নগরে বাইক বেড়েছে। সম-সংখ্যক চালকও দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে এরা উদগ্রীব হয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে-‘কই যাবেন?’
ফুটওভার ব্রিজে ভাসমান মেয়েরা জ্বালাতন করে, গলির মোড়ে রিকশাচালকরা, ফুটপাতে হকারদের প্রচারণার অত্যাচার।বাছাবাছির অপ্রয়োজনীয় আহ্বান।একটু স্বস্তিতে নিরিবিলি হাঁটার সুযোগ কোথাও নেই।তবে সুবেশী বাইক চালকদের মার্জিত উচ্চারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য যাত্রীর হ্যাঁ বা না উত্তর মেলে না।এই বাইকারদের কাছেও যে ভাংতি চাওয়া যায়, দেখলাম আজ! পঞ্চাশোর্ধ দাঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে দিলেন একটি পাঁচশ’ টাকার নোট। ভাংতি নেই শুনে হাসিটি দপ করে নিভেও গেল আবার!
ভাংতি পেতেও কৌশল লাগে।মনে মনে তারিফ করলাম নিজের! এই তো কিছুক্ষণ আগে ঠিকই বাস কন্ডাক্টরের কাছ থেকে ভাংতি নিয়ে এসেছি। তার আগে অবশ্য তাকে বলতে হয়েছে, ‘মামা, আজ খুব ফ্রেশ লাগছে!’
আদতেই অন্যদিনের চেয়ে সজীব লাগছিল।শীতের সকালে এমন সজীবতা মনে করিয়ে দেয়, ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ গোসল দিয়েছিল। কন্ডাক্টর মামা এমন মন্তব্যে এমন হাসি দিল, যেটার দাম অন্তত পাঁচশ’ পাঁচ টাকা! ভাড়া মেটানোর পর আলগোছে জানতে চাইলাম, ‘পাঁচশ’ টাকার ভাংতি হবে?’
নীরবে গুনে দিল।আমিও নোটটা দেওয়ার পরে উল্টেপাল্টে দেখে রাখল সযত্মে। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে চলাচল করা এই বাসের সার্ভিস ভালো।চাইলেও এরা নিয়মের হেরফের করতে পারে না।বাস ছাড়ার আগে সুপারভাইজারের কাছ থেকে ভাংতি করে নেওয়া যায়।সকালে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।তাই ভাংতি করার বিষয়টা মনে থাকেনি। এক সহকর্মীর কাছ থেকে তিনশ’ টাকা ধার নিয়েছিলাম। আজ তাকে পাঁচশ’ টাকা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করতে চাইলে সে বাকি দুইশ’ টাকা কোত্থেকে ফেরত দেবে।নির্ঘাত বলবে, পরে নিও! পরে মানে লম্বা সময়ের ধাক্কাও হতে পারে।
মাসের মাঝামাঝি।খুব কায়দা করে টাকাটা ম্যানেজ করেছি।
এদিকে এই মুরব্বি বাইক চালকের কাছ থেকে ভাংতি পেলেন না।তিনি জানেন না, কার কাছে ভাংতি থাকে আর থাকলেও কীভাবে সেটা আদায় করতে হয়।
গন্তব্যের দিকে পা বাড়ানোর সময় খেয়াল করলাম, এক লোক এই ‘ভাঙাভাঙি’ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে।উপযাচক হয়ে তাকে বললাম, ‘পাঁচশ’ টাকার ভাংতি পেতে পঞ্চাশ টাকার ফ্লেক্সিলোড করতে হয়। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।মুরব্বি ভদ্রলোক বোধহয় এটা জানেন না!’
লোকটা মূল প্রসঙ্গের ধারে-কাছে না গিয়ে বোকার মতো বলে উঠল, ‘জানেন, ভাংতি করানোর মতো টাকার আমার কাছে কখনোই থাকে না।’
থমকালাম একটু।কী কথার কী জবাব।কথা খুঁজে নিয়ে বললাম, ‘ছোট নোট সঙ্গে থাকলে ভাংতি লাগে না।’
‘আমার কাছে সেটাও থাকে না।আমার মোবাইল ফোন নেই।বড় নোট থাকলেও কৌশলে ভাঙাতে পারতাম না।কোনো কৌশল আমার সঙ্গে থাকে না।তারা আমাকে এড়িয়ে চলে।’
সত্যিকার অর্থেই এবার থমকাতে হলো।শহরের এক পক্ষ ভাংতি নিয়ে বরাবরই পেরেশানিতে থাকে আর অন্য পক্ষের ভাংতি করানোর মতো টাকা থাকে না।একপক্ষ গাড়িতে চড়ে আরেকপক্ষ গাড়ি চালায়।
লোকটাকে সান্ত্বনা দিতে বলি, ‘চলুন, চা খাই।আমার কাছে একশ’ টাকার নোট আছে।দুজনে চা খেলে বিশ টাকা বিল হবে।ভাংতি নিশ্চয়ই মিলবে।আর আপনি যদি একটা সিগারেট টানেন, ত্রিশ টাকা ফেরত দিতে দোকানদার খুব একটা ঝামেলা করবে না।’
লোকটা যেন এমন প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই ছিল।সায় দিয়ে বলল, ‘চলুন।’
যৌথ হাঁটা বেশি এগোল না।একটু দূরেই ফুটপাতে হকার চিৎকার করছে- ‘চামড়ার মানিব্যাগ একশ’ টাকা… চামড়ার মানিব্যাগ একশ’ টাকা…।’
একটু দাঁড়িয়ে তাকালাম ছড়ানো-ছিটানো মানিব্যাগগুলোর দিকে। লোকটা আবার বলল, ‘আমি প্রায়ই চিন্তা করি, এখান থেকে একটা মানিব্যাগ কিনব।কিন্তু পকেটে কখনই একশ’ টাকা থাকে না।হকার লোকটার জন্য দুঃখও হয়।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কীভাবে যে এত চিল্লায়! মানুষ তো এখন মানিব্যাগ ব্যবহার ছেড়েই দিয়েছে।সব টাকা বাসায় বা ব্যাংকে রাখে!’।
‘আমার কাছে পাঁচশ’ একত্রিশ টাকা আছে।মানি ইজ নো প্রবলেম। আপনাকে এখান থেকে একটা মানিব্যাগ কিনে দিই?’
দীর্ঘশ্বাস প্রলম্বিত হয় লোকটির-‘মানিব্যাগ কেনার স্বপ্নই দেখি।কিন্তু ব্যাগে রাখার মতো টাকা পাব কোথায়! টাকা ছাড়াই টাকার ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-কেমন হয়ে যায় না বিষয়টা?’
থমকানোর পালা আবারও।একটা দীর্ঘশ্বাস গুম করে ঠেলে দিই কলিজা বরাবর।চাকরি হওয়ার আগে একটা মানিব্যাগ আমারও ছিল।প্যান্টের পকেটে বছরের পর বছর বহন করেছিলাম।তাতে একটা ফুটো আধুলিও রাখতে পারিনি কখনো।ধূলিমলিন স্মৃতি ছাইচাপা দিয়ে বলি, ‘চলুন তবে, চা খাই। শীতসকালের চা, খেতে ভালো লাগবে।’
নোংরা আস্তিন গোটাতে গোটাতে লোকটা বলে, ‘ওই দোকানে ভালো বিস্কুটও পাওয়া যায়।’
‘তাহলে তো আরও ভালো হলো।গরম চায়ে ঠান্ডা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া অনেক মজার।’
লোকটার ছেঁড়া স্যান্ডেল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিই।আমার জুতাটা সারিয়েছি গতকাল।দক্ষ মুচির নিখুঁত সেলাই।কোনো বাপের ব্যাটার সাধ্য নেই খুঁত বের করে।হাঁটতে হাঁটতে লোকটা কী যেন বলে।আমার কানে ভাসে গতকাল রাতে মোবাইল ফোনে শোনা মায়ের আর্তি-‘বাবা, এই মাসের টাকাটা এখনো পাঠাতে পারলি না? তোর বোনের পরীক্ষার ফি জমা দিতে হবে।সময় আর বেশি নেই।’
লোকটাও দূর দিগন্তে উঁকিঝুঁকি মেরে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। তাকে বলি, ‘কী দেখছেন?’
‘নিজের জীবনটাকে খুঁজছি, মশাই। কোথায় যে হারিয়ে গেল!’
‘দ্রুত চা খেয়ে চলুন, আপনাকে একটা মানিব্যাগ কিনে দিই।’
‘ম্যানিব্যাগ কেন?’
‘মানিব্যাগের ফুটো আধুলিতেও অনেক সময় জীবন লুকিয়ে থাকে। মানিব্যাগই জীবনই খোঁজার ভালো জায়গা।’
‘আপনার অদ্ভুত কথা শুনে গরম চা-টাও ঠান্ডা হয়ে গেল।আরেকটা চা দিতে বলুন।’
কথাগুলো লোকটাকে বললাম, নাকি নিজেকেই শোনালাম! একশ’ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কেনার পরে পকেটে কত টাকা থাকবে? সহকর্মীর পাওনা তিনশ’ টাকা, বোনের পরীক্ষার জন্য টাকা পাঠাতে হবে, মায়ের শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে আরও আগেই, মেস ভাড়া বাকি পড়েছে দুই মাসের…। না, কিছুতেই হিসাবজট খুলছে না। আবারও আমি সামনে দিগ-বলয় খোঁজার চেষ্টা করি। চোখের সামনে ধরা দিক না-সবুজ ঘাসের একটা বন!