স্রোতের নামতা
ডালিম দানার মতো লাল লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দি রাধিকার স্তন। আর—
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।
জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।
আয় রজকিনী ঘাটে—রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনে—আয় তৃষ্ণা মেটাবি দিঘির।
জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফণা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালান্ধসন্ধ্যায়
বয়স্করাতের দিঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।
তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
উত্তরবাঁকের মেঘ
উত্তরবাঁকের মেঘে জ্বলে ওঠে চান্দের আন্ধার
জলসত্রে নোনা জল। নদীতে বৈশাখ।
দুই ফর্মা মেঠোপথে গলে পড়ে মুদ্রিত আকাশ!
এসো সখী রজকিনী, জলসত্র খোলো
হাঁটু গেড়ে বসে আছি হাছন-লালন।
অসুখী বয়সী রাতে ভেসে যাচ্ছি ধূলোস্রোতে আমরা কজন।
রাতগুলো ক্লান্তিহীন। সিলিংফ্যানের হাওয়ারা—
কেঁপে কেঁপে ঘুমুচ্ছে দেয়ালে।
শুধু আমরা কজন নির্ঘুম চাঁদের সঙ্গী।
বসে আছি পবিত্র নরকে। পান করে গলিত জোছনা আর তার
অপরূপা রূপ।
আমরা সমুদ্রগামী। বৃত্তাকার জলবৃন্তে জেগেছে বাতাস।
অসীম জটিল জলে ডুবছে হৃদয়।
আমার বুকের নদী ঢেউ তোলে আজ কারো তিল বরাবর!
পাড় ভাঙে। ঢেউ ভাঙে তোমার ঠোঁটের কোণে তীব্র আলিঙ্গনে।
চুম্বনে অনীহা বুঝি! চুলগুলো দ্রোহী হয়ে উঠছে এখন।
চুলগুলো মেঘরাতে বয়স্কশ্রাবণ।
কারা আজ পাঠ করে কুয়াশার শ্লোক?
একরত্তি স্বপ্নবাজ খরার মৌসুমে
নির্বিরোধী পঙ্ক্তির বাসর শয্যায়
ডেকে আনি বন্ধুদের দৃষ্টির অঙ্গার।
পৌরাণিক জলসত্র ভেসে যায় ঘুমন্ত নগরে।
আমাকে ডেকেছে দিঘি—জলের বাকল।
সন্ধ্যারে করেছি মানা বিচূর্ণ বাতাসে—
যেন তার খোঁপা থেকে আন্ধার না ঝরে
নিষেধ মানেনি সন্ধ্যা; শিখেছে ছলনা।
আকাশে ওড়ে না ফড়িঙ—পোড়ে না হৃদয়
রাধিকারা জলপরী পরকীয়া রাতে।
অনুজ্বল দিগন্তের ফ্রেমে বসে ছবি আঁকে সতর্ক স্বকাল।
আমার তুলিরা মৃত।
পাহাড়ের আন্ধারেরা পাথরের অশ্রু মুছে দেয়।
অযথা বিকেলগুলো নষ্ট হলে ঈর্ষাতুর মেঘের পাড়ায়—
আজ আর বৃষ্টি হবে?
বহুবার কবরের সুনসান নীরবতা ভেঙে আমি
জেগে উঠি—
জেগে ওঠা সমকালে অতীতের দ্রোহী ক্ষুদিরাম।
আমার সামনে দ্রুত হেঁটে যায় শহরের প্রধান সড়ক।
লাফিয়ে ওঠে ঘুমন্ত বাড়িগুলো।
উড়ে যায় জানালার কাঁচ।
ক্লান্তি জমে রঙহীন ধুলোর বিকেলে
আর ধূলিজোছনায় স্নান করে আয়নার পুরাণশকুন।
হারমোনিয়ামে গলা সাধি মৃত লখিন্দর;
আমার লাশের গন্ধে বিব্রত ঈশ্বর কাঁদে বেহুলার কোলে।
চিঠি আসে। নীল খামে।
খামের ভেতর জাগে অবেলার ঘুম!
এই ঘুম খরস্রোতে ভেসে যাবে আজ!
যদি ভেসে যায়—শিশুঘুম—
প্রৌঢ়রাত্রি বেড়ে যায় অন্ধকার রাতের সমান।
ভরা জোছনার ঢেউ ভাঙে রজঃস্বলা রাতে
আর আমি—
হেঁটে যাই—
বাংলার মেঘগ্রামে গান গেয়ে একালের অতুল প্রসাদ।
সম্ভ্রান্ত রাত্রির দীর্ঘশ্বাস
যখন দ্বিতীয়বার মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছি, পুনর্জন্মে সন্দেহ কী!
ধানের গোঁছার ফাঁকে মাথা গুঁজে কামুকবোয়াল
লেজ নাড়ে শিকারের ঘ্রাণে—
তখন বিকেল নামে—সূর্যের আন্ধারে লাল মেঘ।
মৃত্যুর আগে দেখেছি—
ঝাঁক ঝাঁক লাল মেঘ রঙ মাখে দিগন্তের স্লেটে।
সন্ধ্যার অঙ্গারে ডুব দেয় চাঁদ দিগন্তের পিঙ্গল আঁচলে
তখন সম্ভ্রান্তরাত্রি নামে দীর্ঘশ্বাসে
মাইল মাইল রাত পাড়ি দিয়ে কবে কোন বঞ্চিত পেয়েছে—
কাঙ্ক্ষার আকাশ?
সতৃষ্ণ আন্ধারে পুড়ে দীক্ষিত রাতের ডাকঘর
এই রাতে লালন কোথায়?
কতকাল একতারা বাজেনি প্রান্তরে!
সম্পর্ক গড়িনি।
. ভাঙবো কোন হিম্মতে?
একরাত ক্লান্তি জমে—একরাত বাড়ে অবসাদ
একমুঠো প্রেমে বাড়ে দীর্ঘতম নদী
এক নদী জলে ডোবে বোকা চণ্ডীদাস
ধর্ষিতা চান্দের স্বেদ ডেকে আনে কামান্ধআন্ধার।
চিরকাল রিক্ত হাতে ফিরে যায় দেবতার কামুকনিশ্বাস?
শরীরের ক্ষুধা যত বাড়ে, তত কমে পাপ-পুণ্য ভয়।
সময়
উড়ছে দেখে মেঘরমণী বাতাসে নির্ভয়ে
আমার দু‘চোখ থমকে গ্যাছে অনন্ত বিস্ময়ে।
মেঘরমণী মেঘ নয় যেন নারীর কোমল মন
শহর ছেড়ে উড়ছে বুঝি হাওয়ায় অনুক্ষণ?
ও রমণীর নিরীহমন—নিবিড় চুলের ভাঁজ
তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাব শহর ছেড়ে আজ
এই শহরে আবর্জনাই বেশি মূল্যবান
হট্টগোলে কেউ শোনে না কালান্তরের গান।
আবর্জনার গন্ধে এখন বাতাস ভীষণ ভারী
ও সখী মেঘ দাও পাঠিয়ে তোমার সুনীল শাড়ি
তোমার শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে নেব আমি খুঁজে
প্রিয় নারীর চোখের ভাষা অবাধ্য চোখ বুজে।
ও সখী মেঘ—রমণীর মন পুড়ছি ভীষণ জ্বরে
তোমার সঙ্গে উড়তে যে চাই—অনন্তপথ ধরে।
রোদের আঁচড়
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষের চোখ আঁকে ছাদের আকাশ
তারাগুলো মরে গেলে গলে যাওয়া রাতগুলো ঠিক জেনে যায়—
একবার নদীদের ধর্মঘটে কবিতারা ঢেউ এনেছিল।
সেবার শিখেছিলাম—চূড়ায় উঠতে নেই; চূড়া খুব ছোট
আমি জানি মুঠোভর্তি নদীগুলো কোনোদিন চূড়ায় ওঠেনি।
সম্পর্কের বেণী ধরে পতনের পাণ্ডুলিপি পাঠ করো যদি
ইতিহাসে ধূলো জমে, বাতাসেও লাগে সেই রোদের আঁচড়
একঝাঁক অন্ধকার খুঁটে খায় চূড়োর উত্থান—
পতনের নীতি আছে—ঘৃণারও ইতিহাস।
হয়তো নিখিল নীলে ছবি আঁকে চিরঅন্ধ আলোর সন্ত্রাস;
আমাকে উন্মাদ ভেবে মাইল-মাইল রাত গিলে গিলে খায়।
প্রতারক চিত্রকর;
আমাকে পায় না খুঁজে মিছিলের আগে-পরে গোয়েন্দা বায়স!
এই নাও সান্ধ্যনদী; সূর্য মরে গেলে দিয়ো মাতাল চুমুক
আমার পকেটভর্তি তৃষাতুর চৈত্রের আকাশ
মগজে স্লোগান তুলে জেগে থাকে রাতগুলো আলোর কাক্সক্ষায়।
চূড়ায় ওঠে না নদী—যে ওঠে সে পুড়ে মরে তুমুল ঘৃণায়।
ক্রীতদাসের ইতিকথা
বন্ধুরা জানেন—কবির ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয় না কখনো।
কবি বলেছেন, মানুষেরা ফিরে যাচ্ছে দাসযুগে।
সঙ্গমে অনীহ তারা, ধর্ষণে তাই সুখ খোঁজে।
মানুষেরা খুন করে মানুষের আশা, খুন করে আশ্বাস-বিশ্বাস।
এইসব মানুষের রমণ-গমণ-ক্রোধ সবই দাসের মতন।
ক্রীতদাসেরা
কে কার আগে খুলবে নিজের মেরুদণ্ড, নামে এই প্রতিযোগিতায়;
কে কত মেরুদণ্ডহীন, কার ঘটে কত তেল, সকলই গরল ভেল
যদি না কাজে আসে, মনিবের চরণমালিশে।
এই তেলমালিশেও আছে নানা কায়দা কানুন।
অকারণেই কারও-কারও মাথা নত হয়।
কারও-কারও মেরুদণ্ড খুলে পড়ে অবিকল কেঁচোর মতোন।
আর তারা গড়াগড়ি খায় অর্থেশ্বরের পায়ে চুমো খেতে-খেতে!
সবচে গোপন সত্য—ক্রীতদাসেরা দাস হতো দ্বৈবচক্রে
আজকাল মানুষেরা ভালোবাসে কৃতদাস হতে।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে
হঠাৎ মেঘে ভেসে এলো আওয়াজ
আকাশ ভরা চাঁদের আলাপন
তারারা গায় মন খারাপের গান
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
হঠাৎ যদি কেঁদে ওঠে নদী
পাহাড়ও কি উড়াল দিতে চায়
সাগর আমার সহপাঠী হলে
হাজার মাইলের রাত্রি তবে কার?
রাত্রি তো নয়, সকালও নয়, তবু—
সূর্যকান্ত শিশুবৃক্ষে ছায়া
কাঁপলো কেন? হাসলো কেন হাওয়া?
হঠাৎ কেন তারারা আজ রাতে
যমুনা নয়, গোমতীও নয়, তবে—
মেঘনায় এলো কবিতা ভাসানে?
কে বলেছে কবিতা পাঠ? কে?
জীবন ঘষে প্রশ্ন তোলে যে!
আঁধারজোড়া রাত্রি আছে, রাতও
তবুও নদী আদিম প্রশ্ন তোলে—
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
জংলি কুসুম
যদি ভুল করে কোনো ভুলফুল ফোটে তোমাদের ছাদে
জেনে রেখো সে ভুল আমি;
জেনে রেখো তোমার খোঁপায় ঠাঁই হলো না
তাই ফুটেছি অকালে—হৃদয়ের দাবি নিয়ে জংলি কুসুম!
কাচের দেয়াল ঘেরা তুমি-আমি-আমাদের পৃথিবী
তবু কেন মনে হয়—এই ছুঁই এই ছুঁই?
আহারে মানবস্বপ্ন! দেয়ালের ওপারেই থাক!
আমাদের বিশ্বে শুধু বয়ে যাক প্রেমের জোয়ার।
কোনো রাজকন্যা নয়, না কোনো স্বর্গের দেবী
তোমাকে চেয়েছি শুধু শর্তহীন আঁধারে-আলোয়
অনন্ত পথের শেষে দাঁড়িয়ে থেকেছি বহুকাল
পথ শেষ হয় তবু, দেখা আমি পাই না তোমার
মনে হয় এই ছুঁই এই ছুঁই
জানি তুমি পথের শেষে নেই, আছ পথের ওপারে।
ফুটেছি বুনোফুল পুকুর ঘাটে, ক্ষেতে ও খামারে
পায়ে পায়ে চুমো খাই সকালে-বিকালে
যদি তুমি ভুল করে হাতে তুলে নাও,
যদি ভালোবাসা পাই—
ফুটেছি গোপনে ফুল, টবে নয় ছাদের কিনারে!
দুরন্ত দুপুর
নাটাইফলের মতো বাঁকা পথেরা দিন শেষে
নিরস কোনো খবর নিয়ে আসে।
আমি তখন মধ্যরাতের লাল ডায়েরি লিখি
কে এলো আর কে পালালো সে খবরে আর
ঘুমকাতুরে উড়ন্ত রাত পোড়ে না ক্যানভাসে।
আজও তেমন হদ্দনবিস, আজও তেমন নাদান
মেঘ দেখেও ঝড় বুঝি না—মুখ দেখেও মন
মূর্খ আছি তেমনই ঠিক, যেমন ছিলাম প্রেমে
নাটাইফলের নিরস স্বাদে কাকে মনে পড়ে?
কেমনতরো স্মৃতিকাতর, কেমন মনের ভুল
একলহমায় হাওয়া লিখি—একমুহূর্তে মেঘ
এবার যদি ফিরে আসে পাখি
আর দেব না পায়ে শেকল, আকাশ থাকুক বুকে।
আয়রে আমার ঘুমতাড়ানি, আয়রে ডাকাত সুর
তোর বুকে আজ খুন হয়ে যাক দুরন্ত দুপুর।
লাল মাছি
একটি লাল মাছির গান শুনে জেগে উঠে দেখি
আমার সামনে তুমি—
অন্ধনদীর সতীন হয়ে বসে আছ একা একা!
আমি স্রোতের নামতা ভুল করে গেয়ে উঠলাম
তোমার নামে নিটোল কোনো সন্ধ্যার স্বরলিপি।
আমাদের দক্ষিণের বারান্দায় নাকি বহুদিন
ঘুমিয়েছিল সম্ভ্রান্ত রাত
অথচ রাত্রির গানে কোনোদিন সুর সাধিনি!
আমি বাউল ছিলাম; তেপান্তরে হাঁটিনি কখনো?
অথচ তোমরা শুধু শুনে গেলে তীব্র পদধ্বনি!
অন্ধ রাতের মগজে সূর্য ডুবে গেলে—
আমি একা পার হব লাল মাছি জেগে থাকা মাঠ?
কাউকে চাই না আজ সূর্যকান্ত রাতের শয্যায়!