ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-১২) ॥ মায়াবন বিহারিণী


হ্যালো মহাশয়, আমার পরীক্ষা দারুণ হয়েছে!
ওয়াও! আলহামদুলিল্লাহ।
জানো, খুব টেনশন ছিল সাধারণ জ্ঞান আর মানসিক দক্ষতা অংশ নিয়ে। সাধারণ জ্ঞানের সব পেরেছি আর মানসিক দক্ষতার একটি বাদে বাকিগুলো হয়েছে! সব আপনার আলোচনার মধ্যেই ছিল স্যার!

মানসিক দক্ষতার কোনটা পারনি?
একটু হোল্ড কর। মনা দ্রুত হাতে প্রশ্নপত্রটি বের করল। ও প্রিলিমিনারী পরীক্ষা দিয়ে মাত্রই নিজের রুমে ফিরেছে।
হ্যালো শোনো, তিনটি বৃত্তের ওপরের দিকে… এটা।
আহা, ওটা…এভাবে ভাবলেই হতো।
কেন যে গতরাতে ফোন বন্ধ রাখলাম! রাতে তোমার সাথে কথা হলে হয়ত ওটাও পেয়ে যেতাম, ইশ্!

আর তখনই মনার মাথার বাঁ পাশটায় একটি চিনচিনে ব্যথা এবং একটি প্রশ্ন গেঁথে গেল, আমার সমস্যার অংশের সবগুলো প্রশ্নই ও কীভাবে আগেই আলোচনা করে সহজ করে দিল?
কিন্তু প্রশ্নটি ও না পূরণকে করে উত্তর জেনে নিতে পারল, না নিজে ভেবে বের করতে মনোযোগ দিতে পারল! মাথাটা বামহাতে চেপে ধরে শুধু বলল, তুমি ফোনটা একটু রাখ প্লিজ! আমার মাথাটা খুব ধরেছে।

পূরণ ফোনটা রেখে দিল এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল! কারণ সে-ও আন্দাজ করছিল মনা হঠাৎই প্রশ্নটি করবে এবং তার কোনো সদুত্তর সে দিতে পারবে না।

পূরণ আঞ্চলিক মহাসড়কের একটা মোড়ের বড়ো বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মনার সাথে কথা বলছিল।গাছটির উত্তরপাশে মসজিদ, আর পিচঢালা পথটি দক্ষিণ দিক থেকে এসে বাঁক নিয়ে সোজা পশ্চিমে চলে গেছে।ওদিকেই শহর, মনা থাকে ওই শহরে।

পূরণের পাশ দিয়ে দলে দলে লোক মসজিদে যাচ্ছে, আর সে ব্যাকুল হয়ে সবার মুখ দেখছে।আসলে সে শুধু দেখছে না, খুঁজছে! খুঁজছে একটি চেনা মুখ, চেনা শরীর! যার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে মাস কয়েক আগে, এমনই এক ভরদুপুরে! তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে ও এখানে আসে আর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে চেনা মুখটি।

ইমাম সাহেবের খুতবা পাঠ শেষপর্যায়ে।প্রায় সব মুসল্লি মসজিদে চলে এসেছেন।এখন যে দু’চারজন আসছেন তারা বদনসিব।জুম্মায় উপস্থিত মুসল্লির খাতায় তাদের নাম আর তুলবেন না ফেরেস্তারা।

পূরণ বটগাছটির পূর্বমুখী ডালে উঠে বসল।এখানে কিছুটা হাওয়া দিচ্ছে। আশ্বিন মাসের পনেরো দিন যাচ্ছে অথচ কী গরম! কিন্তু কয়েক বছর আগেও মুরুব্বিগণ বলতেন, আশ্বিনে শিন শিন, মানে শীত শীত ভাব। ওরাও তা টের পেত এবং শেষরাতের দিকে কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাত। আর এখন!

নামাজ শেষে মুসল্লিগণ বেরিয়ে যেতে শুরু করলে সে আবার তাদের ওপর নজর রাখবে।যদি চেনা মুখটি দেখতে পাওয়া যায়! আচ্ছা, খুঁজে পেলে কী করবে পূরণ? এটা সে জানে না।ভাবেনি কখনো।সে শুধু জানে ওই মুখটি, ওই শরীরটি তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।নিজের জন্য, মনার জন্য, মনাকে পাওয়ার জন্য! এই করুণ বিরহকাল, এই বিচ্ছেদ ব্যথা তাকে খুব ভোগাচ্ছে, খু-উ-ব!

এমন নয় যে, মুখটিকে পূরণ শুধু এখানেই খুঁজে। বরং সব জায়গায় খুঁজে, সবসময় খুঁজে।তবু প্রতি শুক্রবারের ভরদুপুরে সে এখানে একবার করে আসে।কারণ উৎসে ফিরে আসবার ব্যাপারটাকে সে খুব বিশ্বাস করে। এখানেই সে হারিয়ে ফেলেছে তার প্রিয়মুখ।তাই এখানেই ফিরে আসে বারবার।বিশ্বাস করে কোনো একদিন এখানে কিংবা অন্য কোথাও তাকে অবশ্যই খুঁজে পাবে।

নামাজ শেষে একে একে সবাই বেরিয়ে গেল কেবল মুয়াজ্জিন ও খাদেম ছাড়া।তাদের এখনো কিছু কাজ বাকি আছে।সবকিছু গুছিয়ে, জানালাগুলো লাগিয়ে দরজায় তালা দিতে হবে।তালা দিতে হবে বারান্দার গ্রিলটাতেও।নয়ত চুরি হতে পারে! আহা, হা! কী করুণকাল! মসজিদেও চুরি হওয়ার ভয়ে থাকতে হয়!

আগের অনেক শুক্রবারের মতো আজও ব্যর্থ মনোরথে ধীরে খুবই ধীরে শহরের দিকে এগোল পূরণ।এখানে একটি প্রিয়মুখ খুঁজে না পেলেও ওখানে অন্য একটি প্রিয়মুখ রয়েছে তার অপেক্ষায়।সে বুঝতে পাচ্ছে, মনা আজ তার সাথে দেখা করতে চাইবে এবং বহুদিন ছলচাতুরী করে কাটিয়ে দেওয়ার পর হয়ত আজ তাকে ওর মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে!

পূরণ একটা ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে।হৃদয়ঘটিত বিচ্ছেদপ্রবণ শক্তিশালী একটা ঝড় ধেয়ে আসছে তাদের দিকে! অদৃশ্য সেই ঝড় মনাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে না তো? ভাবতেই শিউরে ওঠে সে! এই একটা ভয়ে এতদিন কোনোভাবেই মনার সাথে দেখা করতে রাজি হয়নি পূরণ। কিন্তু একদিন তাকে এমন একটা নির্মম সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে, সে তা জানে। হয়ত আজ পনেরো আশ্বিন রোজ শুক্রবার-ই সেই দিনটা!

চলবে…