লন্ডনে সৌধের জীবনানন্দ উৎসবে উচ্ছ্বাসিত দর্শক


১ মার্চ ‘সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক’-এর আয়োজনে ইস্ট লন্ডনে অনুষ্ঠিত জীবনানন্দ উৎসবকে ‘লন্ডন নগরীতে এক নতুন সাহিত্যপ্রবণতা’ হিসেবে দেখছেন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া দর্শক ও শিল্পীরা। পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এ উৎসবকে কবি জন ফার্নডন বলছেন ‘এ এক নতুন অভিজ্ঞতা; বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রের দর্শকদের উপস্থিতিতে বিস্ময়কর সব সাহিত্য পরিবেশনা দিয়ে নতুন সাহিত্য-তরঙ্গ নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রয়াস।’ আবার বিবিসি স্লাম চ্যাম্পিয়ন কবি ডেভিড লি মর্গান বলছেন, ‘এক সত্যিকার আন্তর্জাতিকতা-মনস্ক ধ্রুপদি সাহিত্য উৎসব এটি!’ লন্ডনের রিচমিক্স থিয়েটারে হলভর্তি দর্শক তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকীর্তি নিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার বিচিত্র সব পরিবেশনা। অনুষ্ঠান শেষে মোহাবিষ্ট দর্শকেরা তাঁদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয় শিল্পের শীর্ষতম সংস্থা ‘সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক’-এর উদ্যোগে আয়োজিত এ উৎসবে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন বিলাতের প্রথিতযশা বাঙালি ও অবাঙালি কবি, লেখক, তাত্ত্বিক এবং সংগীত, নৃত্য ও অভিনয়শিল্পীরা।

এতে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার এক অভিনব সংগীত-ভাষ্য উপস্থাপন করেন কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক জন ফার্নডন। জীবনানন্দের কবিতার বুলগেরিয়ান অনুবাদ ও আনুষঙ্গিক আলোচনায় অংশ নেন বুলগেরিয়ান কবি ও প্রত্নসংগীত গবেষক স্নেজহিনা গুলুবভা। নিজের পার্সিয়ান অনুবাদ পাঠ করবেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ-ইরানি কবি আলিরেজা আবিজ এবং আরবি অনুবাদ পাঠ করবেন তরুণ ব্রিটিশ-মিসরীয় কবি মোহাম্মদ মোহসেন।

আবৃত্তি ও নৃত্য দিয়ে জীবনানন্দের কবিতার হৃদয়স্পর্শী সব উপস্থাপনা মঞ্চায়ন করেন কাউন্সিলর জাসমীন চৌধুরী, তানজনা নূর-ই সিদ্দিক, ডা. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, পপি শাহনাজ, ঊর্মি মাজহার, মুনিরা পারভীন, সৈয়দ আনোয়ার রেজা, প্রপা রেজোয়ানা আনোয়ার, মনিদীপা শীল, শীতেষ্ণা বোস, শর্মিষ্ঠা পণ্ডিত, এষা চক্রবর্তী ভট্টাচার্য এবং বাংলাদেশ থেকে আসা মনিরুল ইসলাম মুকুল। ব্রিটেনের শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তীর সুরারোপিত জীবনানন্দের কবিতা দিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন লাবণী বড়ুয়া এবং নিজের সুর করা ‘শঙ্খমালা’ কবিতার ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশনা উপস্থাপন করেন সুহা প্রিয়দর্শিনী চক্রবর্তী। কবিতার সঙ্গে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক রাগসংগীত পরিবেশন করেন ভারত থেকে আসা ওস্তাদ রশিদ খানের শিষ্যা কোয়েল ভট্টাচার্য।

উৎসবের শেষের দিকে পরিবেশিত হয় টি এম আহমেদ কায়সার নির্দেশিত জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ ও ‘কুড়ি বছর পর’ কবিতার ওপর নির্মিত অভিনব পোয়েট্রি থিয়েটার। আর চিত্রশিল্পী সোনিয়া ইয়াসমীনের ‘চিত্রশিল্প ও জীবনানন্দের কবিতা’ শীর্ষক এক অভিনব দৃশ্যপাঠ যৌথভাবে উপস্থাপন করেন সাংবাদিক কাজী জাওয়াদ ও সোনিয়া ইয়াসমীন।

সৌধ পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার বলেন, ‘উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখনো দর্শক ও শিল্পীমহল থেকে অব্যাহত প্রশংসা পেয়ে আমরা খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। রবীন্দ্রনাথের পরে যে কবিকে বাংলা বা সর্বভারতীয় কবিতার যথার্থ উদাহরণ, একটা স্বাদ বা আস্বাদ হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে পারি, তিনি জীবনানন্দ দাশ। মাত্র কয়েক বছরে এটি লন্ডনের মূলধারার কবি, লেখক ও শিল্পরসিক দর্শকদের মধ্যে যে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করেছে, তা আশ্চর্যজনক!’

উৎসব শেষে অংশগ্রহণকারী কবি-শিল্পীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যক্ত করেন নিজেদের প্রতিক্রিয়া। ব্রিটিশ-ফরাসি দর্শক ফ্লোরা নিকলসন বলেন, ‘আমি আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছি, বর্ণনা করার সব ভাষা হারিয়ে ফেলছি। গত শতকের একজন কবি আজকের পাঠক ও লেখকদের জন্যও কতটা প্রেরণা বহন করতে পারেন, কতটা শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন, এই উৎসবে না এলে আমার জানা হতো না।’

মিসরীয় কবি মোহসেন মহাম্মেদ বলেন, ‘এই উৎসবে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছি। জীবনানন্দ দাশের “হায় চিল” কবিতাটি আরবিতে অনুবাদ করে এখানে পাঠ করেছি। অনুবাদ করতে গিয়েই এই মহান কবির প্রেমে পড়ে গিয়েছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দের নানা রকমের সাহিত্যকৃতি নিয়ে এত হৃদয়স্পর্শী সব মঞ্চায়ন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি; বিশেষ করে বুলগেরিয়ান, পার্সিয়ান, রোমানিয়ান, স্প্যানিশ ও পোলিশ ভাষায় অনূদিত কবিতার পরিবেশনা এবং উৎসবে শেষের দিকে মঞ্চস্থ দুটি কাব্য-একাঙ্কিকা। কবিতা নিয়ে এমন অপূর্ব থিয়েটারের ধারণা আমি আর কখনো দেখিনি।’

ইরানি কবি, অনুবাদক ও একাডেমিক আলিরেজা আবিজ বলেন, ‘উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অভিভূত ও সম্মানিত বোধ করছি। পার্সিয়ান ভাষায় আমি আরও অনেক বেশিভাবে জীবনানন্দ অনুবাদ করতে চাই। সারা বিশ্বের বাঙালি এই কবির অসামান্য সাহিত্যকর্ম নিয়ে জানা উচিত।’

লেখক ও লিটলম্যাগ সম্পাদক সোমন্ত মোহান্ত বলেন, ‘এত অবাঙালি দর্শকদের সামনে, আবার এই মাপের বাঙালি-অবাঙালি কবি ও শিল্পীদের নিয়ে শুধু জীবনানন্দের ওপর সাড়ে তিন ঘণ্টার এহেন বিশ্বমানের উদ্যোগ আমার মনে হয় না ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও এ মুহূর্তে কল্পনাও করা যাবে। কলকাতা এবং বাংলাদেশেও এই উদ্যোগের খবর পৌঁছে দেওয়া উচিত, সম্ভব হলে ওখানেও এই উৎসব ছড়িয়ে দিতে হবে।’

ব্রিটিশ-বুলগেরিয়ান কবি ও মেধাবী প্রত্নসংগীত গবেষক স্নেজহিনা গুলুবভা বলেন, ‘বুলগেরিয়ান ভাষায় জীবনানন্দের “বনলতা সেন” অনুবাদ করে যেমন আনন্দ পেয়েছি, প্রিয় বন্ধু কবি আহমেদ কায়সারের সঙ্গে মিলে এই কবিতা হলভর্তি শিল্পরসিক দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে দ্বিগুণ আনন্দ পেয়েছি। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকদের অনেকেই আমাদের পরিবেশনা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন, তা আমাকে আপ্লুত করেছে।’

ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী জেসিকা ফার্লি বলেন, ‘পুরো সন্ধ্যা আমি অভিভূত ছিলাম কবিতার সঙ্গে বিস্ময়কর গায়নের অর্থপূর্ণ এক মেলবন্ধন আবিষ্কার করে। আমার জন্য এ ধারণা নতুন নয়। তবে পরিবেশনার মাত্রা, প্রকরণ ও মঞ্চায়ন ছিল একেবারেই নতুন।’

সূত্র: প্রথম আলো