প্রতিনিয়ত কত গল্প দেখছি, শুনছি, পড়ছি সেসবের কিছুই তো মনে থাকছে না। গল্পের চরিত্রগুলো চোখের সামনে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে আচমকা অদৃশ্যও হয়ে যাচ্ছে। এ যেন হাতের আজলা ভরে পানি তুলছি, মুখটা ধুয়ে নিতে না নিতেই পানি গড়িয়ে হাত শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এর সংলগ্ন মুহূর্তেই আবার খেয়াল করছি, দুই হাতের পাতা ভেজা ভেজা লাগছে, ত্বকে অদ্ভুত এক বিষণ্নতার ছোঁয়া লেগে মিলিয়ে যাচ্ছে; এই যে ভেজা ভেজা অনুভব, স্যাঁতস্যাঁতে একটা বিষণ্নতা থেকে ফের প্রসন্ন হয়ে ওঠা-গল্পের কারসাজি হয়তো এটাই। যেই গল্প এমন কারসাজি জানে সেই গল্পকে সহজে ভোলা যায় না, গল্পের চরিত্রগুলোও হঠাৎ হঠাৎ মগজের কোনে কোনে পায়চারি করতে থাকে।
কিন্তু গল্প কী? এ কী নিজের জীবনকে লেখা না অন্যের? গল্পে গল্পে এই যে এত লিখে যাওয়া এর কী আসলে কোনো শেষ আছে? এত যে লেখা হচ্ছে, এতজন যে লিখছেন, গল্প কেন ফুরাচ্ছে না? নিত্য গল্পের মাধুরীর সঙ্গে যত মিশে যাচ্ছি মনে-মগজে তত যুক্ত হচ্ছে সহস্র ভাবনা। ভাবনাগুলো খামখেয়ালি মনে হলেও পাঠের জন্য গল্প নির্বাচনে পারতপক্ষে খামখেয়ালি করতে চাই না। সেই কারণেই হয়তো পাঠক আমি গল্পের নির্মাণ শৈলী, গল্পের যাত্রাপথ আর গল্পের চরিত্র নিয়ে ভাবি।
গল্পের শৈলী কেমন হবে তা নিয়ে আলাপচারিতার অন্ত নেই। আবার লেখক ভেদে এই শৈলীর বৈচিত্র্যেরও শেষ নেই। বলা যায় ছোটগল্প কখনও নির্দিষ্ট বৃত্তের ভেতরে আটকে থাকেনি, এমন কী কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রমুখী হয়ে আবর্তনও করেনি। সময়ের ঘুর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে গল্পের বিষয়বস্তু পাল্টেছে, পাল্টেছে গল্পের শৈলী। গল্পকারেরা নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাঠককে চমকেও দিতে চেয়েছেন। পাঠকও যৌক্তিক-অযৌক্তিক প্রশ্নের জটলায় নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে পাঠতৃপ্তি হাতড়ে বেরিয়েছেন। নিরীক্ষাধর্মী অথবা চিরায়ত-যেই আঙ্গিকেই গল্প বলা হোক না কেন যে গল্প পাঠককে ভাবায় না বা অপ্রস্তুত করে না তা যেন ঠিকঠাক গল্প নয়। গল্প যখন পাঠককে এমন এক ইন্দ্রিয়াতীত অনুভবের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় যে তার টেবিলে রাখা চা জুড়িয়ে যায় তখনই গল্পটি অসামান্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে গল্পপাঠ শেষ হলেও এমন গল্প ফুরোয় না। আর এত শত সহস্র গল্প লেখার পরও গল্পের ঝুড়ি শূন্যও হয় না।
শূন্য হবে কী করে! দশ জন গল্পকার যেমন একটি প্লটে দশটি ভিন্ন স্বাদের গল্প লিখতে পারেন তেমনি একজন গল্পকার একটি প্লট নিয়ে দশটি গল্প লিখতে পারেন। কেউ আবার হয়তো গল্পের প্লট, থিম, ক্লাইমেক্স এইসব নিয়ে একদম ভাবেন না। নিজের মতো করে নিজের অভিজ্ঞতা নিঙড়ে লিখে যান। আসলে গল্প তো হরেক রকমের। গল্পের সংজ্ঞাগত বিশ্লেষণে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি শুধু গল্পের ভেতরে সেই ছোট্টবেলার মতো দাদী-নানীর পাশে শুয়ে বসে গল্প শোনার সুখের মতো সুখ খুঁজি। সেই সাথে চাই গল্পের সঙ্গে নিজের জার্নিটা ম্যাড়মেড়ে না হোক, চমকপ্রদ হোক। আর চাই গল্পের শুরুটা আমাকে একেবারে আটকে ফেলবে, বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে মাথা তুলতে দেবে না।
কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান যখন ‘আমার জন্ম’ গল্পের প্রথম বাক্যে লিখছেন, ‘আমার চতুর্থ বোনটির জন্মের পর আমার বাবা ওই টুকুন নবজাত শিশুকে পাঁজাকোলা করে অন্ধকার উঠানে ছুঁড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন’ কিংবা রোমানিয়ার কথাকার আনা ব্লানডিয়ানা যখন ‘খোলা জানালা’ গল্পের সূচনা অংশে জানাচ্ছেন জেলখানার অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকে গল্পের নায়ক একটা উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখবে বলে দেওয়ালে একটি খোলা জানালা এঁকে ফেলে তখনই সুচারু একটা টোপ গিলে ফেলছি। এরপর বড়শিতে আটকানো মাছের মতো শব্দে শব্দে ঘাই মারছি আরও সামনে যাবো বলে। এই গল্প শেষ না হলে যেন মুক্তি নেই। তাই গল্পের কাছে এর প্রারম্ভেই চাইছি টোপ।
এরপর গল্পের শব্দে শব্দে, বাক্যের পরতে পরতে চাইছি গল্পের বুদবুদ। যা উঠছে, নামছে…মিলিয়ে যাচ্ছে আবার। ধরতে পারছি না, দেখতে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করছি এমনটা হয়, হতে পারে, আবার থেকে থেকে অবিশ্বাসের ঘূর্ণি উঠছে; মুখ খুলে যাচ্ছে বন্ধ কৌটার, বেরিয়ে আসছে আশ্চর্য সব আখ্যান। পড়ছি আর ভাবছি, কেন এমন হচ্ছে? গল্পের মুখ্য চরিত্র বা পার্শ্বচরিত্রটি কেন এমন করছে? কেন এমন নির্মম হচ্ছেন গল্পকার?
মাঝেমাঝে গল্প কোনো কিছু ভাবার সুযোগও দিচ্ছে না, নিটোল চৌকাঠে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভাবনার সুতো, গুটি পাকিয়ে যতই সামনে এগোচ্ছি খুলে যাচ্ছে বিস্ময়ের দুয়ার। তবে গল্পের কাছে বিস্ময় চাই ঠিকই কিন্তু গল্প পড়ে মুহুর্মুহু চমকে যেতে চাই না। ঘটনার ঘনঘটা চাই না। চাই না কৃত্রিম বিন্যস্ত পরিসর। চাই ঘটনার অদেখা অভিঘাত, আখ্যানের মোচড়। চাই অভিনব কিছু, যা আগে ঘটতে দেখিনি, তাই দেখতে চাই।
গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘মেয়ে’ গল্পের মতো অভিনব আখ্যান চাই গল্পে। যে গল্প পড়তে বসে শেষ না করে আর ওঠার উপায় থাকবে না। গল্প পড়তে পড়তে মনের ভেতরে তৈরি হওয়া কৌতূহলের নির্বাণ চাই গল্পের ভেতরেই। যেমন করে ‘মেয়ে’ গল্পে অন্তঃসত্ত্বা লিপির জন্য বরাদ্দকৃত বাড়ির সব ভারি ভারি কাজ কে করে দিচ্ছে তা জানতে উদগ্রীব হয়েছি; লিপির সংসার সাফসুতরো করে উঠান ঝাঁট দেওয়া, রান্না-বান্না করা, কলসিতে করে পানি তোলা ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজকর্ম চোখের নিমিষে হয়ে যাওয়ার অভিনবত্বে চমকে গেছি তেমন অভিনব কিছু চাই গল্পের কাছে। লিপির মতো অবাক দৃষ্টিতে দেখতে চাই, পরির মতো সুন্দর, চাঁপাকলির মতো আঙুল আর হরিণচোখের একটি মেয়ে কী করে পেটের ওপর থেকে বেরিয়ে আসছে, একে একে ঘটছে অভিনব সব ঘটনা, চেনা আখ্যানটিও ক্রমশ অচেনা হয়ে উঠছে। গল্পের কাছে চাই জীবনের চেনা বৃত্তের এমনই অচেনা পরিধি।
চমক আনার জন্য গল্পের ভেতরে অণুগল্পও ফাঁদেন গল্পকার। একটা ছোটগল্পে একাধিক অণুগল্প থাকলে একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র রাখেন। আবার কোনো কোনো গল্পের সমাপ্তিতে চমকের বদলে হিরন্ময় নীরবতা নামে যা পাঠকের ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে অন্যতম প্রিয় গল্পকার আফসার আমেদের ছোটগল্প ‘হাসিনার পুরুষ’র কথা বলি। এই গল্পের শেষে কিন্তু চমক নেই, চমকহীনতাই এই গল্পের সমাপ্তির অলংকার। কাক্ষ্মিত পুরুষের সংস্পর্শে না যেতে পেরে হাসিনা যখন নিজের ঘরে ফেরে তখন হাসিনার আঁটি চুষে চুষে খাওয়ার যেই দৃশ্য গল্পকার তৈরি করেন সেটাই পুরো গল্পের আকর্ষণ হয়ে ওঠে। হাসিনা আম খায়, আঁটি চোষে, স্বাদে-রসে পরিতৃপ্ত হয় আর পাঠক উন্মুখ হয়ে খুঁজতে থাকে ওর দেহের অভ্যন্তরের বঞ্চনা। ‘হাসিনার পুরুষ’ গল্পের সহজীয়া ভাষাও তখন পাঠকের মনে বিভ্রম তৈরি করে।
আমার কাছে মনে হয় একটা গল্প তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন সেটা পাঠকের মনে ভ্রম-বিভ্রম তৈরি করে। কিন্তু এই ভ্রম-বিভ্রম বা ধাঁধা তৈরি করতে গিয়ে গল্পের ভাষা দুর্বোধ্য হলে হয় না। আমি গল্পের ভাষায় চাই স্বচ্ছতা, বাক্যে চাই মসৃণতা আর শব্দ ব্যবহারে খুঁজি গল্পকারের পরিমিতিবোধ। এখানে ফুলের মতো পেলব, কোমল ভাষার ব্যবহারই যে গল্পের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। ফুলের কোমলতায় সত্যি বলার, সত্যিকে খোঁজার স্বস্তি তো নেই। কারণ ‘ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই/ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই/তার চেয়ে আমার পছন্দ/আগুনের ফুলকি/যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।’ আসলে সুভাষ মুখোপধ্যায়ের মতো আমিও ভালোবাসি আগুনের রমণীয় ফুলকি। এই ফুলকি যেই কলমে ওঠে, যেই গল্পে ফোটে সেই গল্পই আমার কাছে প্রিয় পাঠ হয়ে ওঠে। ক্রিম, চিজ, ফাইন সুগার, ড্রাই ফ্রুটস এসব বাহারি উপাদান দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে উপাদেয় খাবারের মতো যেই গল্প পরিবেশন করা হয় সেই গল্পে এই আগুনটা ঠিক থাকে না। আর আগুন থাকে না বলেই সত্যিটা থাকে না। কিন্তু গল্পে আমার সত্যিটা চাই; নিষ্ঠুর, নির্মম সত্যি চাই।
আর তাই গল্পের বুননে চাই লেখকের গুঁজে দেওয়া অস্বস্তি।
একটা গল্পের যাত্রাপথ বা বর্ণনা শৈলী মসৃণ হলেও গল্পটা কিন্তু পাঠকের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। এমন গল্প পাঠককে গোলকধাঁধায় আটকেও ফেলতে পারে। ইহকালে ঐ ধাঁধা থেকে পরিত্রাণের পথ পাঠক পায় না। আর সেই গল্পকে ভুলতেও পারে না। তাই হয়তো মান্টোর ‘খুল দো’ গল্পটা একবার পাঠের পরেও অগুনতিবার মনে পড়তে থাকে। এই যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
‘খুল দো’ গল্পে ডাক্তার স্ট্রেচারে শোয়া গণধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে করতে যখন জানালা দেখিয়ে বুড়ো সিরাজুদ্দিনকে বলেন, খুলে দাও…খুল দো ঠিক তখনই স্ট্রেচারে শোয়া অর্ধমৃত মেয়েটি যন্ত্রণাকাতরতার মধ্যেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সালোয়ারের ফিতে খুলে সালোয়ার নামিয়ে দেয় আর সিরাজুদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন, বেঁচে আছে…আমার মেয়ে বেঁচে আছে!-এমন তীব্র বেদনা গুটি কয়েক চরিত্রের সমন্বয়ে অল্প শব্দে বর্ণনা করে ফেলেন যিনি তিনি খ্যাতিমান উর্দু গল্পকার সাদত হাসান মান্টো। মান্টোর গল্পের তীব্রতা এমনই যে পাঠকের ভাবনার জগতকে একেবারে ছিড়েখুঁড়ে ফেলে। ভাবি কী করে ভাবতেন মান্টো, কী করে লিখতেন এমন? সময় আর সাহসই কি মান্টোকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে? আবার ভাবি দেশভাগের নির্মমতার মুখোমুখি তো অনেক লেখকই হয়েছেন, মান্টোর মতো আখ্যান নির্মাণে সংবেদনশীল হতে পেরেছেন ঠিক কত জন? কতজনই বা গল্পচ্ছলে সত্যিটা বলে পাঠকের মনে এমন তোলপাড় তুলতে পেরেছেন?
অভিজ্ঞতার ঝোলা ভারি হলেই হয়তো এমন তীর তীক্ষ্ম গল্প লেখা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই সংবেদনশীলতা। তাই গল্পের শিল্পীকে হতে হয় সংবেদনশীল। এমন একজন গল্পকারই শুধু পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখতে জানেন, জানেন কী করে পাঠককে টেনে গল্পের সমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়া যায়।
এখন গল্পের সমাপ্তি যেমন চাই-যা চাই তা যখন পাই না তখনই গল্পটি বিশেষ একটি গল্প হয়ে উঠছে। যে উদগ্র ইচ্ছে নিয়ে মনে মনে শেষটার ছক কষে রেখেছি সেখান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে যখন ভিন্ন একটি দিকে গল্পকার গল্পের প্রবাহ ঘুরিয়ে দিচ্ছেন তখনই পুনরায় পড়বো বলে গল্পটির শুরুতে চলে যাচ্ছি। হোক সেই দিন বা অন্যদিন, গল্পটি পড়তে হচ্ছে দ্বিতীয়বার। এদিকে এমনও হয়-ক্ষোভ জন্মে, অসহিষ্ণু হয়ে উঠি গল্পকারের বাল্যখিল্যতা বা নির্মমতায়, এমনটি হলো কেন? না হলেও তো পারতো। খুব কি অনিবার্য ছিল এমন সমাপ্তি?
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পের সমাপ্তিতে যখন জানতে পারছি, ‘কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকা- রয়েল বেঙ্গলটা মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর-লোককে ডেকে দেখানোর মতো’ তখন হরেক ভাবনা চেপে বসছে মনে। এই যে ভাবছি…ভাবছি…গল্পটি শেষ হয়েও ‘মনোরম চটিজোড়া’ দগদগে ঘায়ের মতো জেগে থাকছে মনে সেই গল্পই চাইছি গল্পের কাছে। গল্পের কাছে চাইছি আঘাত, আঘাতের ঘায়ে ভেঙেচুরে যেতে চাইছি, সময়মতো আঘাত থেকে প্রত্যাবর্তনও করতে চাইছি।
মনে পড়ে দাদীর মুখে গল্প শুনতাম ছোটবেলায়। থুথ্থুড়ি দাঁতহীন বুড়ি ঘুরেফিরে একই গল্প বলতো। সওদাগর বিবিকে রেখে বানিজ্যে গেছে, ময়ূরপঙ্খি নাওয়ে চড়ে। মস্ত সে নাও। ময়ূরের মতো অগ্রভাগ তার। ঝড়ঝঞ্জা-উন্মত্ত ঢেউ কেটে কেটে নাও চলছে দেশ ছেড়ে ভিনদেশে। তীরে নাও ভিড়িয়ে সওদা করছে সওদাগর। আর তার বিবির জীবনে হচ্ছে দুঃখের সওদা। তার গর্ভে সওদাগরের সন্তানের বদলে সাপ বড় হচ্ছে। ঢাউস হচ্ছে পেট, দুষ্ট দাসী পানির সঙ্গে সাপের বাচ্চা খাইয়ে দিয়েছে বিবিকে। বানিজ্য সেরে সওদাগর বাড়িতে ফিরে চরিত্রহীন অপবাদে বিবিকে গৃহছাড়া করছে। আহা, বনবাসী বিবির শিথানে বিনবিন করছে দুঃখ। দুঃখে রাজ্যের পশুপাখি কাঁদছে, গুমরে মরছে দিনের আলো, রাতের অন্ধকার। দুঃখ-বেদনায় আমিও মুষড়ে যাচ্ছি…। তারপর কী হলো? সওদাগর কবে বিবিকে ঘরে তুললো? দুষ্ট দাসীর কী শাস্তি হলো? এই তো গল্প…কী হলো কী হলো ঔৎসুক্যে মিশে থাকছে হাহাকার, তবু গল্পের সমাপ্তিতে যেতে চাইছি। আবার গল্পের কাছে এমন এক মর্মভেদী সমাপ্তি চাইছি যেন চোখ বুঁজে ফেলার পরেও আত্মার ভেতরে নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি বেজে চলে।
গল্পের সৃষ্টিকর্তার কাছে, তার গল্পের কাছে গল্পই চাই; নীতিকথা চাই না, হিসাব পাল্টাতে চাই না জীবনের। গল্পের কাছে চাই গালগপ্পো, যা কখনও কখনও সওদাগরের বিবির পেটে বড় হতে থাকা সাপের মতো গাঁজাখুরি মনে হবে, কখনও কখনও যা কঠিন, নিষ্ঠুর আর অবিচল সত্য হয়ে থাকবে।
গল্প নিয়ে চাওয়া-পাওয়ার এমন সব দোলাচলে ভাসতে ভাসতেই ‘লিলিয়ানা ও একটি ঘরবউনি সাপ’ গ্রন্থের গল্পসমূহ নির্মিত হয়েছে। এই নির্মাণের ধারায় বৈচিত্র্য রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা থাকলেও গল্পগুলো কোনো না কোনোভাবে এক সুতায় বাঁধা পড়েছে। কারণ, এই সংকলনের প্রতিটি গল্পের আখ্যান কোনো না কোনো নারী চরিত্র ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। পাঠককে স্বস্তি দিতে তবু জানানোর প্রয়োজন মনে করছি যে, ‘লিলিয়ানা ও একটি ঘরবউনি সাপ’ গ্রন্থের গল্পগুলো কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও।