অটোয়ার একটি দশতলা ভবনের সর্বোচ্চ তলায় থাকি। এপার্টমেন্টগুলোয় একটি করে ছোট্ট বেলকনি আছে। আমার বেলকনি থেকে অটোয়ার অপরূপ সৌন্দর্যের বিশাল একটা অংশ বার্ডস আই ভিউতে অবলোকন করা যায়। সামারে আমি এই বেলকনিতে বসে অটোয়া রিভারের সুনীল জলের ঢেউ দেখি। পাল তুলে ছুটে চলা সেলবোটগুলোর মধ্যে সাঁতরে বেড়ানো হাঁসের প্রতিচ্ছবি দেখি। হেমন্ত বা ফল সিজনে রঙিন পাতার অনন্ত ক্যানভাস দেখি। সারাদিন ধরে মাঠের সবুজে আর আকাশের নীলে জুঁই ফুলের মতো ফুটে থাকা অজস্র শাদা সীগাল দেখি। সন্ধ্যার ঝিম ধরা আলোয় সুনীল আকাশে শাদা মেঘের আবহে কানাডিয়ান গিজদের দলবদ্ধ ওড়াউড়ি দেখি।গিজদের কোয়াক কোয়াক কোরাস সঙ্গীতের অপূর্ব মূর্ছনা শুনি।
বেলকনির বৈকালিক চায়ের আসরে ডালপুরি-সিঙ্গারা-ঝালমুড়ি-চানাচুরের সঙ্গে রেড কিংবা হোয়াইট ওয়াইনের ঢেউ খেলানো গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বেলকনির ছোট্ট সারফেসে এবং কার্নিশে নানান রঙের ফুলের নৃত্য দেখি। আর দেখি অটোয়ার চোখ ধাঁধানো সূর্যাস্ত। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমের আকাশটা গাঢ় হলুদ কিংবা লাল কখনো কখনো কেমন বেগুনি রঙ ধারণ করে! রঙের এই খেলাটা চলতে থাকে লম্বা সময় ধরে। ডিমের কুসুমের মতো গোলাকার সূর্যটা অস্ত যাবার আগে কেমন তীব্র কিন্তু মোহময় আর নরম হয়ে ওঠে। এবং সূর্যাস্তের পরেও আকাশ থাকে বর্ণিল,দীর্ঘক্ষণ।
আমাদের চায়ের আসরের সময়টায় মাঝে মধ্যেই নিচের মাঠ পেরিয়ে দশতলা এপার্টমেন্টের বেলকনিতে এসে উপস্থিত হয় একটা দু’টো কাঠবেড়ালি। অটোক্লোজড ডোরের সিকিউর্ড এপার্টমেন্টের সিঁড়ি কিংবা এলিভেটর ব্যবহার না করেই কাঠবেড়ালিগুলো দশ তলা পর্যন্ত উঠে আসার দক্ষতা দেখায়। ওদের চার হাত পায়ের নখের অদ্ভুত কারিশমায় ওরা দেয়াল খামচে খামচে অনায়াসে চলে আসে আমার বেলকনিতে। শার্লি ওদের তাড়িয়ে দিতে তৎপর হয়। কারণ এই বদমাশগুলো ওর শখের ফুল-সব্জির বাগানটা তছনছ করে দেয়। কামড়ে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় ফুলের পাঁপড়িগুলোকে। কখনো কখনো উপড়ে ফেলে টব থেকে, ছোট্ট নাজুক চারাগুলোকে। দাঁত বসায় খুদে টমাটো কিংবা কাঁচা মরিচের লাজুক শরীরেও।
শার্লিকে একটুও ভয় পায় না এই কাঠবেড়ালিগুলো। শার্লি তাড়া করলেও, এমনকি ওর হাতে লাঠি থাকলেও ওরা দাঁড়িয়েই থাকে বুক চিতিয়ে। কারণ এতোদিনে ওরাও বুঝে গেছে একটি অসম্ভব মায়াবতী নারীর নাম হচ্ছে শার্লি।
শার্লির তাগাদায় আমাকেই শেষে নামতে হয় গুন্ডামিতে।
আমার তাড়া খেয়ে সেকেন্ডের মধ্যেই তড়িঘড়ি দৌড় লাগায় কাঠবেড়ালি। বেলকনির কার্নিশ ধরে নিচের দিকে চোখ রেখে অবাক বিস্ময়ে দেখি–কাঠবেড়ালিটা খাঁড়া দেয়াল বেয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার স্পিডে নেমে যাচ্ছে আমার বিরুদ্ধে চিড়িক পিড়িক শ্লোগান দিতে দিতে!
বছরের পর বছর শার্লির শখের ফুল-ফসলের বাগানের প্রধান এবং একমাত্র শত্রু খয়েরি এবং ধুসর কিংবা কালো এই কাঠবেড়ালিগুলো।
ছোট্ট বেলকনি বা বারান্দাটায় অনেকগুলো টবের অবস্থান ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ওদের অবস্থান দেয়াল ঘেঁষা। ফলে খানিকটা আড়াল তৈরি হয়েছে টব-দেয়াল আর কর্ণারের সংযোগস্থলে। এবং এক পর্যায়ে প্রথমে বড় টবের গোড়ায় এবং পরে কর্ণারের আড়ালের আলো আঁধারীতে একটা কাঠাবেড়ালি এসে বাসা বাঁধলো আমাদের অগোচরে। তারপর একদিন সে তার প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে এলো। সেটাও আমাদের অগোচরে।
আমার চা আড্ডার সময়টায় খুব সতর্ক থাকে ওরা। কোনো শব্দ করে না। এই সময়টায় ওদের সমস্ত ভালোবাসাবাসি বন্ধ। বন্ধ খুনসুটি। আমরা টের পাই না। আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে চলতে থাকে ওদের গোপন সংসার-অভিসার। অটোয়ার বৃক্ষ-নদী-পাখি এবং সেলবোটের সৌন্দর্যে বিভোর আমরা টেরও পাই না কোন ফাঁকে ওরা সংসার পেতেছে।
ওরা ছাড়াও আরো কয়েকজন কাঠবেড়ালি আসেন আমাদের বেলকনিতে। হামলা চালান শার্লির শখের বাগানে। বেলকনিতে টবের মাটি আর ফুলের ছিন্নভিন্ন পাঁপড়ির ছড়াছড়ি দেখে শার্লির তো কেঁদে ফেলার অবস্থা। একদিন সে পুলিশের মতো নির্দয় লাঠিপেটা করলো কাঠবেড়ালিদের। এবং লাঠিচার্যের এক পর্যায়ে সে আবিস্কার করলো চুপিচুপি কোনো রকম পারমিশানের তোয়াক্কা না করেই আমাদের বেলকনিতে সংসার পেতেছে এক কাঠবেড়ালি দম্পতি!
বিনা ভাড়ার ভাড়াটেদের সে উৎখাত করতে চাইলো। কিন্তু ওরা বাড়ি ছাড়বে না কিছুতেই। ওরা চিড়িং পিড়িং প্রাতিবাদ জানায়–পুলিশ তুমি যতোই মারো/ এই বাড়িটা তোমার যেমন ঠিক তেমনি এই আমারও…।
অতঃপর ফের শার্লি গুণ্ডা হায়ার করলো।
এক বিকেলে গুণ্ডারূপী আমি পুলিশি একশনে নামলাম লাঠিসমেত। আমার মারপিটের দক্ষতায় ওরা ঘাবড়ে গেলো। আমার লাঠির গুঁতোয় আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো প্রেমিক প্রবর। কিছু একটা বলতে চাইছে সে। কিন্তু আমি শুনবো কেনো? তুমি হারামজাদা তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে সুখের সংসার করবা আর আমার প্রেমিকাকে কান্দাইবা সেইটা হবে না। পুরান ঢাকার পোলা আমি জানি ক্যাম্নে বাড়ি খালি করতে হয়। বাড়ি থেকে ক্যাম্নে উৎখাত করতে হয় একটা ফ্যামিলিকে। পেছন থেকে শার্লি আমাকে সমর্থনের হাওয়া দেয়। এমন সময় প্রেমিক বেচারার সঙ্গে ওর বিধ্বস্ত প্রেমিকাও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। এক ঝলকেই আমরা আবিস্কার করলাম আরে! প্রেমিকা বেচারী তো প্রেগনেন্ট! হারামজাদার প্রেমিকা কোন ফাঁকে প্রেগনেন্ট হয়ে বসে আছে! আমার মারপিটের সমস্ত আয়োজন মুহূর্তেই গেলো থেমে। শার্লি বললো–থাক। ওদের বাচ্চা হলে পর তাড়িয়ে দিস। থাক এখন। এই অবস্থায় ওরা কোথায় যাবে বাড়ি খুঁজতে!
লাই পেয়ে আমাদের বিনা ভাড়ার ভাড়াটেরা কিছুটা সাহসী হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। কারণ ওরা বুঝে গেছে আমরা ওদের মেনে নিয়েছি। আমাদের সহাবস্থান নীতি গ্রহণ ওদের পছন্দ হয়েছে।
দিন যায়।
একদিন আমরা আবিস্কার করলাম ওদের স্বামী-স্ত্রীর সংসারে তৃতীয় এবং সম্ভবত চতুর্থ সদস্যের আগমন ঘটেছে। বাচ্চাদের কিচিমিচি আওয়াজ পাই। কান পেতে শুনি বাচ্চাদের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি-ছড়াগান।
আমরা অপেক্ষা করি–দ্রুত বড় হ বাচ্চারা। তোরা বড় না হলে তো তাড়াতে পারছি না তোদের!
মাঝে মধ্যে ওদের দেখি লুকিয়ে লুকিয়ে। গায়ে গতরে ওরা বেড়ে উঠেছে। এক পর্যায়ে যখন বুঝলাম–এইবার ওরা নামতে পারবে দশতলার দেয়াল বেয়ে, তখনই একদিন হামলা চালালাম ওদের বাড়িতে। কিন্তু না কিছুতেই বাড়ি ছাড়তে রাজী না ওরা। স্বামী-স্ত্রী তারস্বরে চ্যাঁচায়। আমরা ক্ষ্যান্ত দিই।
কিছুদিন পর এক দুপুরে আবার আমি ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ স্টাইলে ‘অপারেশন ক্লিন স্কুইরাল’ প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শার্লির ফুল-শস্যের পাতার ঝোঁপ-ঝাড়ের কারণে ওদের বের করে আনা রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। একটা লাঠি দিয়ে তাই গুঁতোগুঁতি অভিযানে তৎপর হলাম। গুঁতোচ্ছি ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষ্য রাখছি যাতে গুঁতোটা খুব বেশি তীব্র না হয়। আমার উদ্দেশ্য পুলিশের মতো ‘মৃদু লাঠিচার্যের মাধ্যমে’ মিছিল ছত্রভঙ্গের মতো কাঠবেড়ালির সংসারটা ছত্রভঙ্গ করা। ওদের আহত করা নয়।
অবাক কাণ্ড,আমার গুঁতো খেয়ে স্বামী-স্ত্রী আজ তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছে না। (স্বামী-স্ত্রী সম্ভবত খাদ্য সংগ্রহে গেছে।) তার বদলে একটা নতুন কিশোর কণ্ঠ প্রতিবাদ জানাচ্ছে চিঁচিঁ করে। এক পর্যায়ে সেই চিঁচিঁ শব্দটা কেমন পালটে যেতে থাকলো। ওটা ক্রমশঃ hissing-এ পরিণত হতে থাকলো। খানিক পরে কিশোর কাঠবেড়ালিটা দৃশ্যমান হলো। নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে সে রুখে দাঁড়ালো আমাকে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে। বেড়ালদের হিসিং অর্থ–সে আমার প্রতি বিরক্ত। আমার আচরণে ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ। শংকিত ও ভয়ার্ত সে। এবং সে বলতে চাইছে–আমি আমাকে ডিফেন্ড করতে প্রস্তুত, তাতে আমার যা হয় হোক। লাগবা আমার সঙ্গে?
ছোট্ট বাচ্চা একটা কাঠবেড়ালির দুঃসাহস আমাকে মুগ্ধ করলো। লাঠিটার একটা প্রান্ত ওর শরীরের কাছে নিয়ে ওকে ঠেলে সরাতে চাইলাম। কিন্তু আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে সে তার সর্বশক্তি দিয়ে ফ্লোর আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো হিসিং করতে করতে।
সাহসী বাচ্চাটার এমন কাণ্ড দেখে খুব মায়া হলো আমার। আহারে! দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ছোট্ট শক্তিহীন এইটুকুন একটা কাঠবেড়ালির বাচ্চাও কী রকম সাহসী হয়ে ওঠে!
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শার্লি বললো–সে কিছুতেই যেতে চাইছে না কারণ সে মনে করছে এটা ওর বাড়ি। এটা ওর জন্মস্থান। ওর জন্মভূমি।
আসলেই। কাউকে তার জন্মভূমি থেকে উৎখাত করা যায় না। জন্মভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষ যেমন প্রতিবাদে প্রয়োজনে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ায় শত্রুর বুলেটের সামনে, জীবন দেয় অকাতরে, কাঠবেড়ালির ছোট্ট এইটুকুন বাচ্চাটাও সেরকম নিঃশঙ্ক চিত্তে রুখে দাঁড়িয়েছে জীবন বাজি রেখে।
উৎখাত অভিযান আপাতত স্থগিত করা হলো।
অতঃপর কাঠবেড়ালির বাচ্চাটাকে জয়ী ঘোষণা করে পরাজিত আমরা সরে এলাম উৎখাত অভিযান থেকে।
অটোয়া ১৪ নভেম্বর ২০২০