বই পড়া নিয়ে মজার গপ্পো ॥ কাজী লাবণ্য


আলো কেবল ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে।আর বই! বই অতীত থেকে বর্তমান, ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূর, প্রান্ত থেকে অন্তে এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে আলো পৌঁছে দিতে পারে।তাই দেশকালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের আলোকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই।

বিনোদন থেকে শিক্ষা, অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী সবতেই বই উৎকৃষ্ট অবলম্বন।আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন ‘বইয়ের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই’।মহৎ ব্যক্তিবর্গের বই নিয়ে এমন হাজারো মূল্যবান উক্তি আছে।আমার আজকের প্রসঙ্গ তা নয়।আজকের বিষয় ‘বইপড়া নিয়ে মজার ঘটনা’।

আমি একজন আজন্ম পড়ুয়া মানুষ।সব সময় বলি আমি হচ্ছি ‘ঠোঙা পড়ুয়া’। সত্যি সত্যি বাড়িতে বাজার সদাই আসত যে কাগজের ঠোঙায় তা না ছিঁড়ে হাত দিয়ে সমান করে যত্নে তুলে রাখত আমাদের বাড়ির কাজের সহায়ক মেয়েটি।স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে আমি সেসব নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করতাম আর গিলতাম।

বাড়িতে পড়ার চমৎকার পরিবেশ এবং প্রচুর বই ছিল।আমার আব্বা, মেজো আব্বা, মা, বড়ভাই, মেজোভাই সবাই নিজ নিজ রুচি পছন্দে বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা পড়ত।আর ছোট্ট আমি তাঁদের সকলের বইগুলি, পত্রিকাগুলি উই পোকার মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়ে ফেলতাম।

বাড়িতে বই পড়ার উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ক্লাসের বই আগে পড়তে হবে এমন নির্দেশনা জারি ছিল।সত্যি বলতে, ক্লাসের বই তেমন টানত না।কিন্তু, উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনি, নাটক, সমস্ত বই আমাকে চুম্বকের মত টানত।এ যেন এক দুর্নিবার নেশা।

অষ্টম, নবম শ্রেণির আগেই দস্যু বনহুর, কুয়াশা সিরিজ, আশুতোষ, নিমাই, ফাল্গুনী, শরৎচন্দ্র, নীহাররঞ্জন, আরো অনেক বই শেষ করে, হাত বাড়িয়েছি সুনীল, সমরেশ, রিজিয়া রহমান, শীর্ষেন্দু, মুজতবা আলী, মীর মোশাররফ হোসেন, আশাপূর্না দেবী, মৈত্রী দেবী, গজেন্দ্রকুমার প্রমুখের প্রতি।সারারাত জেগে এক একটি বৃহৎ ভলিউমের বই শেষ করার বহু নজির আমার ফেলে আসা অতীতের গর্ভে লুকিয়ে আছে।

মেজো আব্বা সেবা প্রকাশনীর প্রতিটি বই নিয়মিত পড়তেন। মাসুদ রানা সিরিজ এবং অন্যান্য অনুবাদ বের হলেই কিনে আনতেন। সামনে আমার স্কুল ফাইনাল, বড়ভাই তখন আইসিএমএ আর মেজোভাই বুয়েটে পড়ে। দুজনেই ঢাকায় থাকে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এলে অংক দেখিয়ে দিতে বসে আর কিছু উপদেশ দিয়ে টিয়ে আবার ঢাকা চলে যায়।

মেজোভাই আমাকে ডেকে বলল, ‘বই পড়িস পড়, কিন্তু সেবা’র কোন বই পড়বি না’।এগুলো কলেজে উঠে তারপর পড়বি।মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাই।বাড়িতে বড়দের মান্য করার এক অদৃশ্য কড়া কানুন বহাল ছিল। আব্বারা পর্যন্ত নিজ নিজ বড়ভাইদের অসম্ভব সমীহ করতেন। তো মেজোভাই বলে গেল সেবার বই না পড়তে, আমিও বাদ দিলাম।অন্যসব বই পড়ি, সেবা বাদ বা স্থগিত।

স্কুল ফাইনাল শেষ।পড়ার জন্য হাতে বই নেই, থাকবে কি করে! বড়ভাই ততদিনে কাজী পাড়ার আর সব কাজিনদের নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে ‘আলোর দেয়ালী পাঠাগার’ নামে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছে।বাড়ির যত বই ঝেটিয়ে নিয়ে গেছে।আমার নিরবচ্ছিন্ন ছুটি চলছে, বইয়ের অভাবে অস্থির হয়ে আছি।নতুন বই হাতে না থাকলে পুরান বই আবার পড়তে আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না। কিন্তু নতুন পুরান কোন বই-ই তো নেই। আছে একগাদা পুরনো বিচিত্রা, রোববারসহ বিভিন্ন পত্রিকা।

বাধ্য হয়ে, সেসব পড়ি, একের ভেতর পাঁচ বইয়ের রচনা, আত্মকথাগুলি পুনরায় পড়ি কিন্তু মন ভরে না। বই চাই বই।এর মধ্যে মেজো আব্বা একদিন সেবা প্রকাশনীর বেশ কয়েকটা নুতন বই এনেছেন। তা দেখে, আনন্দে আমার বুকের ভেতরে ময়ুর পেখম মেলেছে।তক্কে তক্কে আছি আব্বার কখন পড়া শেষ হবে, পড়া শেষের আগে হাত দেওয়া যাবে না।

ছুটিতে বড় দুই ভাই বাড়ি এসেছে।বাড়িতে আনন্দ উৎসব চলছে।অবশ্য আমার মায়ের তদারকিতে বাড়িতে প্রায় সময়ই খাবারের উৎসব চলে। ভাবলাম এইতো কিছুদিন পরেই তো কলেজে উঠব।কাজেই…
কাজিন রেখা। আমার সবকিছুর সাথী। ওর সাথে পরামর্শ হলো কিভাবে বই দেওয়া নেওয়া হবে।পড়ার টেবিল জানালার পাশে, ওপাশে গোলাপজামের গাছ।রেখা বই নিয়ে পেছনে, গোলাপজাম গাছের তলায় গিয়ে জানালা গলিয়ে আমাকে দেয় আমি কোন একটা বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে মহানন্দে পড়ি।শেষ হলে আবার তেমনিভাবে ফেরত দেই। মেজো আব্বা বা মেজো ভাই কেউ কিছু বুঝতে পারে না।একদিন এমনিভাবে বই বিনিময় হচ্ছে একদম আকস্মিক আমার কানের পাশে কি একটা যেন ‘বুম’ করে উঠল।কানে তালা লেগে গেল, মাথা ঝিমঝিম করছে।

কাজীপাড়ার মসজিদ থেকে আমাদের ওস্তাদজীর সুরেলা আজান ভেসে আসছে। রাজহাঁসের ঝাঁক হেঁকেডেকে নিজ ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। গোলাপজামের গাছে থোক থোক অন্ধকার বাসা বাঁধছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি ওপাশে রেখা নেই, হাওয়া।এদিকে পেছনে তাকিয়ে দেখি রাগান্বিত মেজোভাই দাঁড়িয়ে আর জানালার শিকের ফাঁকে সেবার মাসুদরানা জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে।

একটা কথা আছে না! ‘ফুলের টোকা’! আমার আব্বা আমাকে সারা জীবনে একটা ধমক তো দূরের কথা একটা ফুলের টোকাও দেয়নি। হ্যাঁ, মায়ের হাতে মার খেয়েছি।আর সেদিন মেজোভাইয়ের হাতে কী একটা থাপ্পড় যে খেয়েছিলাম!

অথচ, এদিকে মারিও পূজোর ‘গডফাদার’ ১,২,৩,৪ যখন পড়ছি, তখন আব্বাও পড়ছেন। হয়ত আমাকে বলছেন তোর পড়া হলে অমুক ভলিউমটা দিয়ে যাস তো মা।এটি ইতালীয়-মার্কিন লেখক মারিও পুজোর লেখা একটি অপরাধ উপন্যাস বা ক্রাইম ফিকশন।

বই পড়া নিয়ে এমন মজার কত হিরন্ময় স্মৃতি যে আছে! পড়া নিয়ে একবার মায়ের হাতেও মার খেয়েছিলাম।

আমার যখন বিয়ে হয়ে গেল সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম দুটো ব্যাপারে। এক খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করা নেই আর দিনরাত বই পড়লেও বলার কেউ নেই। অবাধ স্বাধীনতা। কেউ বলে না-রাত অনেক হয়েছে ঘুমা।
অনেক বেলা হয়েছে গোসলে যা এখন পড়ার সময় পড়তে বস এখন খাবার সময় খেতে আয়…

বিয়ের পরে চিটাগাং এ থাকি। ২০/২২ বছরের ঘোর লাগা তরুণী। ডানে বামে সামনে পেছনে উপরে নিচে যেদিকে তাকাই বিস্মিত হই। মুগ্ধ হই। সেখানকার প্রকৃতি অপরূপ সুন্দর। কোলে আমার দু’বছরের তা তা থৈ থৈ সন্তান।সন্তানের বাবা সরকারি বাংলো পায়নি, ভাড়া বাসায় থাকি লালখান বাজারে।সবকিছু ঠিকঠাক চললেও মন ভালো থাকে না। বইয়ের ভাণ্ডার নেই।একটা দুটো বই দিয়ে আমার ক্ষুধা মেটে না।খুঁজতে খুঁজতে বাসার কাছেই একটি বুকস্টল পেয়ে গেলাম, আমাকে আর পায় কে! বই কিনে আনলাম।পড়লাম, শেষ হয়ে গেল। আরো চাই, আরো, কিন্তু এত দাম! ক’টা কিনব! স্টলে যাই বই নাড়াচাড়া করি অনেক, কিন্তু কেনার সময় মাত্র একটি কিনি তাও আবার শীর্ণকায়। আমার চাই অভিধানের মত ভলিউম। আর দোকানের প্রতিটি তাকে চকচকে মলাটের, মোটা মোটা কত যে বই! আমার মোহাবিষ্ট চোখ প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদে ঘোরে ফেরে।

দোকানের ছেলেটির সম্ভবত মায়া হয়।নির্মল মায়া। সমবয়সী ছেলেটি একদিন আমায় বলে,‘আপনি বুঝি খুব বই পড়েন? কিছু না বলে হাতের বইটির পাতা উল্টাই আর স্মিত হাসি’।‘শোনেন, আমিও খুব বই পড়তাম। পড়ার নেশা থেকে বহু কষ্টে নিজের স্বপ্নপূরণ করেছি, এই স্টল দাঁড় করিয়েছি।এখন পড়িও বিক্রিও করি।এটা আমার জন্য খুব আনন্দের, আপনি এক কাজ করেন আপনি একটি দুটি করে বই নিয়ে যান, কিন্তু অনুরোধ বইয়ে কোন দাগ বা ভাঁজ ফেলবেন না।পড়া শেষে দিয়ে যাবেন’।

কেউ কি আন্দাজ করতে পারবে, তখন আমার মনের অবস্থা!
আনন্দ, খুশি, এবং অজানা এক অনুভূতিতে ভেতরে ভেতরে কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর সেই স্টল থেকে অসীম সংখ্যক নানাবিধ বই বাসায় এনে আগে খবরের কাগজ দিয়ে মলাট করে, সাবধানে যত্ন সহকারে পড়ে ফেরত দিয়ে আসতাম।এভাবে বছরের পর বছর চলেছে। কী এক অপার্থিব আবেশে দিনরাত কেটে যেত! কোন রকম অমলিনতা, ঝুটঝামেলা আমাকে স্পর্শ করত না। যেন আকাশভরা নক্ষত্রেরা আমায় ঘিরে থাকত। আহা! কত কত বই…

তারপর বদলি হয়ে আমরা ঢাকায় চলে আসি।দুঃখের বিষয় উদার মনের সেই ছেলেটির সাথে কোন যোগাযোগ আর হয়নি।তাকে একটা মামুলি ধন্যবাদও দেইনি, জানি বড় মাপের মানুষেরা ধন্যবাদের তোয়াক্কা করে না।আজ মনে হয় যোগাযোগ রাখা উচিত ছিল।আর আজ এও মনে হয় ছেলেটি দারুণ সুদর্শন ছিল।

সে সময় কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তা মাথায় আসেনি। কারণ নেশাগ্রস্ত মানুষরা কোনদিকে তাকাবার অবস্থায় থাকে না।নেপোলিয়ানের মত আমিও মনে করি ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল’।সত্যি অচল।

সবাইকে আজকের দিবসের শুভেচ্ছা।