শিল্প প্রকরণ :
শুধু বিষয়বৈভবের তরঙ্গ প্রবাহেই নয়; শিল্প প্রকরণের দিক দিয়েও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর আবির্ভাব রাজস্বিক।তিনি বিষয় উপযোগী ভাষা ও রচনারীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে গল্পগুলোকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। তবে গঠন কাঠামোতে কিছু কিছু গল্পের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন হলেও অধিকাংশ গল্প শিল্পোত্তীর্ণ বটে।গল্পকার ভাব অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারের যেমন পারমঙ্গতা দেখিয়েছেন তেমনি আরবি-ফারসি, হিন্দি ও ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।নিম্নে কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:
ক. আরবি-ফারসি ও হিন্দি শব্দের ব্যবহার:
১. করছিস কি, করছিস কি হারামজাদা? (সম্রাটের ছবি, সম্রাটের ছবি)
২. তোর বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ যার নিমক খেয়ে মানুষ (ঐ)
৩. এদের জাত, মান, পর্দাপুষিদা, ইজ্জৎ আছে (ঐ)
৪. কিন্তু নসিবের ফের গেল না (নীল কমল, সম্রাটের ছবি)
খ. নাগরিক জীবনে ব্যবহৃত ভাষার ব্যবহার:
১. আমার মনে হয় কি জান? কাশেম এইবার বাজারের আঁচ পাইছে, বেশ লাভ অইবে বুঝাই তোমারে না জানাইয়া মহাজনকে লাভ ইট্টু বেশি দিয়া গাছগুলো নিতে চায়।শত অউক তবু তুমিও আমার কাছে ফেলনা নও, তুমি এককেবারে ঠইক্যা যাইবা, তাই কথাডা কইলাম।কারও কাছে কইও না, ভাইব্যা দেইখ্যো। (আতঙ্ক, সম্রাটের ছবি)
২. রাস্তা শেষ হয়ে গিয়েছে মাটির রাস্তায়।মাটির রাস্তা গিয়ে মিশেছে দূরে ঝালকাঠি বন্দরে পাকা সিমেন্টের রাস্তায়।মাঝখানে গ্রামের আলপথ। মাটির বড় রাস্তা একটা আছে।এখন চিহ্নমাত্র সার।সুপারী বনের ফাঁকে ফাঁকে সে রাস্তা মিলিয়ে গেছে ঢেউতোলা ধানক্ষেতে গিয়ে।আর সেই ধানক্ষেতের ওপারেই আজমল সাহেবের বাড়ি।কমর খালার স্বামী। চৌচালা টিনের ঘর।সামনে টানা বারান্দা, পেছনে গোয়াল।বিকেলে বাড়ি ফিরে গরুকে নিজ হাতে ঘাস জল দিতেন আজমল সাহেব। (বিনিদ্র, সম্রাটের ছবি)
ভাষাই সাহিত্যের প্রাণ।ভাষা ব্যবহারে তিনি যেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি অলঙ্কার প্রয়োগেও রেখেছেন নিপুণতার স্বাক্ষর।বিভিন্ন প্রকার শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার প্রয়োগ করে তিনি গদ্যকে করেছেন শাণিত।নিম্নে আমরা এ বিষয়ে আলোকপাতের প্রয়াস পাচ্ছি:
ক. অনুপ্রাস :
১.ভিজে ঝাড়ু দিয়ে ঘরের মেঝে মুছে, দেয়াল পরিষ্কার কর অবশেষে চাকর হাত দিল ছবিটায়।(সম্রাটের ছবি, সম্রাটের ছবি)
২. হঠাৎ একেবারে হা হা করে উঠলেন, করছিস কি, করছিস কি, হারামজাদা? (ঐ)
৩. সিংহদরজার দুই দিকের দুই গম্বুজে দুই সিংহমূর্তি স্থাপিত। (নীল কমল, সম্রাটের ছবি)
৪.কিন্তু তার জন্য সেই আটপৌরে মনটির চরিত্র চিত্রণে এ গিয়ে আসতে হত তাঁদের, যাঁরা সেই মনটি চেনেন। (ঐ)
৫.হাট, বাজার, মন্দির, মসজিদ, হিন্দু, মুসলমান, চাষাভূষা, জোতদার, জমিদার, মিলে একাকার।(আদিম, সম্রাটের ছবি)
৬.সত্যি, সাহানা মেয়েটি সুন্দরী।পাথরে কুঁদে গড়া শরীর যেন, অথচ মনে হয়, ছুলে এখনি মোমের মত গলে যাবে।যেমন ঘন চুলের বুনুনি, তেমনি আশ্চর্য নীল চোখ। (চেহারা, সম্রাটের ছবি)
৭.একেক দিন একেক রঙের শাড়ি পরেন।আর গাঢ় রঙটার দিকেই তাঁর ঝোঁক যেন বেশি। কোনদিন লাল, কোনদিন নীল, কোনদিন টিয়ে সবুজ, কোনদিন খয়েরি, কোনদিন জাফরানি, যেদিন যেমনটা খুশি। (অন্য কোনখানে, সম্রাটের ছবি)
৯.বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে দোলা খেল সকলে।বিশ্বাসটুকু ঈর্ষা-বিষের তীব্রতায় ভরা। (কুমকুম, সম্রাটের ছবি)
১০. আবার কোনদিন আসতে আসতে অন্যদিকে চলে যায়। (উপাখ্যান, সম্রাটের ছবি)
খ. উপমা :
১.চোখের গভীর খাদে বাতির ‘শিস’ পড়ার মত একপোঁচ কালির প্রলেপ। (নীল কমল, সম্রাটের ছবি)
২.ক্রমশ: উটের পিঠের মত কাঁচা মাটির স্তর জমাট হয়ে চরের পরিধি বাড়াচ্ছে। (আদিম, সম্রাটের ছবি)
৩.সঙ্গের লোকটি অর্ধপ্রৌঢ়।তালগাছের মত শক্ত, ঋজু, ক্রুর চেহারা। (ঐ)
৪.বর্ষার অন্ধকার আকাশ মৃত্যুর মত নিথর স্তব্ধ। (ঐ)
৫.সাপের তীক্ষ্ম শিসের মত অন্ধকার চিরে চিরে জেগে উঠেছে তার সাফল্যের উল্লাস। (ঐ)
৬.পেসেন্ট-চেম্বারে ঢুকেই তিনি একেবারে শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠে বললেন, দেখুন, রোগী আমি নই। (চেহারা, সম্রাটের ছবি)
৭.কবুতরের নরম ডানার মত শাদা লঘু মেঘ ভাসছে, তার মাঝে মাঝে ফুটা-ফাটা নীল আকাশ। (নতুন গোধূলি, সম্রাটের ছবি)
৮.আর তারই সংঘাতে এদের সুকুমার চিত্রও ভোরের শিশির মেখে ফুলের তাজা কোরকের মত পাঁপড়ি মেলতে পারে না। (ঐ)
৯.একটু দূরে মরা সাপের দেহের মত আঁকা বাঁকা রেলপথ। (ঐ)
১০.পাঁচ বৎসরের অভ্যাসে এ হাতের লেখা তো ভামজীর কাছে সরলরেখার মত সহজ। (লাল মেঘ, সম্রাটের ছবি)
১১.ওস্তাদ সমজদারের মত সবাই মাথা ঝাঁকাচ্ছে, তাল ঠুকছে। (আতঙ্ক, সম্রাটের ছবি)
১২.গাছের উঁচু নীচু ডালে অসংখ্য জোনাকির মত অসংখ্য আলোর বিন্দু জ্বলতে থাকে। (অন্য কোনখানে, সম্রাটের ছবি)
১৩.সবুজ আলো নীচে একটি মুগ্ধ বাসনা স্বপ্নের মত উজ্জ্বল। (ঐ)
১৪.বৃষ্টিধোয়া আকাশে অগুনিত তারা অন্ধকারের মাঝ নদীতে নোঙর করা সাম্পানের বাতির মত জ্বলছে। (কুমকুম, সম্রাটের ছবি)
১৫.মনটা গুমোট হয়ে আছে, ওই আকাশেরই মত। (ঐ)
১৬.বাদুড়ের ডানার মত কালোরাত নেমেছে সারাগ্রাম জুড়ে। (দুই শরিক, সম্রাটের ছবি)
১৭.সমুদ্রের মত একটানা নীল দিগন্ত (বিনিদ্র, সম্রাটের ছবি)
১৮.উড়ে এসেছে সাদা বকের পাখনার মত টুকরো টুকরো মেঘ। (ঐ)
১৯.বাজপাখির মত নয়, সম্রাট আওরঙ্গজেবের মত উঁ নাকে আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ। (ঐ)
২০.লতিফ চাচার মত গোল করে কাটা টুপি। (রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি, বাংলাদেশ কথা কয়)
গ. উৎপেক্ষা :
১.তাঁর মুখের অমন সুন্দর রং চুষে নিয়ে কে যেন স্থানে স্থানে কালি লেপে দিয়েছে। (নীল কমল, সম্রাটের ছবি)
২.পানের রস সিক্ত তাঁর লালচে দাঁতগুলো যেন আমার সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠল। (ঐ)
৩.গায়ের রঙে যেন এক কিশোর রাজপুত্র। (ঐ)
৪.দু’কূল প্লাবিত বিপুল বন্যাবেগে সংহার-মূর্তির মত ইলশা তার মহাসামুদ্রিক বাহুর বেষ্টনে যেন সোনাকান্দিকে মুছে ফেলতে চায়। (আদিম, সম্রাটের ছবি)
৫.স্বাস্থ্যপুষ্ট দেহের রেখায় শাণিত তলোয়ারের আভা যেন চমকায়। (ঐ)
৬.চ ল চোখের দৃষ্টিতে স্থির সন্ধ্যাতারার আলোটা একটা ধূর্ত হাসিতে নুয়ে পড়ল যেন। (ঐ)
৭.সত্যি, সাহানা মেয়েটি সুন্দরী। পাথরে কুঁদে গড়া শরীর যেন, ছুঁলে এখনি মোমের মত গলে যাবে। (চেহারা, সম্রাটের ছবি)
৮.সেই ছবিতেও যেন তার আঙুলগুলো বীণার তারে ঘুরছে, নাচছে। (নতুন গোধূলি, সম্রাটের ছবি)
৯.তাঁর ভীত মুখ থেকে কে যেন সব লাবণ্য শুষে নিয়েছে। (ঐ)
১০.পথে নেমে হোসেনের স্ফূর্তি যেন দানা বেঁধে উঠল। (আতঙ্ক, সম্রাটের ছবি)
১১.তার মাঝে লাভ লেনের জীবনের যেন বাড়তি রয়েছে কিছুটা চাকচিক্য, ফাউবিস্ময়। (অন্য কোনখানে, সম্রাটের ছবি)
১২.শরীরের আশ্চর্য গোলাপী রঙের সঙ্গেও যেন সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। (ঐ)
১৩.একটা মলিন বিমর্ষতা যেন ফুটে ওঠে আশরাফ আলমের মুখে (ঐ)
১৪.বৃষ্টি যেন আকাশ গলে ঝড়ছে।(কুমকুম, সম্রাটের ছবি)
১৫.অন্ধকারে সেই অকম্প চোখের মণি দুটো যেন সাঁতরাচ্ছে। (ঐ)
১৬.একটি নৃত্যপরা মেয়ে যেন বন্দী হয়ে রয়েছে ওই কৌটোর গায়ে। (দুই শরিক, সম্রাটের ছবি)
১৭.নেকবখত আওরত, সারা শরীরে যেন বিজলি চমকাচ্ছে, এমন রোশনাই। (ঐ)
১৮.দিকহীন সমুদ্র একটি নৌকা যেন একসঙ্গে একশ দাঁড় বেয়ে ছুটে যাচ্ছে নিরুদ্দেশ ভ্রমণে। (বিনিদ্র, সম্রাটের ছবি)
১৯.আকাশের অগুণিত তারা জ্যোৎস্নার রেণু পান করে যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। (ঐ)
২০.দীর্ঘ এক যুগের এক মোহনিদ্র থেকে যেন জেগে উঠলেন কমর খালা (ঐ)
২১.বাইরে রোরুদ্যমান বাতাস অন্ধকারে গাছের ডাল-পালায় লুটিয়ে পড়ে যেন ফুঁসছে।(ঝগড়া, সম্রাটের ছবি)
২২.শওকত যেন হতভম্ব হয়ে গেল। (উত্তরণ, সুন্দর হে সুন্দর)
২৩.দুজনেই যেন আবার দু’জনের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। (কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ)
২৪.আপন মেরুদণ্ডের উপর পৃথিবী যেন ভ্রƒক্ষেপহীন পরিক্রমায় রত (বৃত্ত, কৃষ্ণপক্ষ)
ঘ. রূপক :
১.চাঁদটা এরই মধ্যে খন্ডমেঘের আড়ালে লুকিয়ে সাদাহাসি বিকিরণ করছে। (নীল কমল, সম্রাটের ছবি)
২.মনের হিংস্র উত্তেজনা কথার আওয়াজে ফুটে বেরুতে চায়। (আদিম, সম্রাটের ছবি)
৩.আকাশের খণ্ড খণ্ড মেঘে অস্তাচলের রঙ লেগেছে।বর্ষার কালো মেঘের রেখায় রক্তাভা। (ঐ)
৪.সূর্যের পথ-পরিক্রমায় সমস্ত পৃথিবী উজ্জ্বল। কৃষ্ণচুড়ার গাছগুলোয় ফুল ফুটেছে গাঢ় লাল রক্তবর্ণ। (নতুন গোধূলি, সম্রাটের ছবি)
৫.কুয়াশা-ম্লান চাঁদের আলো বাগানে গাছ-পালার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। (আতঙ্ক, সম্রাটের ছবি)
৬.কুয়াশা-ম্লান চাঁদ জাগা আকাশ লাল হয়ে উঠছে।লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে আকাশের পূর্ব কোণ জুড়ে। (ঐ)
৭.গত রাতে নিজ হাতে আমি যে তাকে পুড়িয়ে মেরেছি। (অন্য কোনখানে, সম্রাটের ছবি)
৮.নৈঋত কোণে কালো মেঘ আর ঈশানে শাদা মেঘের জটলা। (কুমকুম, সম্রাটের ছবি)
৯.তাকিয়ে রইলাম, খোলা জানালা দিয়ে গোধূলি সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ রক্তরাগটুকুর দিকে। (বিনিদ্র, সম্রাটের ছবি)
১০.মিথ্যে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে কি লাভ (ঝগড়া, সম্রাটের ছবি)
ঙ. প্রবাদ-প্রবচন
১.বেনে বেদে সোনরু, তিনকূলে নয় কেউ কারো। (দুই শরিক, সম্রাটের ছবি)
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে এ কথা বলা যায় যে, বাংলাদেশের ছোটগল্পে আবদুল গাফফার চৌধুরীর অবদান প্রাতিস্বিক। তিনি সমাজ বাস্তবতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে পুুঁজি করেই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্রের পসরা সাজিয়েছেন। সেই সঙ্গে শিল্পনৈপুণ্যের সমারোহে গল্পগুলোকে করেছেন কালোত্তীর্ণ।বিষয়ভৈবব ও শিল্পগুণের নিক্তিতে তাঁর ছোটগল্পগুলো উচ্চমার্গের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সমাপ্ত