নির্বাচিত দশ কবিতা ॥ ইশরাত কবিতা


পেইন্টিং: ইশরাত কবিতা

আরণ্যক
এতটুকু রোদের উদারতায়
জমিয়েছি যে মুহূমুর্হূ উষ্ণতা
পরিধির দ্যোতনা পেরিয়ে
খুব গাঢ় অনুভবে, থাকবে তো
আরও কিছুকাল..
বিষণ্ন ভেজা কোন অ্যালবামে?

রেখেছি অতন্দ্রিত পাহারায় যত
উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর হারিয়ে ফেলার উষ্মায়!
ফড়িংজল আঁচলে মোড়ানো
সেসব দূর্গত স্বল্প শিহরন!

একাকিত্বের গিঁটবাঁধা সন্ধ্যেরা রাত হয় টুপটাপ জোছনা ঢালে
ক্লান্তিময় ভোরের চাঁদ।
কথা বলে নিরাভরণ চোখ খুব নির্জনে,
যা কিছু অবুঝ তাও বুঝদের দখলে চিরকাল!

আরণ্যক তবুও অকারণে
সবুজে আরও জলপাই সবুজ খোঁজে
অস্থির মোড়কে পাতায় পাতায় জলপ্রলুব্ধ অজস্র নিশী..

রহস্যনীল
একটু নিস্পৃহ অভিমানে
সূর্য বহুদিন দেয়নি প্রাণোজ্জ্বল কিরণ,
তবুও বিন্দু বিন্দু আলো নিয়ে, জমিয়েছি ক্লোরফিল.
ছড়িয়ে দিয়েছি,তোমার শেকড়ে বাকলে, মনপাতার প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে!

মেলেছে তখন কীর্তিনাশার জলের ঢেউয়ের সাথে
শাখায় শাখায় কথাকলি,
পুষ্পরেণু মাখা প্রাণের প্ররোচনা…

দিয়েছি অনুভূতির বিন্যাসে সুখের
অমরতার শূণ্যে মোড়া প্রত্যেকটা জাগানিয়া ভোর।

আয়েশে আবেশিত গভীর নিমগ্ন কত রাত
নেশাতুর মূর্ছণার বিউগলে উদ্দীপ্ত সেসব সুর!
পিনপতন নীরবতায় শিশিরডোবা নৈঃশব্দ্য।

তারপর সব মুঠোতে নিয়ে উদ্বায়ী হয়ে যাই রহস্যনীলে
অনন্তদিন যেখানে উড়ছে তুমিত্বের রাংয়তায় মোড়া
অসংখ্য ময়ূরাক্ষীর অনলে বিষাদ রঙিন!

হীরামন
পৃথিবীও জমিয়ে রাখে উপেক্ষার
পরিধিতে নুনের শিশির,
প্রাপ্তিহীন দমকে বিক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস!
কঠিন আত্মসাৎ এ জমিয়ে রাখা বিবর্ণ সুখ,
আর নিয়মের খাঁচার দুয়ার খোলার প্রত্যয়।

সব প্রেম শেষে ধরলাও শীর্ন, নিশ্চুপ..
তবুও স্থির চোখের বিন্দু,
শিমলতায় যতটুকু এ ভোরের শীত।

সম্বিৎ ফিরেই উল্টানো সূর্যে
উজ্জ্বল দিনমান
ভাঁটফুলের নির্জনতায় উৎকীর্ণ শ্রবণন্দ্রীয়;
জীর্ন পাতায় মোড়ানো মরণ আক্ষেপ!

উড়ে চলেছে সহজিয়ায় হীরামন..
জানে সে, দিনগুলো হারালেও থেকেই যায়
কোথাও সেদিনের ঋণ।

কূলবধূ
তালপাতার ভেঁপু বাজলেই
ঐ দূরের মাঠটার ওপারে
হলদে পাখি দিন!

বাবলার ডালে লেজ ঝুলিয়ে
সবকথা নিয়েই সে জলডাঙায় উড়ে যায়..

বসে থাকে হিরন্ময়ী স্বচ্ছজলে
ভিজিয়ে কঙ্কণে শঙ্খচূড়.
আঙুলের নিক্কণে রক্তজবা দুল
পরনে ধানবীজ রঙের শাড়ি।

অথচ একটু আগেও এখানে পাখিদের কানন ছিল
নিম কৌরঞ্জের দ্বৈততায় আবিষ্ট ছিল
পথের ভূবণ!
জগৎজোড়া ছিল শনিবারের সারাবেলা..

টপটপ পড়লো ঝরে জলের তোড়ে আকিঞ্চনে
নিশ্চুপ কূলবধূর শত নাম জোড়া জোড়া..

ভেজা বকুল মন
সেসব দিনেও শেষভোরে এভাবেই শিশির ঝরতো
শেফালীর হলুদ বোঁটায় রঙ চুঁইয়ে যেত ঘোর কুয়াশায়..

আমাদেরও ছিল শেষ আশ্বিনের
আদ্র মাটি ছোঁয়া ভেজা বকুল মন!
ডানায় ঝিলমিল রোদের হরিতকি
মায়া মেখে সন্ধ্যায় ডেরায় ফেরা
তুমুল প্লাবন!

কতদিন শোনা হয়নি নিস্তব্ধ আবেগী নির্যাসে সে ডাক..
তখন থেকেই থেমে শেষ স্টেশনের বিদায়ী ট্রেন.
বাজেনি হুইসেল; দোলা দিয়ে পেরিয়ে যায়নি সুপারির বন।

ভুলে যাওয়া পথগুলো এখনও বিরান ; এখনও নিশি পেঁচারা অতন্দ্র পাহারায় অবিনত দ্রাক্ষালতায় নিযুত কাল!

দিগন্ত জুড়ে হিমকাল
দিগন্ত জুড়ে হিমকাল
অঞ্জলি জলে ধুপঘ্রাণ;
চিরকাল ঊনতে আটকে কল্পনাজাল!
একটাই বিস্তৃত স্থিরচিত্র..

মেঘদল তোমাদের কতগুলো নাম! কচুর পাতায় অজস্র জলফড়িংয়ের স্বল্প আয়ু
বিহ্বল আমি, উড়িয়ে হিমের চাদর;
আজীবন লিখে যাই সে সুখনাম
কোলঘেঁষে মনবন্ধু নিস্তব্ধতা এসে বসে,
সেই তো পরম
অধিশ্বর!
এক আমিতেই লীন হয় অজস্র আমি…
অথচ আমি তোমাদেরই তো কেউ.

মৃদুগন্ধ বাতাস
কেমন করে নীলচে শিরার নীচে হিম প্রবাহরা একটু একটু করে উষ্ণ হয় তোমাকেই তো বলেছিলাম..
তিরতির মায়াচোখ জলে যেখানে হিজলের ছায়া দোলে বহুবার সেখানেই আমাদের মিলে যাওয়া মৃদুগন্ধ বাতাস এখনও খেলা করে!
অস্পষ্ট অথচ নিমগ্ন চেনা সে ধুন
ফিরে ফিরে আসে তোমারই সর্বনামে।
ডুবে যাওয়া চাঁদের আভা মেখে নিত্য ভোর হয়.
এখনও নিরবতার ছাদবাগানে টুনটুনি শিষ দিয়ে যায় জোরালো স্পষ্টে শুনিয়ে সে নাম..

শাপলা ফোটা ভোর
তবুও সে পথটাতে হাটি ভুলে বেভুলে..
এখনও সে কাঁদাজল মাখা ঝোপজঙ্গলের কিনারা পেরিয়ে ভেসে আসে
উদ্ভিন্ন সে ঘ্রাণ..
অল্প নরম ঘামের আঙুল ছুঁয়ে
বোতামের গিঁটে বেঁধে রয় সেসব
অনুরণিত ভাষা।

রোদেরা যেখানে ছুঁয়ে যায় তাল শাঁসের মতন নরম আলোয়..
এখনও সেখানে ঘীরে আছে চেনা সে অ্যারোমা!

তীব্র চেষ্টাতেও যাচ্ছে না সরে
ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটা রোমকূপের ডগা থেকে স্নায়ু,
মস্তিষ্কে পাগলপারা..

দীর্ঘ শব্দের চেয়েও বেশি কিছু বলা থাকে নীরবতায়..
তখন ভাষারা ভাসতে থাকে চিলের ডানায়
তিশির মাঠের হলদে, ছোট ছোট ফুলে
বহুদিন সেপথে তাকিয়ে থাকি ঘোরলাগা বিস্ময়ে!

সেসব শাপলা ফোটা ভোর
মেঘখণ্ডে টুকরোকাটা সব দৃশ্যরা.
জীবন থেকে চুরি হয়ে যাওয়া ছোট্ট বিকেলের মতন

একটু চাপা আবেগগুলো দূরে
সারি সারি শালবনে অগুনিত
প্রশ্নের পথে পথে..
শুধু খণ্ডায়িত জিজ্ঞাসায় মানুষই বিবর্ণ সময়ে..

অরুন্ধতীর চোখ
বেশ কিছুটা নীচ থেকে তাকিয়ে
উপরের দিকে
পাকদণ্ডীর মতন এঁকেবেঁকে সরু
যে পথ গিয়ে মিশেছে,
ওখানে হ্যান্সেনথিয়ারা থরেথরে ফুটেছিল।
কুয়াশামোড়া ঝিকিমিকি রোদেরা
রঙ মেখে উঁকি দিয়েছিল পাতার ফাঁকে।
প্রায় শেষ পৌষের সকাল টুপ করে
বেরিয়ে এসেছিল ঋতুর ঝোলা থেকে।
ওখানেই কেউ কেউ দড়িতে একজীবনের
পোড়খাওয়া অস্তাচলের জীবন
পোশাকের মতন ঝুলিয়ে রেখেছিল।

নীচে যে পথগুলো এঁকেবেঁকে
উচ্ছ্বল ইরাবতীতে মিশলো
তাদের চোখের নোনাজলে তিক্ত
ক্ষোভেরা ছিল!
জলেরাও উদগ্রীব ছিল কারও ফেরার অপেক্ষায়।
তারচেয়ে বহুবার সে জলে পা ডুবিয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখেছিল অরুন্ধতীর দুই চোখ।
পাহাড়তলীর সে এক চিলতে গ্রামটা,
যে গাঁয়ে এসব জালের মতন ছোট নদীরা
পা ধুইয়ে দেয়
মনস্বিনীকে প্রতিনিয়ত।

ফেলে আসা সেসব সময় কোন
নিয়ম মানে না।
মানেনা ইতিহাসের বা খৃষ্টাব্দেরও
কোন ধার।
ওখানেই আঁটকে আছে পাহাড়,
তাকে ঘেরা শত আকাঙ্ক্ষায় বুনো গাছেদের ঝোপেরা,
পাখিরা আর শত সহস্র নীরব দীর্ঘশ্বাসেরা।
অনেকটাই নিখুঁত পটভূমিতে তবুও কখন
মনভুলে কঠিন বিষাদের নীল রঙ ঢেলে পড়ে গেল।
কিছুটা অদ্ভুতভাবে তখন ক্যানভাসটা স্বপ্নছেঁড়া চোখে
তাকিয়ে রইলো অনাদিকাল।

মানুষ
মানুষ তার জ্ঞানের সমান সীমিত
অর্থ সমান ছোট
আর ভাবনার চেয়ে বড়,
তার স্বপ্ন সমান দীর্ঘ..
দুঃখ সমান আয়ু
আর অনুক্ত সমান ভালোবাসায়।