হারুকি মুরাকামির গল্প Sleep (পর্ব-২) ॥ অনুবাদ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


গল্প : Sleep
মূল : হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ : মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
পর্ব :২

[যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য হারুকি মুরাকামির গল্প Sleep এর দ্বিতীয় পর্ব ছাপা হলো ]

ঘুম (দ্বিতীয় পর্ব)
আমি জানি না কেন আমি সেই সময়ে ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। অথবা কেনোই বা হঠাৎ করে পুনরায় সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।আমার কাছে বিষয়টি ছিল বাতাসের সাথে কোথাও থেকে আসা ঘন কালো মেঘের মতো।অশুভ জিনিস দিয়ে ভরা।আমার কোনো ধারণাই ছিল না এগুলো কোথা থেকে আসত এবং কোথায় চলে যেত।আমি শুধু জানতাম যে, কিছুটা সময়ের জন্যে সেটি আমার উপরে ভর করেছিল।তারপর চলে গেছে।

তবে এখন আমার যা হয়েছে, তা ইনসমনিয়া নয়।একেবারেই না।শুধু আমি ঘুমাতে পারি না।এক সেকেন্ডের জন্যেও।এই সহজ সত্য ছাড়া আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।আমার ঘুম পায় না।আমার মনের ভেতরে মূহুর্তের জন্যেও কোন ঘোলাটে ভাব থাকে না।অবশ্য যদি ঘোলাটে বলে আদৌ কোনো জিনিস থেকে থাকে।শারীরিকভাবেও আমি খুবই স্বাভাবিক।আমার ক্ষুধামন্দা নেই।ক্লান্তি বোধ করি না।মোটকথা প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতার নিরিখে আমার কোন সমস্যাই নেই।

শুধুমাত্র ঘুমাতে না পারা ছাড়া।এমনকি এই যে আমি ঘুমাচ্ছি না, তা আমার স্বামী বা ছেলে কেউই খেয়াল করেনি।আমিও তাদেরকে বলিনি। আমি চাই না কেউ আমাকে বলুক ডাক্তারকে দেখাতে।আমি জানি তাতে কোন লাভ হবে না।নিশ্চিতভাবেই।আমি আগেও জানতাম যে, এটা এমন একটা বিষয় যা আমার নিজেকেই সমাধান করতে হবে।

বাইরে থেকে আপনার কাছে মনে হবে যে, আমার জীবনে কোনো পরিবর্তনই হয়নি।চলছে চিরকালের মতো।শান্তিপূর্ণ ও নৈমিত্তিক ছন্দে। স্বামী ও ছেলেকে সকালে বিদায় দেওয়ার পর আমি গাড়ি নিয়ে বের হই। মার্কেটে যাই।আমার স্বামী একজন দাঁতের চিকিৎসক।আমাদের বাসস্থান এলাকা হতে তার ক্লিনিকে গাড়িতে করে যেতে দশ মিনিট সময় লাগে। সে ও তার ডেন্টাল স্কুলের এক বন্ধু যৌথ মালিকানায় ক্লিনিকটি চালায়। দুজনে চালানোর কারণে তারা একজন টেকনিশিয়ান ও একজন রিসেপশনিস্ট রাখতে সক্ষম হয়েছে।বেতন দিয়ে।ডাক্তার হিসেবে আমার স্বামী ও তার বন্ধু দুজনেই ভাল।সুতরাং মাত্র পাঁচ বছর পূর্বে কারও সাথে সংযোগ বা সাহায্য ছাড়াই ক্লিনিকটি শুরু করার পর তারা ভাল সুনাম কুড়িয়েছে।

“আমি খুব বেশি পরিশ্রম করতে চাই না,” আমার স্বামী বলে। “কিন্তু পরিশ্রম না করে আমার কোন উপায় নেই।’’ সত্য। অফিসটা খুলতে আমাদেরকে বড় অংকের একটা ব্যাংক লোন নিতে হয়েছে।একটা দাঁতের চিকিৎসার ক্লিনিক বা অফিস খুলতে যন্ত্রপাতির জন্যে বিশাল একটা বিনিয়োগ করতে হয়।প্রতিযোগিতাও খুবই প্রবল।তাছাড়া যে মুহূর্তে আপনি অফিস খুলবেন, সেই মুহূর্ত থেকেই রোগীরা টাকা ঢালা শুরু করে না। রোগীর অভাবে অনেক ডেন্টাল ক্লিনিকই বন্ধ হয়ে যায়।সেই সময়ে আমরা অল্প বয়স্ক এবং গরীব ছিলাম।আমাদের একটা শিশু সন্তানও ছিল।এই কঠিন পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে পারব কিনা তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না।কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম যে করেই হোক।এবং এভাবেই আমরা পাঁচ বছর সময় অতিক্রম করেছিলাম।কাজেই কারও বিরুদ্ধেই আমাদের আমাদের অভিযোগ করার কিছুই নেই।যদিও ঋণের দুই তৃতীয়াংশ পরিশোধ করতে আমাদের এখনও বাকি আছে।

‘আমি জানি তোমার রোগীর সংখ্যা এতো বেশি কেন,’ আমি প্রায়ই তাকে বলি।‘কারণ তোমার চেহারা যথেষ্টই সুন্দর।’ এটাই আমাদের প্রতিদিনের কৌতুক।বাস্তবে তার চেহারা আদৌ সুন্দর নয়।সে দেখতে কিম্ভূতকিমাকার।এখনও মাঝে মধ্যে আমি ভাবি এই অদ্ভুত চেহারার মানুষকে আমি কেন বিয়ে করেছিলাম।তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর ছিল আমার একটা বয়ফ্রেন্ড।আমার স্বামীর মুখমণ্ডলটাও খুবই অদ্ভুত রকমের।কি রকমের অদ্ভুত তা আমি সত্যিই বলতে পারব না।কারণ, তা সুন্দরও নয়, আবার কুৎসিতও নয়।এমনকি ওটাকে বিশেষ কোন বৈশিষ্টের অন্তর্ভুক্তও করা সম্ভব নয়।শুধুমাত্র ‘অদ্ভুত’, এই কথাটাই তার ক্ষেত্রে মানায়।অথবা হয়ত বা এটা বলাই অধিকতর সঠিক হবে যে, তার চেহারার ভেতরে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট নেই।এটাও মেনে নিতে পারতাম যদি বুঝতে পারতাম যে, তার চেহারার মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্যে তাকে বৈশিষ্ট্যহীন বলে মনে হয়।তাহলেও ‘অদ্ভুত’ বিষয়টা আমার নিকট বোধগম্য হতো।

আমি তার ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম।কিন্তু পারতাম না।কারণ, আমি মনেই করতে পারতাম না যে, সে আসলে দেখতে কেমন।ফলে ছবি আঁকার পেন্সিল হাতে কাগজ নিয়ে বসে থাকতাম।একটা আঁচড়ও দিতে সক্ষম হতাম না।আমি হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম এই ভেবে যে, কেমন করে আমি এমন একজন মানুষের সাথে বাস করছি, যার চেহারা আমার মনের ভেতরে আনতে পারি না।অবশ্য আমি তাকে অবশ্যই শনাক্ত করতে সক্ষম ছিলাম।এমনকি কখনও কখনও আমি তার মানসিক ছবিও অনুধাবনও করতে সক্ষম ছিলাম।কিন্তু সমস্যা হতো তখনই, যখন আমি তার ছবি আঁকতে যেতাম।এই সময়ে তার মুখমণ্ডলের কিছুই আমার মনে থাকত না।এরকম অবস্থায় কী করতে পারতাম আমি? আমার মনে হতো আমি একটা অদৃশ্য দেয়ালের ভেতরে দৌড়াচ্ছি এবং আমার সামনে তার অদ্ভুত মুখমণ্ডল।এই বিষয়টি আমাকে অধিকাংশ সময়েই আমাকে স্নায়বিকভাবে দুর্বল করে রাখত এবং আমি ঘাবড়ে যেতাম।

তারপরেও সে ছিল এমন ব্যক্তি, যাকে সকলেই পছন্দ করত।ব্যবসার ক্ষেত্রে তার জন্যে এটা বিশাল ইতিবাচক দিক ছিল।কিন্তু আমার ধারণা শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই তার সফল হবার সম্ভাবনা ছিল।লোকজন তার সাথে কথা বলার সময়ে নিরাপদ বোধ করত।তার মতো মানুষের সাথে আমার ইতিপূর্বে সাক্ষাৎ হয়নি।আমার সব মেয়ে বন্ধুরা তাকে পছন্দ করে।আমার কথা বলাই বাহুল্য।আমি মনে করি আমি তাকে ভালোবাসি।কিন্তু সত্য হলো আমি তাকে পছন্দ করি না। যাই হোক, সে শিশুদের মত প্রাকৃতিক ও নির্মলভাবে হাসতে সক্ষম।

অনেক বয়স্ক মানুষেরাই এটা পারে না।আমার ধারণা, সবাই আশা করে যে, একজন ডেন্টিস্টের দাঁত সুন্দর হবে, যা তার আছে।‘এটা তো আমার দোষ নয় যে, আমি দেখতে খুবই সুন্দর,’ সেসব সময়ে উত্তর দেয়, যখন আমরা পরস্পরের সাথে কৌতুক করি।শুধুমাত্র আমরা দুজনেই বুঝি এই কথার অর্থ কি।এটার অর্থ হলো বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকার সামর্থ অর্জন করা।আমাদের দুজনের জন্যেই এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আচার।

সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে সে কন্ডোমোনিয়ামের পার্কিং গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়।আমাদের ছেলে তার পাশে বসে।তার প্রাইমারি স্কুল অফিসের রাস্তায় যেতেই পড়ে।‘সতর্ক থেকো” আমি বলি। ‘চিন্তা করো না,’ সে উত্তর দেয়।সব সময়েই এই একই ডায়ালগ।সে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়।কারের স্টেরিওতে হেইডন অথবা মোজার্টের টেপ ঢুকায় এবং মিউজিকের তালে তালে গুনগুন করে।আমার দুইজন ‘মানুষ’ আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে।তাদের হাত ঠিক একইভাবে নড়ে।এটাও একটা অলৌকিক ব্যাপার।তারা দুজনেই একই কোণে মাথা হেলান দিয়ে রাখে এবং তাদের হাতের তালু আমার দিকে ঘুরায়।তারপর দুটোকে একইভাবে সামান্য নাড়ায়।ঠিক যেন কোনো কোরিওগ্রাফার তাদের দুজনকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

আমার নিজের কার আছে।একটা ব্যবহৃত হোন্ডা সিভিক।আমার একটা মেয়েবন্ধু দুইবছর পূর্বে আমার কাছে বিক্রি করেছিল।ওটার একটা বাম্পার চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে।গাড়ির বডিটাও সেকেলে।ভেতর থেকে মরিচা দেখা যায়।কারটার অডোমিটারে ১৫০,০০০ কিলোমিটারের বেশি দেখাচ্ছে।কোন কোন সময়ে–মাসে এক অথবা দুইবার গাড়িটা স্টার্ট করতে পারাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।তারপরেও খারাপ নয়। আপনি যদি সেটাকে শিশুর মতো আদর করতে পারেন এবং দশ মিনিটের মতো বিরাম দেন, তাহলে ইঞ্জিন সুন্দর ও উচ্চস্বরে চলা শুরু করবে।আসলে প্রতিটা জিনিস–প্রতিটা মানুষই মাসে এক দুইবার আংশিকভাবে অকেজো হয়ে যায়।এটাই জীবন।

আমার স্বামী আমার কারটাকে ডাকে ‘তোমার গাধা’ বলে।আমি কিছুই মনে করি না।ওটা আমার এটাই বড় কথা।সিভিকটাকে চালিয়ে আমি সুপার মার্কেটে যাই।মার্কেট থেকে ফেরার পর আমি বাসা পরিষ্কার এবং কাপড় ইস্ত্রি করি।তারপর লাঞ্চ তৈরি করি।সকালের টুকিটাকি কাজগুলো আমি সতেজভাবে করে থাকি।সম্ভব হলে সকালেই ডিনারও তৈরি করে ফেলি।ফলে বিকেলটা আমার নিজের জন্যে ফ্রি থাকে।আমার স্বামী লাঞ্চের জন্যে বাসায় আসে।সে বাইরে খেতে পছন্দ করে না।বলে যে, রেস্টুরেন্টগুলোতে সবসময়ে ভিড় থাকে, খাবারের মান ভাল না, এবং সিগারেটের ধুঁয়া তার জামার ভেতরে ঢুকে যায়।কাজেই অতিরিক্ত সময় লাগলেও সে বাসাতেই খেতে পছন্দ করে।কিন্তু তারপরেও আমি তার লাঞ্চের জন্যে সৌখিন কিছু তৈরি করি না।সকালের অবশিষ্ট খাবারগুলোকে আমি মাইক্রোওয়েভে গরম করি অথবা এক বাটি নুডুলস তৈরি করি।সুতরাং রান্নার সময়টা খুবই সংক্ষিপ্ত থাকে।এবং অবশ্যই একা একা নিঃশব্দ ভাবে খাওয়ার চেয়ে স্বামীর সাথে খাওয়া আমার জন্যে যথেষ্টই আনন্দের।

ক্লিনিকটা যখন সবে শুরু হয়েছিল, তখন বিকেলের দিকে কোন রোগী আসত না।তখন আমরা লাঞ্চের পর বিছানায় শুয়ে থাকতাম।ঐ সময়টা ছিল তার সাথে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময়।বিকেলের নরম আলো আমাদের রুমের ভেতরে প্রবেশ করত।আমরা দুজনেই তখন কম বয়সী ও সুখী ছিলাম।অবশ্য আমরা এখনও সুখী।অন্তত আমি তাই মনে করি। আমাদের পরিবারে কোন গৃহস্থালী সমস্যা নেই।আমি তাকে ভালবাসতাম এবং বিশ্বাস করতাম।আমি নিশ্চিত যে, আমাকেও সে একই রকম অনুভব করত।কিন্তু, ধীরে ধীরে যখন মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়, তখন আমাদের জীবন বদলায়।এটাই স্বাভাবিক।এ বিষয়ে আমরা কিছুই করার নেই।এখন বিকেলের সময়গুলো আর আমাদের নেই।

খাওয়া শেষ করার পর আমার স্বামী দাঁত মেজে দ্রুত গাড়ির দিকে চলে যায় এবং অফিসে ফিরে যাবার জন্যে।অনেকগুলো অসুস্থ দাঁতের মানুষেরা সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে।আমরা দুজনেই এখন জানি যে, নিজেদের মতো করে প্রত্যেকটি জিনিস আমাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
চলবে..