যেভাবে লেখা হলো মেকং এর নাকফুল ॥ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


‘স্বরে অ’ প্রকাশনী (বইমেলা ২০২৩, স্টল নম্বর ১৭২) থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার নতুন বই ‘মেকং এর নাকফুল’।বইটি নিয়ে আমার আবেগ বহুদিনের।আমি খুবই খুশি যে শেষ পর্যন্ত আমি ও প্রকাশক মিলে বইটি প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছি।বিস্তর প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার পর।একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো বইটি প্রকাশ করার জন্যে দীর্ঘকাল যাবৎ আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন কম্বোডিয়াতে আমার সাথে কর্মরত ছিলেন এমন সহকর্মীরা এবং ফেসবুকের বন্ধুরা। তাদের সবার প্রতি আমার প্রবল কৃতজ্ঞতা রইল।

নিচে বইটির প্রারম্ভিক কয়েকটি অনুচ্ছেদ দেওয়া হলো:
‘প্রথমেই বলে রাখি যে, আমার এই লেখা ইতিহাস নয়; এমনকি ভ্রমণ কাহিনিও নয়।একে একটি যাপিত জীবনের ক্ষুদ্র স্মৃতিকথা বললেও অত্যুক্তি হবে না বলে আমার ধারণা।এই স্মৃতিকালের শুরু ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এবং সমাপ্তি ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে। এক বছরের চেয়েও কিছু কম সময়ের।

আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদবিতে কর্মরত। আমার বিশ্বাস, সেনাবাহিনীর পদমর্যাদাগুলোর মধ্যে এই পদটাই সবচেয়ে সুশোভিত ও একই সাথে যৌবনদীপ্ত।আমার সেই যৌবনদিনে বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের খেলার ফলাফল আমাকে টেনে গিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া তথা ইন্দোচীনের বিখ্যাত এক নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। মেকং নামক বিখ্যাত এক নদীর তীরে।কম্বোডিয়ায়। আমি সেখানে গিয়েছিলাম জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক (মিলিটারি অবসার্ভার) হিসেবে। আনটাক (UNTAC) বা ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন ক্যাম্বোডিয়া বা বাংলায় কম্বোডিয়ায় জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষের হয়ে এক শান্তিপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধে।১৯৯০ দশকে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক পরিচালিত এই শান্তি মিশন সম্পূর্ণভাবে সাফল্য অর্জন না করলেও, এই মিশনের অনেকগুলো লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছিল।

তিব্বতের মালভুমি থেকে এশিয়ার যে কয়টা মহানদী নেমে এসেছে তাদের মধ্যে মেকং অন্যতম। সাগরের সাথে মহামিলনের তীর্থযাত্রায় এই নদী কয়েকটা দেশ অর্থাৎ চীন, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম অতিক্রম করে চীন সাগরে পতিত হয়েছে।তার ৪২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাপথে সে দক্ষিণ এশিয়ার সমগ্র মধ্যাঞ্চলকে প্লাবিত করে সমৃদ্ধ করেছে।বলা যেতে পারে যে, কেবলমাত্র মেকং নদী দিয়েই ইন্দোচীনের সকল দেশগুলোকে বিনিসুতোর মালায় গেঁথে ফেলা সম্ভব। আদিকাল থেকে এই নদীর তীরবর্তী অববাহিকার দেশগুলোতে গড়ে উঠেছে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা।যেগুলোকে কেন্দ্র করে বর্তমান পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদ, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লড়াই, প্রতিরোধ, সংগ্রাম ও বিপ্লব।এমনকি উত্থান-পতনও।

আরেকটু বলি।কম্বোডিয়ার রাজধানীর নাম নমপেন।১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে পলপটের নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন শহরে প্রবেশ করে। অতঃপর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে নানাবিধ সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযানের নামে তারা নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায়।এই গণহত্যায় আনুমানিক ৩০ লক্ষ কম্বোডীয় জনগণ মৃত্যুবরণ করে।

এমন প্রেক্ষাপটেই ১৯৯২-৯৩ সনে পরিচালিত হয়েছিল এই শান্তিরক্ষা মিশন তথা শান্তি অভিযান।এক বছরকাল আমার কেটেছিল মেকং অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নদী, বনভূমি, পাহাড়, সমতলভূমি আর মানুষদের সাথে। আনন্দ-বেদনার সাথী হিসেবে ও নিবিড় সখ্যতায়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বর্তমান থেকে দুই যুগেরও অধিককাল অতিক্রান্ত হলেও সেই সময়কালের বেশ কিছু স্মৃতি আমি বিস্তারিতভাবে স্মরণ করতে সক্ষম।যদিও এগুলো নিয়ে আমি কখনোই গভীরভাবে চিন্তা করিনি অথবা সেই সময়েও তেমন মনোযোগ দেইনি।বিশেষ করে কখনই ভাবিনি যে, বিষয়গুলো নিয়ে আমি ভবিষ্যতে কোনদিন লিখতে বসতে পারি!