কিছু কিছু কবিতা আছে যা পড়ার পরে হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে ওঠে অনুরণন। ঝড় তোলে স্নায়ুতে। সেইরকম একটি কবিতার লাইন এরকম-‘কালে ভদ্রে কলমে মেঘ এসে ভর করতো বলে/কেউ কেউ আমাকে কবি বলে ডাকতো/…প্রেমপত্র লিখতে লিখতে প্রেমিক/নিদান পত্র লিখতে লিখতে চিকিৎসক/…অফিসের বড়বাবু, রাজনীতিবিদ,/বুদ্ধিজীবী সব হওয়া গেল।/ কিন্তু আজ অবধি জানা হলো না,/ঠিক কী লিখতে জানলে মানুষ হওয়া যায়”(ডেজিগনেশ)।
কী অসাধারণ প্রতিটি লাইন। গেঁথে আছে লাইনগুলোর গভীর ব্যঞ্জনার অনুরণন। কবিতাটির লেখক আর কেউ নন। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও প্রকাশক নাহিদা আশরাফী। তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে’-এর অর্ন্তগত ৫ নং কবিতা ‘ডেজিগনেশ’ থেকে উদ্ধৃত। এই কাব্য গ্রন্থে এরকম হৃদয় নিংড়ানো ও হৃদয় স্পর্শী অসংখ্য কবিতা রয়েছে। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। এই কাব্য গ্রন্থের অর্ন্তগত প্রতিটি কবিতা পড়তে গিয়ে আমি সম্মোহিত হয়েছি। আমি ঘোরগ্রস্ত হয়ে ডুবে যেতে বাধ্য হয়েছি। এক টানা কবিতাগুলো না পড়ে গ্রন্থটি ছেড়ে ওঠা দায়। তাঁর কাব্যের কী এক যাদুকরী শক্তি! যা সত্যিই বিস্ময়কর। করোটির ভিতর শব্দের কী অবিরাম গুঞ্জন।
কবির দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গি সমুচ্ছল বেগবান নদীর মতো। যাতে থাকে আগামীর বহুমাত্রিক দিক নির্দেশনা। সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র, অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সর্বভূক্ত চিন্তার ব্যঞ্জনা কবির স্বাধীন মানসসত্ত্বার আওতায়। এই কবিতাটি পাঠ করা যাক-‘নীতি আমার বউয়ের নাম/নতুন সংসার, সীমিত সাধ্য/তবু আমাদের সময়গুলোকে/সে বুনে যেত কুরুসকাঁটার নিপুণতায়।/…অতঃপর লালসানামক মোহনীয়গ্ল্যামারগার্ল/সামনে এসে দাঁড়াতেই/আমি নীতিকে ভুলতে শুরু করলাম/জ্ঞাতে কিংবা অজ্ঞাতে/এখন আমার অনেক অর্থ/শুধু নীতিই প্রাক্তন হয়ে গেছে…’। (অর্থনীতি বনাম কুরুসকাঁটার ফুল, ১ম কবিতা)।
ভোগবাদীসমাজের নীতি-নৈতিকতাহীন মানুষগুলোর চরিত্রের প্রতি কী অপূর্ব ব্যঞ্জনায় সুতীক্ষ্ণ ফলার মতো সুতীব্র অপাঙ্গদৃষ্টি। এটাই কবিতার শক্তি। যেখানে আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতা ধরা দেয় অনায়াসে। নাহিদা আশরাফী তেমনি একজন দৃঢচেতা প্রতিশ্রুতিশীল শক্তিমান কবি। ভাবে, বিষয় বৈভবে, চিন্তনে, কাব্যিক গভীরতায়, ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কৌশল, শব্দের নান্দনিক ব্যবহার, উপমা উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব সব মিলিয়ে বলা যায় তিনি সার্থক কাব্য নির্মাতা। একজন কবি তাঁর মানবিক মানসসত্ত্বা নিয়ে কল্পিত মানবিক পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তাই বেদনার্ত হৃদয়ে কবি বলেন-“একটি কালো মাথাকে নত করতে/ব্যবহৃত হয়েছিলো একটা সাদা হাঁটু/অথচ একটি কালো মাথা/কোনও কিছু ব্যবহার না করেই/কোটি সাদা মাথাকে নত করেছে/এবার পৃথিবীকে প্রশ্ন করো হে বর্ণবাদ/কে বেশি শক্তি ধারণ করে/সাদা হাঁটু নাকি/কালো মাথা? (একটি নিরীহ জিজ্ঞাসা, ৪ নং কবিতা)। এটি লিখা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওডিনের হাঁটুর চাপে শ্বাসরোধে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। কতটা হতাশায় কবিতার ভাব ব্যঞ্জনায় তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই বৈরিতা মানুষের জিঘাংসা, হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ পৃথিবী, অর্থাৎ যাকে কোনো মানবিক পৃথিবী বলা যায় না। এখানে কেবল রক্তের হোলি খেলা। জীবনের মূলহীনতা কবির কাছে বড় বেদনার, অনেক বেশি যন্ত্রণার। অগ্নিন্মুখ রক্তস্নাত পৃথিবীতে আগমন করার জন্য নিজেকে বড় দুর্ভাগা বলে মনে করেন। কবির সরল স্বীকারাক্তি-“এই শহর এক আজব কর্পোরেট ব্যাংক/মৃত্যু, বিষাদ আর পোড়া লাশ জমানোর জইন্যে/এর চাইতে অভিজাত ব্যাংক/আপনে আর কই পাইবেন?” (এ শহর জানে শুধু দুঃখশুমারি, ৪৪ নং কবিতা। এই কবিতাটি লিখেছেন, বনানীতে এসি’র বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ প্রাণ, যারা বেঁচে থেকেও প্রতিনিয়ত আগুনেই পুড়েছ তাদের প্রতি)।
সেরকম আরো কয়েকটি কবিতা আছে এ গ্রন্থে যা পড়তে পড়তে পাঠক হৃদয় ব্যথিত হবে। আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতাকে দেখবে এক ভঙ্গুর কাঁচের আয়নায়। তাইতো কবি ব্যথিত হৃদয়ে বলেন-“মনে করুন, আপনি এমন এক শহরে থাকেন যার আকাশে কোনও মেঘ জমে না।/কিছু তাজা লাল রক্ত প্রায়ই উড়ে গিয়ে মেঘের ঘাটতি পূরণ করে।/মনে করুন, আপনি এমন এক শহরে থাকেন যে শহরের সন্তানেরা ঈদ অথবা পূজাপার্বণে/কিনে আনে পিতার কাফনের কাপড় অথবা চিতার কাঠ/…মনে করুন, জীবনের বদলে জিঘাংসা/মনে করুন রাষ্ট্রের বদলে রাত্রি।/মনে করুন… মনে করুন… মনে করুন…/কত আর মনে করবেন?/এতটুকু মনে আর কতইবা ধরে।/তবু শেষবারের মতো/মনে করার চেষ্টা করুণ,/আপনি বেঁচে আছেন তো?”। (মনে করুন, ১৯ নং কবিতা)।
এসব কবিতায় সমাজ চিত্রের হাহাকার থাকলেও। কবি নাহিদা আশরাফী হতাশায় ডুবে আত্মহত্যাকে যারা বেঁচে যাওয়ার শ্রেষ্ট উপায় বলে মনে করেন তাদেরকে আশার বাণী শুনিয়েও কাব্য লিখেছেন। জীবনের দূরন্ত সময়ে বহু বন্ধুর পথ মাড়িয়ে অলৌকিক স্বপ্ন-বিশ্বাসের পাল তুলে প্রবাহিত হয় মানুষের জীবন তরী। কখনো কখনো নিষ্টুর বাস্তবতার নির্ঘাত আক্রোশে নিপাতিত হয় বিশ্বাসের বিমল হাসি। কবির পাললিক চিন্তার বুননে এই মাটির মমতায় যে স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরোদগত, তা যেন বিনাশের বিষবাষ্পে আচ্ছাদিত। আত্ম জিজ্ঞাসায় বিমৃঢ কবি তাই লিখেন-“জন্মেই মৃত্যুর দরিয়ায় সাঁতার কাটে মানুষ/মৃত্যু মেশানোর জলে কী যে এক নেশা/সে নেশার ঘোর ভুলিয়ে দেয় সন্তরণের ইতিহাস/ডুবতে ডুবতে ভাবে/এটাই বুঝি বেঁচে থাকার একান্ত গোপন কৌশল…”। (মৃত্যু দরিয়ায় সাঁতার কাটা মানুষ, ২০ নং কবিতা)।
নাহিদা আশরাফীর কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এক ধরনের গীতিময়-শীতলতার স্পর্শ অনুভব করা যায়। তাঁর কবিতা শান্ত, স্নিগ্ধ, মৃদু উচ্চারণের ও পরিমিতি বোধের। অথচ রয়েছে মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের টানা পোড়েন ও সুক্ষাতিসুক্ষ ঘটনাবলীর দৃশ্যমানতা। যা শিল্প-সুন্দরে স্পর্শ করতে চায় আশ-পাশ। হৃদয়ের কোমল বৃত্তিগুলোকে সজাগ করে নবসুরে নবগীতে নব উদ্বোধন হয়ে উঠতে চায়। তাই তো কবি বলে উঠেন, “মাসের শুরু হিসেব দিয়ে/ মাসের মাঝেই ঝিমাই নিয়ে/দুঃখবোধের রাশি/সব ছাপিয়ে তবুও এই/ছেঁড়া ফাটা জীবনটাকেই/অনেক ভালোবাসি” (মধ্যবিত্তের হাসি, ৭ নং কবিতা)।
আলোচ্য গ্রন্থের কাব্যগুলো পাঠ করে যা বলতে ইচ্ছে হয়, সেটি হলো: তার কবিতা জীবনকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করার কবিতা। অন্তত সেই চেষ্টাটাই যেন কবি এই গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করে গেছেন। অমিয় চক্রবর্তী তাঁর একটি কবিতায় যেমনটি করে বলেছিলেন: “জীবন, জীবন-মোহ,/ ভাষাহারা স্বপ্নের বিদ্রোহ”-সেই কথাটির সারবত্তা অনুসরণ করেও একেবারে নিজের মতো তিনি বলে গেছেন এ সমাজের দ্বিচারী মানুষের মিথ্যাচারের কথা। কবি নাহিদা আশরাফীর সব থেকে বড় অর্জন হলো তিনি শব্দকে সার্থক করে তুলতে পারেন এবং তার সত্য প্রকাশের শংকাহীন বৈভবনিশ্চল চিন্তার বিবর্তনে ম্লান হয়ে যায় না। এজন্য তার কবিতার ঘুর্ণন দোলায়িত করে পাঠক হৃদয়কে। বলা যায় নাহিদা আশরাফী সমাজ সচেতন কবি। তার কবিতায় যেমন উঠে আসে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, তেমনি উঠে আসে নাগরিক যন্ত্রণা। কবির উচ্চারণ:- “পিটিয়ে মারো, কুপিয়ে মারো মানুষ, সংবিধানের শরীর ভরুক দাগে/আমরা তো সব পা চাটা দলের শুয়োর/গাইবো ভজন বিচিত্র অনুরাগে” (নিষিদ্ধ লোবান, ১৫ নং কবিতা)।
শিল্পের মতো শরীরে কবিতার মতো মারণাস্ত্র যে কবির হাতে, এ জীবনে তাঁর কিসের ভয়? ভোগান্তির? তা সে যতই আসুক, আলোর গভীরে গিয়ে কবি আত্মস্থ হতে জানেন। সেজন্য আলোচ্য গ্রন্থের ‘ভাতবাজেট’ কবিতায় তিনি বলেন-“আমাদের সংসারসংসদে/আমাদের সমবেদনার সচিবালয়ে/আজ থেকে পেশ করা হোক-, ভাতবাজেট”। তেমনি ভাবে আরো সাহসী উচ্চারণ দেখা যায় তাঁর “চৌকস চোর” কবিতাটিতে। তিনি বলেন-“চুরির মহিমা দেখি সারাদিন রাত/রজনীর শুরু থেকে রজনীপ্রভাত/তারপর মাঠে মাঠে কথার অবাদ/নেতারা বলেন চুরি করা মহাপাপ”। কী অসাধারণ কটাক্ষ আমাদের সমাজ পতিদের প্রতি! এখানেই কবি নাহিদা আশরাফীর কবিত্ব শক্তি ও বিশেষত্ব।
কবিতার ক্লাসে বিখ্যাত কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বলেছেন, “বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না, তেমনি কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না”। নাহিদা আশরাফীর প্রতিটি কবিতা কাব্যগুণে অনন্য সাধারণ। তার কবিতায় প্রেম ও রোমান্টিকতা উঠে আসে অনাবিল সৌন্দর্য্যে, যা পাঠক পাঠ করা মাত্রই অপরূপ কাব্যের গহীনে হারিয়ে যায় ও নিমগ্ন হতে বাধ্য হয় কবিতায়। যেমন-“তোমাকে ছুঁয়েছি/তাতেই পুড়ল ঘর, পুড়ল দেবালয়/কে জেনেছে কবে/ স্পর্শে এত আগুন জুড়ে রয়”। (তোমাকে চেয়েছি, ৪৩ নং কবিতা)।
নাহিদা আশরাফী তার কাব্যে বহুমুখী চিন্তা, দর্শন, মানবিকতা, দেশ, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতিকে নিপুন চিত্রকল্পে দক্ষ শিল্পীর মতো ফুটিয়ে তুলেছেন নান্দনিক ঐশ্বর্যে। তার কবিতার আরেকটি দিক হলো-মানুষের আগমন প্রস্থানের নিদারুণ বাস্তবতাকে তিনি কোনভাবেই এড়িয়ে যাননি। বরং পরাবাস্তবতাকে স্বীকার করে তার জন্যে এক প্রকার প্রস্তুতিও তিনি গ্রহণ করেছেন। নাগরিক জীবনের জটাজাল ছিন্ন করে কবি নিবিড় নির্জন প্রকৃতিতে খোঁজেন তার আশ্রয়। প্রকৃতির কাছে তার পরম নির্ভরতা। তিনি উচ্চারণ করেন-“ওহে আকাশ/এ মৌসুমে তাই শরৎ হতে চাই/যার কিশোরী প্রণয় জমে বর্ষার সাথে/অথচ হেমন্তকে পেলেই চোখে জাগে/মহুয়ার নেশা মাথা প্রেম”। (এ মৌসুমে শরৎ হতে চাই, ৫৪ নং কবিতা)।
বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত কবি শার্ল বোদলেয়ার কবিতা বলতে বুঝতেন, এমন রচনা, যার মধ্যে কবিতা ছাড়া কিছুই নেই, যার প্রতিটি পঙক্তি ও শব্দ, মিল ও অনুপ্রাস, রসের দ্বারা সমগ্র সুপক্ক ফলটির মতো, কবিতার দ্বারা আক্রান্ত”। আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা সুপক্ক এবং যার মধ্যে যে কোন পাঠক কবিতা ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পাবেন না। এখানেই নাহিদা আশরাফী অন্যান্যীব কবিদের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র্য।
এই গ্রন্থের নাম কবিতাটি “ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে”। ২৩ নং কবিতা। দীর্ঘ একটি কবিতা। কবিতাটি পড়তে পড়তে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার যেন টি এস এলিয়েটের “দ্য ওয়েস্টল্যান্ডকে” মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু নাহিদা আশরাফীর এই কবিতাটির নিজস্ব একটি তাৎপর্য ও শক্তি রয়েছে বলেই তার কবিতা পাঠে আমরা সাধারণ পাঠক বিস্মিত হই। যেমন তিনি আলোচ্য এই কবিতায় লিখেছেন, “পাখিদেরও বলো, আমি অনুগত ছাত্রের মতো শিখে নেবো তার ভাষা।/নদীকে বলো, তার অজস্র বাঁক বদলের আনন্দকে আমি আর কখনই সন্দেহবাজ প্রেমিকের চোখে দেখবো না।/ঝর্ণাকে বলো, প্রয়োজনে পাথর হয়ে বুক পেতে দেবো…”। কী অনন্য ও অসাধারণ মুন্সিয়ানায়, রূপক ও উপমার সংমিশ্রনে এ কাব্যের প্রতিটি লাইন গ্রন্থিত। তাই তো পাঠক চিত্ত বিনোদিত হয়। কবিতা পাঠ যেমনটি মানুষের মস্তিস্ক ও চিত্তের খোরাক, ঠিক তেমনি।
দীর্ঘ কবিতা বলে এ বিষয়ে সংকোচ করার কোন কারণ নেই। বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত লেখক ও কবি এডগার অ্যালান পো থেকে আমাদের বাংলা ভাষার কোনো-কোনো কবি দীর্ঘ কবিতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চান নি। প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের মতো কবিও বলেছিলেন, “আমারও কখনো কখনো…মনে হয় দীর্ঘ কবিতায় একটি ছোট কবিতাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড়ো করে দেওয়া হয়। বা দীর্ঘ কবিতাটি শুধু কয়েকটি ছোট কবিতার যান্ত্রিক সংযোজন”। পশ্চিমের রাইনের মারিয়া রিলকে থেকে টি এস এলিয়েট-ইয়েটস কিংবা আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে প্রমুখ কেউই এরকম কথা ঠিক মানতে চাইবেন না। কেননা দীর্ঘ কবিতা যদি জীবনের গভীর উদ্ভাসন আর উপলব্ধিকে উপমা, চিত্রকল্পে আর কাব্যিক উপকরণে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, তাহলে তাতেও কবির সিদ্ধি অর্জন সম্ভব-এমনকি আজকের দিনেও।
আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে কিছু দীর্ঘ কিন্তু অনবদ্য কবিতা রয়েছে। যেমন-জীবন-শূন্যতার বিপরীতে, প্রতিনিধি, স্বাধীনতা-এক অবাক আলোর জোনাক, একজন সত্যন্বেষীর সাক্ষাৎকার (এটি মূলত সংলাপ ধর্মী কবিতা) ইত্যাদিসহ আরও রয়েছে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সেই দীর্ঘ কবিতাটি “কোথায় নেই তুমি”। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত একটি অনন্য সাধারণ কবিতা। যা এখন বিভিন্ন সময়ে এফ এম রেডিও ঢাকা থেকে প্রচারিত প্রভাতি অনুষ্ঠানেও শোনা যায়। আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতা পাঠকের ধৈর্য্য চূত্যি ঘটাবে হেতু, কবিতাগুলোর ব্যবচ্ছেদ এতটুকুতেই থামতে হলো।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে মোট ৫৬টি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। যার প্রতিটি কবিতা পাঠক হৃদয়কে উদ্বেলিত ও উৎফুল্ল করবে।
নাহিদা আশরাফীর ‘ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে’ নামকরণে যেমন রয়েছে স্পর্ধিত শিল্প সুষমায় ভরা। তেমনি সমকালীন অসংখ্য কবিদের থেকে তাকে কিছুটা হলেও ভিন্নভাবে দাঁড় করিয়েছে। তার কবিতা যেন নাক্ষত্রিক সম্ভাবনায় সমুদ্ভাসিত। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে তার লেখার সাথে আমার পরিচয় হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ÒTenets of SadnessÓ বা “বিরহ সূত্র” পাঠের মাধ্যমে। এরপর তার কয়েকটি গল্পগ্রন্থ ও অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য গ্রন্থ “প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে” এবং আরো অনেকগুলো সম্পাদনা গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে। তবে যতটুকু পড়ার সুযোগ পেয়েছি নাহিদা আশরাফিকে, তার কাব্য নির্মাণশৈলী আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে তার কাব্য বুননের দক্ষতা আমাকে সবিস্ময়ে অভিভূত করেছে।
এটি তার ষষ্ট কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও তার অনেকগুলো গল্পগ্রন্থ রয়েছে যা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে সাধারণ পাঠকের কাছে। অসাধারণ সব হৃদয়স্পর্শী কাব্য সম্বলিত এই কাব্যগ্রন্থটির দুর্বলতম কিছু দিক না বললেই নয়। গ্রন্থটির কাগজ, প্রিন্টিং ও বাঁধাই আরো উন্নতমানের হতে পারতো। তাতে সব শ্রেণির পাঠক উপকৃত হতো। কিছু কিছু মুদ্রণ প্রমাদ পাঠ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। যা প্রকাশককে লক্ষ্য করা দরকার ছিলো। আশা করবো ভবিষ্যতে গ্রন্থটির প্রকাশক বিদ্যা প্রকাশ এই বিষয়ে সুনজর দেবেন। হার্ডকাভার পেপারটিও বেশ মানসম্মত নয়। যা অতি উঁচুমানের কাব্য সম্বলিত গ্রন্থটির প্রতি সুবিচার হয়েছে বলে মনে হয়নি। দৃষ্টিনন্দন ও হৃদয়গ্রাহী প্রচ্ছদটি গ্রন্থটিকে চিত্রাকর্ষক করেছে। সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি আর্কষণ করবে অতি সহজে।
সর্বোপরি প্রত্যাশা থাকবে, বোধের গভীরতায় নাহিদা আশরাফীর কাব্যভাষা যেন আরো বেশি বিমূর্ত ক্যানভাসে কাব্যরূপ পায়। আমার অত্যন্ত প্রিয় এই কবির জন্য শুভকামনা। কবির কলম শিল্পমুখর থাকুক আমৃত্যু। আমি এই অতীব উঁচু মানের, হৃদয়স্পর্শী কাব্য সমৃদ্ধ গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করেছি।
অভিনন্দন কথাশিল্পী, কবি, গল্পকার, সম্পাদক ও প্রকাশক নাহিদা আশরাফীকে। আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের জন্য অসাধারণ কাব্যগ্রন্থটি উপহার দেওয়ার জন্য। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে একটি উঁচু স্থান দখল করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।
গ্রন্থ: ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে
লেখক: নাহিদা আশরাফী
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশক: বিদ্যা প্রকাশ
প্রকাশ কাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
দাম: ২২০ টাকা।