শিল্পী নাজনীন। কথাসাহিত্যিক ও কবি। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ গগণহরকরা।১৯৮১ সালের তিনি কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মায়াফুল ও সাপের গল্প’, ‘ছিন্নডানার ফড়িং’,‘বিভ্রম’, ‘আদম গন্দম ও অন্যান্য’, ‘তোতন’ ‘ফড়িঙরাজা’। এবার বইমেলায় (২০২৩) তার নতুন উপন্যাস ‘উলটপুরাণ’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।নতুন গ্রন্থ এবং সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাইফ বরকতুল্লাহ।
সাইফ বরকতুল্লাহ: আপনার নতুন উপন্যাস আসছে উলটপুরাণ। এর বিষয়বস্তু কী?
শিল্পী নাজনীন: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৭১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে আমার উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং এক যুদ্ধশিশু, যাকে ওই মুক্তিযোদ্ধা নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, তাদের নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে।
পরিবার ও সমাজের মানুষের সীমাহীন স্বার্থপরতা ও অমানবিকতা কী করে একটি পরিবারকে বিপর্যস্ত ও ধ্বংস করে দেয়, এই সমাজে বেড়ে ওঠা একজন যুদ্ধশিশুর জীবনযুদ্ধ এবং তার মানসিক গঠন কেমন হতে পারে, সে বিষয়গুলো উঠে এসেছে এই উপন্যাসে, সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের আড়ালে থাকা একজন রাজাকারের জীবনও এসেছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা, আমরা এর মাধ্যমে একটি মানচিত্র পেয়েছি, একটি পতাকা পেয়েছি, কিন্তু কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়েছে, অন্ধকারে হারিয়ে গেছে তারা, আবার সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ আঙুল ফুলে রাতারাতি কলাগাছ হয়েও উঠেছে, যে বিষয়গুলোই তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমার উপন্যাসে।
সাইফ: এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়ে আপনার ভাবনা?
শিল্পী নাজনীন: চরিত্রগুলো মূলত কাহিনির প্রয়োজনে এসেছে, কিংবা উল্টো করে বলা যায় চরিত্রগুলোই কাহিনিকে বৈঠা হয়ে টেনে নিয়েছে সমাপ্তির দিকে, অবশ্য যদি সেটাকে সত্যিই সমাপ্তি হিসেবে ধরা যায়। তবে উপন্যাসের মূল দুটি চরিত্র হাবিবুর রহমান এবং তিতলি, এ চরিত্র দুটিতে আমার চেনা দুটি চরিত্রের কিঞ্চিৎ ছায়া আছে। ছায়া মানে ছায়া। তাকে বাস্তবের সাথে মেলানো যাবে খুব সামান্যই। এই ছায়া চরিত্র দুটি পুরো উপন্যাসে ক্রমশ রক্ত-মাংসের চরিত্র হয়ে উঠে এসেছে এবং কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছে।
উপন্যাসের বাকি চরিত্রগুলো এসেছে মূলত এ দুটি চরিত্রকে গতিশীল করতে এবং কাহিনির প্রয়োজনে। তবে লেখা শুরুর আগেই এই চরিত্রদুটি আমার মাথায় ছিল। কিন্তু তারপরও আমি বলব যে এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্রই কাহিনিকে প্রবাহমান রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, এবং তারা কেউই এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সাইফ: এই উপন্যাসের কাহিনি লিখতে গিয়ে কী ধরনের বিষয় নির্মাণ বা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন?
শিল্পী নাজনীন: আমার মনে হয় যে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস বা গল্পগুলো অনেকটাই গতানুগতিক বা একঘেয়ে। সেখানে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে উঠে আসে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই নিদারুণ ভয়াবহতায় পাঠক ঘুরপাক খায়, হাঁপিয়ে ওঠে। ইতিহাস সেখানকার মূল উপজীব্য। ফলে অনেক সময়ই সেগুলিকে সাহিত্য যতটা তারচেয়ে বেশি সংবাদ সংকলন হয়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু আমি এই উপন্যাসে খানিকটা স্বাতন্ত্র আনার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে লেখায় ফুটিয়ে তোলাটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। তাছাড়া আমি উপন্যাসটা লিখেছি সেই ২০০৫/২০০৬ সময়ে দাঁড়িয়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নির্দিষ্ট একটা ছক মাথায় রেখে আমাকে এগোতে হয়েছে। আমি মূলত সেই ২০০৫/২০০৬ এ থেকেই ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এনেছি। উপন্যাস যদিও একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মুক্তিযোদ্ধা, একজন যুদ্ধশিশু এবং একজন রাজাকারকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে, তবু এতে ৭১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সে সময়টা সেটা উঠে এসেছে অনেকটা স্মৃতিচারণের মত করে।
বিশেষ করে যুদ্ধের যে বর্ণনাগুলো এখানে আছে সেটা কোনোটাই সরাসরি নয়, কারো স্মৃতিচারণ কিংবা অবচেতন মনের ভাবনার মাধ্যমে বিষয়গুলো এসেছে এখানে। এটা আমি করেছি যতটা না কাহিনির প্রয়োজনে তারচেয়ে বেশি স্বকীয়তা রাখার চেষ্টায়। তাছাড়া এটা আশলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস নয়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়টাই এর মূল উপজীব্য, সেটাও মাথায় রাখতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ফলে একটি পরিবারে তৈরি হওয়া বিপর্যয়, সেই পরিবারের মানুষগুলোর জীবনে হঠাৎ করে নেমে আসা ঝড় কী করে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আরো তীব্র হয়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া মানসিক বিপণ্নতা কীভাবে তাদের জীবনযুদ্ধে প্রভাব ফেলেছিল, উপন্যাসটিতে সে বিষয়গুলোই আমি তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
সাইফ: আপনার গ্রল্পগুলোর একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। বিশেষ করে গল্প বা উপন্যাসের কাহিনি, এছাড়া নামগুলো অন্যরকম হয়। আপনার অভিমত বলুন-
শিল্পী নাজনীন: এটা তো পাঠক ভালো বলতে পারবেন। আমি আমার মতো করে লিখি। বিশেষ কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করে নয়, হয়ত সে কারণেই লেখায় কিছুটা স্বাতন্ত্র থাকে। আর নামকরণের ব্যাপারে আমি খুব খুঁতখুঁতে। অনেকটা সময় নিই নামকরণে। যেমন এই উপন্যাসের কিছু অংশ একসময় অনলাইন পোর্টাল চিন্তাসূত্রে ছাপা হয়েছিলো প্রথমে ‘ঝিঁঝিলাগা দিনগুলি’ পরবর্তীতে ‘উজানে গড়াই’ নামে। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে প্রকাশের সময় মনে হলো নামটা যথার্থ হয়নি, ফলে আবার পাল্টালাম। আর কাহিনি নিয়ে আমি তেমন বিশেষ ভাবনা-চিন্তা করি তেমন নয়। যখন যে বিষয় আমার ভাবনাকে প্রভাবিত করে তখন সেটা নিয়ে লিখি। ইউনিক হতে হবে, পাঠকের ভালো লাগবে না কি লাগবে না, সেসব ভেবে কখনো বিষয় নির্বাচন করি না। সময় এক্ষেত্রে বড় একটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
সাইফ: আপনি তো কবিতাও লিখছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কথাসাহিত্যে আপনার আগ্রহ বেশি। কবি না কথাসাহিত্যিক-কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
শিল্পী নাজনীন: নিজেকে আমি কবি ভাবতে চাই না একদমই। কবি পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করি না কখনো। আমি মূলত কথাচিত্রী। আমার কবিতাগুলো মূলত আমার মনখারাপের ডায়েরি। একান্তই ব্যক্তিগত প্রলাপ বলা যায় সেগুলোকে। ওতে আমার নিজেরই আস্থা নেই তেমন। কোনো বিষয়ে খুব যখন কষ্ট পাই, মন খারাপ হয়, তখন কবিতার মতো কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করি। আর নিজের লেখার প্রতি সবারই একটা দুর্বলতা থাকে, আমারও আছে। তাই মাঝে মধ্যে তার দু-চারটে কোথাও কোথাও প্রকাশ করে ফেলি। কিন্তু আমি নিজে মনে করি ওগুলো মোটেই কবিতা নয়।
সাইফ: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার গুণাবলি কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? গল্প লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক কী বলে মনে করেন?
শিল্পী নাজনীন: যে লেখা পাঠকের ভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে, পাঠকের মন ও মননে আলোড়ন তুলতে পারে, ভাবনাকে উসকে দিতে পারে সে লেখাই আমার কাছে সার্থক লেখা। আর সাহিত্য কোনো নীতিশাস্ত্র নয়, যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনার শৈল্পিক উপস্থাপনই সাহিত্য। এখানে নীতিকথা আওড়ানোর সুযোগ নেই। এ বিষয়গুলোর প্রতিফলন যে লেখায় ঘটে, সে লেখাই সার্থক হয় সম্ভবত।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমি বিশেষ কোনো টেকনিক কখনো অনুসরণ করি না। গল্পের প্রয়োজনে যখন যেমন মনে করি তখন তেমন লিখি।
গল্পে আমি শুধু কাহিনির কঙ্কাল দেখতে চাই না, তাতে ভাষা, উপস্থাপন কৌশল আর কিছুটা বিমূর্ততা দেখতে চাই, কিছুটা আড়াল রাখতে চাই, যা পাঠককে খানিকটা ভাবার সুযোগ দেবে, তার কল্পনাকে বাড়িয়ে তুলবে, এটুকুই।
সাইফ: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে, তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
শিল্পী নাজনীন: চৌর্যবৃত্তির সমস্যা বর্তমানে অনেক বড় একটা সমস্যা। আমার অনেক গল্প এবং কবিতা চুরি হয়েছে, কখনো হুবহু, কখনো খানিকটা এদিক-ওদিক করে। এবং এই চোরেরা খুব দূরের কেউ নয়, চেনা জন, প্রশংসা করে লেখার, পড়ে আপ্লুতও নাকি হয়, আর শেষে নিজের মনে করে নিজের লেখা হিসেবে চালিয়েও দেয়। দেখে হাসি পায়, করুণাও হয়। এর থেকে পরিত্রাণের বিশেষ কোনো উপায় নেই সম্ভবত। তবে আমার মনে হয়, এদের ভয়ে অতটা তটস্থ হওয়ারও কিছু নাই আসলে। কারণ চুরি করে আর যা-ই হওয়া যাক কবি বা লেখক হওয়া যায় না। এরা হয়ত দু-চারটে লেখা চুরি করবে, সাময়িক হাততালি কুঁড়াবে, তারপর ক্লান্ত হয়ে একসময় নিজে থেকেই লেজগুটিয়ে পালাবে। তাছাড়া প্রত্যেক লেখকেরই কোনো না কোনো নিজস্বতা থাকে, যা দিয়ে পাঠক তাকে আলাদা করতে পারে, সেটা কেউ কখনো চুরি করতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস।
সাইফ: আপনার সমসাময়িক ও অনুজদের মধ্যে কার কার গল্প আপনাকে আকৃষ্ট করে কিংবা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
শিল্পী নাজনীন: অনেকেই আছেন, ভালো লিখছেন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নাহিদা নাহিদ, মাহরীন ফেরদৌস, আনিফ রুবেদ, সাইফ বরকতুল্লাহ, প্রদীপ আচার্য, সুবন্ত যায়েদের কথা। নাহিদ আর সুবন্তের লেখা আমাকে ভীষণ টানে, মন দিয়ে পড়ি এদের লেখা। অনুজদের মধ্যে শারমীন রহমান, সায়মা ইসলামের নাম মনে পড়ছে এই মুহূর্তে।
সাইফ: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
শিল্পী নাজনীন: বাংলা সাহিত্যে বর্তমানে একটা জোয়ার এসেছে বলা যায়। ফেসবুক এসে এখন কবি আর লেখকের জোয়ারে বাংলা সাহিত্য সয়লাব। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে করপোরেট দুনিয়ার থাবা। এরা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কবি বা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কাছা পরে লেখেছে যেন। এসব কারণে অনেকটা ত্রাহি ত্রাহি দশা এখন বাংলা সাহিত্যের। তবে জোয়ার শেষে যেমন শুধু পলি পড়ে থাকে, আবর্জনা সব ভেসে যায় জোয়ারের টানে, ঠিক তেমনি সময়ের স্রোতে বাংলা সাহিত্যের গায়ে এসে পড়া সব জঞ্জাল ভেসে যাবে একসময়, পড়ে থাকবে নিখাদ কিছু স্বর্ণদানা। তাই বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি হতাশ হতে চাই না কখনো।