ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-১১) ॥ মায়াবন বিহারিণী


হঠাৎ ডাকাত দলটির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি এগিয়ে এসে বললেন, সদ্দার, অগো দুই বাড়িরই এলাকায় খুব নাম ডাক আছে।তুমি চিনো কিনা, তয় আমি মাইয়াডার দাদা রে চিনি। অর দাদার বাপের বিয়াও হইছিল যমুনায়।এমুনি নাওয়ের ভিত্রে।
কি কও মে বাই? সর্দারের কণ্ঠে অবিশ্বাস।

হ সদ্দার, তোমার দাদা আর আমার দাদা সাক্ষী আছিল সেই বিয়ার। কয় বছর আগে যে চরডা নদী ভাইঙ্গা নিছে অতে তোমাগো আর আমাগো যত জমিজিরাত আছিল তার বেবাক অর দাদার বাপে দান করছিলেন।
হ মে বাই, মনে পরছে।দাদায় তারে খান সাব কইতেন।তিনি নাকি জ্বীন-ভূত পালতেন?
হ হ সদ্দার, অহন চিনছ।

দুটো নৌকারই ইঞ্জিন বন্ধ।দুটোই স্রোতে গা ভাসিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। আকাশদের নৌকার মাঝি ও তার সহকারীকে বেঁধে ফেলেছে ডাকাতরা। ভয়ে কাঁপছে ওরা।ওদের আশঙ্কা ‘নায়ের সাতে জানডাও হারামু নাকি!’ ছইয়ের ভেতরে কাজী সাহেব, আকাশ, মনা বা আকাশের বন্ধুরা কেউই কোনো কথা বলবার সাহস পাচ্ছে না।

সর্দারকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।সে কাউকে উদ্দেশ্য না করে প্রশ্ন করল, তাইলে এগোরে নিয়া এহন কী করমু?
যেন অসীম আঁধারে হঠাৎ একটা আলোর রেখা দেখতে পেল আকাশ। সেই আলোয় নিজেদের মুক্তির সম্ভাব্য পথ খুঁজে নিতে সে সর্দারকে বলল, প্লিজ, আমাদের ছেড়ে দিন।

সাথে সাথে ধমকে উঠল সর্দার, চুপ হারামি! বাপ-দাদার ইজ্জতের ডুগডুগি বাজাইতে আইছস, তগোরে এম্নেই ছাড়মু? তর বাপের নাম কী কইলি তহন? দাদার নাম কী?
আকাশ চুপ করে রইল।ও খুব অপমানিত বোধ করছে।ওকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ওর এক বন্ধু বলল, ওর বাবার নাম আতা তালুকদার। দাদা বাঘা তালুকদার, মারা গেছেন।

আতা তালুকদার, বাগা তালুকদার।বিড়বিড় করল ডাকাত সর্দার। তারপর গলা চড়িয়ে জলিমদ্দি নামের কাউকে ডাকল, অই জলিমদ্দি, পুবপারের কারোর নম্বর আছে? ফোন দে।
জলিমদ্দি নামের লোকটা ছইয়ের ভেতরে ঢুকে বলল, আমার শালার ভায়রার নম্বর আছে সদ্দার।অরে ফোন দিমু?

এর চায়া লম্বা লতা-পাতায় ইষ্টি আর নাই? হারামজাদা! দে, অরেই ফোন দিয়া ক’ তালুকদার বাড়ি’ত খবরডা পৌঁছায়া দেক।কইতে কবি, এরা আমাগো জিম্মায় আছে।আইসা নিয়া যাক।পুলিশের ঝামেলা হইলে এগো খুন কইরা ফালামু।
কিন্তু জলিমদ্দি ফোন করবার সুযোগ পেল না।তার আগেই তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল।
মনা এতক্ষণ ধরেই চুপ করে ছিল।ও কোনো কথা বলেনি বলে ওর দিকে কেউ মনোযোগ দেয়নি।কিন্তু সব দেখেশুনে ও ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছিল।

‘খুন করে ফেলবে’ কথাটা শুনে মনা-র রাগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল আর সেই সাথে ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।তখনই শুরু হলো তাণ্ডব।মনাকে নিজের জায়গা থেকে এতটুকুও নড়াচড়া করতে হলো না। ও কেবল আগুন চোখে জলিমদ্দির দিকে তাকাল, সাথে সাথে সে নৌকার পাটাতনে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

হঠাৎ এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেল ডাকাত সর্দার।বয়স এখনো চল্লিশ স্পর্শ না করলেও ইতোমধ্যে ছোটোবড়ো অনেকগুলো ডাকাতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে সে। তার কোনো কোনোটায় আবার নির্মমতার কমতি ছিল না। তাতে একটুও ঘাবড়ায়নি, কিন্তু এমন ভূতুড়ে পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি।

সর্দার কিছু বলবার আগেই মনা তার দিকে তাকাল আর সাথে সাথে এক ঝাপটা বাতাস ধাক্কা মেরে তাকে নৌকার পাটাতনে ফেলে দিল।
ব্যথায় ককিয়ে উঠল সর্দার।মনা তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়েই আছে।তারপর কী ভেবে ছইয়ের পেছন দিকটায় তাকাল সে।ওখানে অস্ত্র হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা পড়ে গেল উল্টো দিকে।এই ফাঁকে সর্দার ও জলিমদ্দি পড়িমরি করে ছইয়ের বাইরে বেরিয়ে গেল।
ভেতর থেকে শোনা গেল সর্দার ঘড়ঘড়ে গলায় বলছে, বাঁচতে চাইলে এই নাও ছাইড়া দে।

আকাশে তখনই মেঘের আড়াল থেকে ক্ষণিকের জন্য বেরিয়ে এলো আষাঢ়ে পূর্ণিমার চাঁদ।মনা চোখ ফিরিয়ে দেখল জোছনায় ঝলমল করতে থাকা যমুনার জলে একটা নৌকা ছুটে পালাচ্ছে।কিন্তু তক্ষুণি ওটা ডুবে যেতে লাগল।

এসব দেখে আকাশ ও তার বন্ধুরা ভয়ে নীল হয়ে গেছে।কাজী সাহেব ক্রমাগত দোয়া-দরুদ পড়ছেন।
কেউই মনা-কে চিনতে পারছে না।তাদের সামনে বসে থাকা মেয়েটা পরিচিত সেই মনা নয়। যেন অন্য কেউ।
হঠাৎ বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। তুমুল বৃষ্টি।

যমুনার জলে বৃষ্টির ছুপ ছুপ ছুপ, ঝুপ ঝুপ ঝুপ শুনতে শুনতে শুয়ে পড়ল শ্রান্ত-ক্লান্ত মনা এবং সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ততক্ষণে যেন সম্বিত ফিরে পেলেন কাজী সাহেব।ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, আল্লাহ রাসুলের নাম নিয়ে মেশিন ইস্টাট দেও মাঝি।
আর মনে মনে বললেন, বিয়ে পড়ানোর গুষ্ঠি কিলাই।

রাত দুপুর পার করে মনাদের নৌকা যখন ঘাটে ভিড়ল তখনও নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে সে।

মেঘ মুক্ত আকাশ থেকে চাঁদও তখন জোছনা ঢালছে নিশ্চিন্ত মনে।
মকবুল হোসেন খান নৌকা থেকে ঘুমন্ত মেয়েকে নামিয়ে আনতে গিয়ে চমকে উঠলেন, ছইয়ের ভেতরের পুষ্পশয্যায় ঘুমিয়ে আছেন সতেরো কিংবা আঠারো বছর বয়সী তারই দাদী, মানে বড়ো মা, ময়নামতি।
চলবে…