প্রতিদান সামান্য হলেও মানবিক পৃথিবীর সমান ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


জাপানিদের সেকিনিনকান বা দায়িত্বজ্ঞান অত্যন্ত প্রখর এবং গভীর। এককথায় অতুলনীয়।জাপানিরা কারো দ্বারা সামান্যতম উপকৃত হলেও ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না।তার প্রতিদান দেবার জন্য ঘুম হারাম করে ফেলেন।কী করলে, কী দিলে, কী বললে যথার্থ প্রতিদান হবে তাদেরকে রীতিমতো ভীষণ ভাবনায় ফেলে দেয়।অনেকের কাছে তা অতিরিক্ত বলে বিরক্তির কারণ হতে পারে।সামান্য উপহার পেলে বা উপকৃত হলে তারচেয়ে যত বেশি প্রতিদান দেওয়া যায় সেটা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে পড়ে।নিজের স্ত্রী জাপানি বলে সেটা প্রত্যক্ষ দেখে আসছি প্রায় ৪০ বছর ধরে।

আর যদি জাপানিদেরকে অনুরোধ করেন তাহলে তারা সম্ভব হলে অনুরোধ শুনবেন এবং রক্ষা করার জন্য যাবতীয় যা কিছু করার করবেন নির্ভুলভাবে।সম্ভব না হলে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চাইবেন।

কিন্তু সেই ব্যক্তিই যদি শত উপহার দেন বা উপকার করে থাকেন, সামান্য ভুলের বশে অপমানজনক আচরণ করেন জাপানিরা সহজেই তাকে পরিত্যাগ করেন, ভুলেও তারা আর কোনোদিন ফিরেও তাকান না।জাপানে দীর্ঘকাল বসবাস এবং জাপানি সমাজে মিশে যাওয়ার ফলে আমার চরিত্রেও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।আমিও বিগত দিনে বেশকিছু বাঙালি ও জাপানিকে পরিত্যাগ করেছি উপকৃত হওয়া সত্ত্বেও। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীও রয়েছেন।আমি তাদের আচরণে উন্নাসিকতা, আমার দেশ ও জাতি সম্পর্কে অসত্য বলা, অহেতুক আমাকে শিশুভেবে অতিরিক্ত গালাগাল করা এবং সজ্ঞানে অবজ্ঞা করার আলামত প্রত্যক্ষ করেছি। ফলে সেই উপকারটা অর্থহীন হয়ে গেছে।

সুতরাং এইসব কারণে জাপানিরা বিরাগভাজন হয়ে থাকেন, এটা সচেতনতায় রাখা জরুরি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধকালীন জাপানিদের দ্বারা কোরিয়া, চিনসহ এশিয়ার দেশগুলোতে যা ক্ষতি হয়েছে তার কয়েকগুণ বেশি প্রতিদান দিয়েছে।এখনো দিয়ে যাচ্ছে।অথচ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জার্মানি কিছুই করেনি।এত ক্ষতি করেছে আমেরিকা জাপানের যার নজির নেই ইতিহাসে, আজ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা দূরে থাক, জাপানকে উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে বললে অতিরিক্ত বলা হয় না।সচেতন জাপানিরাই বলছেন।

কোরিয়া ও চিন জাপানের বিরুদ্ধে বহু মিথ তৈরি করেছে।জাপান কিছুই বলেনি।কিন্তু কী পরিমাণ উপকৃত হয়েছে জাপানের দ্বারা বিগত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে দুটি দেশ তারও নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন।কিন্তু আজ পর্যন্ত সামান্য ধন্যবাদটুকুও তারা দেয়নি।এখন জাপান এই দুই দেশকে পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাঙালির মধ্যে দায়িত্বজ্ঞান কতখানি আছে, তা আর বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।যারা সচেতন তারা ভালো জানেন।মাঝে মাঝে এমন কতিপয় বাঙালি দায়িত্বজ্ঞানের উদাহরণ স্থাপন করেন যা আশাব্যঞ্জক এবং মনকে আলোকিত করে।জাপান প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও সম্পাদক কাজী ইনসানুল হক তেমনি একটি অপরিমেয় কাজ সম্পাদন করতে চলেছেন।তাঁর সম্পাদিত প্রয়াত প্রাক্তন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে (আবে শিনজোও) নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ শিগগিরই আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।তাঁকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন। কেন তিনি এই দায়িত্বপূর্ণ উদ্যোগটি নিলেন তা সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট করবেন বলাই বাহুল্য।

দান-প্রতিদানের এই বিনিময় অসামান্য এক ইতিহাস স্থাপন করবে, আর বাঙালির জন্য শিক্ষাটা সেখানেই।শুধু টাকা নয়, মানবিক মূল্যবোধ যদি কিছু শিখতে চান তাহলে জাপানে আগমন অর্থবোধক হবে।জাপানি সমাজেও অন্ধকার আছে কিন্তু আলোর আধিক্যই বেশি।বহু আলোকিত জাপানি নাগরিক আছেন যাঁদের অবদানের মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোও তেমনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, প্রাচ্যবাদী এবং বাঙালিপ্রেমী ছিলেন।বাঙালি সেই ইতিহাস জানে না বললেই চলে।

আবারও বন্ধুবর কাজী ইনসানকে অভিবাদন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি, তাঁর এই মহৎ কাজের আলোকে আমরা আলোকিত হবো, আলোকিত হবে বাংলাদেশও।