মনে বকতে থাকে, আংটি টির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
‘আপনার কি অফিসে যাবার বেশি তাড়া আজ।’
জি?

জি-বাচককের কাছ থেকে কথা শুনতে পেয়ে শারমীনও জি-বাচক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে হঠাৎ করেই।

‘তাড়া না থাকলে আমরা কোথাও বসতে পারি। আপনি মনে হয় আজ সকালে নাশতা করেননি।
জি?
কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে থামে বনানী এগারোর একটি ফাস্ট ফুড দোকানের সামনে। গাড়িটা সাইডে পার্ক করে তমাল শারমীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দোকানে ঢুকে পরে। কিছুসময় পরে বের হয়ে আসে একটি চারকোনা প্যাকেট হাতে।

‘এতো সকালে আর কিছু পেলাম না। একটা বার্গার আছে’।
‘আমি এই সাত সকালে বার্গার খেতে পারবো না।’
‘পুরোটা না পারলে আমাকে অর্ধেক দিন। আমিও নাশতা খাইনি আজ সকালে।’

হঠাৎ করে শারমীন তমালের দিকে সরাসরি তাকায়। লোকটাও সকাল থেকে না খেয়ে আছে। কিছু মায়া হয় লোকটার প্রতি। প্যাকেট খুলে অর্ধেক বার্গার টিস্যুতে নিয়ে বাকিটা তমালের দিকে এগিয়ে দেয়।

সাজ্জাদ ওর মাকে স্কয়ার হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ঢোকানোর সাথে সাথেই ডাক্তারা নানারকম পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সানজিদা আহামেদর। সাজ্জাদ কিছু সময় ওর বাবার সাথে কথা বলে রাগের মাথায় ফোনটা ফ্লোরে আছাড় মারে। মুহূর্তেই ফোনটা তার ব্যাটারিকে ত্যাগ করে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থাকে ফাটা স্ক্রিন সেভার নিয়ে। লতিফ চাচা দৌড়ে এসে সাজ্জাদকে ধরে চেয়ারে বসায়। রাগে হুঁশ হারিয়ে ইংরেজিতে নিজের বাবাকে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করতে থাকে নীচু স্বরে। যার কোনটাই লাতিফের বোধোগম্য হয় না। তবে পঁচিশ বছর ধরে যেভাবে আগলে রেখেছেন তার সাজ্জাদ বাবা, ছোটো বাবাকে সেভাবেই আগলে রাখেন।

শারমীনের অফিসের সামনে এসে, তমাল বেশ দ্রুত দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আর অপলক দৃষ্টিতে অফিসের দারোয়ান গেটের দরজা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন আজ কোনভাবেই শারমীন আপার ক্লোন কপিকে অফিসে ঢুকতে দেবে না সেই পণ করে।

‘আমি বিকেলে আবার আসবো আপনাকে নিয়ে যেতে, কয়টার ছুটি হয় আপনার’
-রাত ১২টায়।
-ঠিক আছে, ৬টায় আসবো। আর কোন দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন। আমার ফোন নম্বর আপনাকে সেন্ট করেছি। চেক করুন।

শারমীন ইনবক্সে যে নম্বরটা পায় সেটা গতকালকের নম্বর নয়। তমালের কথা শুনতে শুনতে ভাবতে থাকে সেই ব্যাপারটা নিয়ে, গতকাল ওকে তাহলে কে মেসেজ দিলো। নিশ্চয়ই সাজ্জাদ। ওর ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন সাজ্জাদ নামক ব্যক্তির টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রতি আবার আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে। তাই আর তমালের সাথে কথা না বাড়িয়ে অফিসে ঢুকে পড়ে শারমীন। কিন্তু বিকেলে শারমীনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে বড় রকমের একটি চমক।
চলবে…