এখন:
এই বয়সে এসে প্রেমে পড়া বিষয়টি ভীষণই ভয়াবহ। প্রথম আমি যখন মানুষটাকে দেখি, ওর পরনে কালচে মেরুন একটা শার্ট পরা ছিল। মজার ব্যাপার হলো আমি তাকে সামনে দেখি দুর্বল হইনি। আমি ছিলাম তার পিছনে। দমকা বাতাসে সে পাখির মতো উড়ে হেঁটে চলেছিল। বাতাসে পিছনের শার্ট আর কলার ফেঁপে উঠছিল। আশেপাশের মানুষ ছাপিয়ে সে চলে যাচ্ছিলো। খুব হালকা গড়নের মানুষটার প্রেমে আমি প্রথমে পড়িনি। বোধহয় তার উড়ন্ত হাটার প্রেমে পড়েছিলাম।
যখন সে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে স্থির হয়ে দাঁড়ালো তখন তার চেহারা দেখতে পেলাম। আমি তার বামদিকে ছিলাম। বেশ উজ্জ্বল বর্ণের একটা মানুষ, তার চেহারার সব থেকে বিশেষ আকর্ষণ বোধহয় তার নাকটা। মনে হলো কেউ আলগা একটা সরু চোখা নাক খুব যত্নে এঁকে তার মুখে লাগিয়ে দিয়েছে।
আমি আস্তে আস্তে তার ডান পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালাম। অদ্ভুদ একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। তার বাম পাশে হালকা দাঁড়ি আর ডানপাশে বেশ ঘন। যার জন্য দুইপাশ থেকে তাকে দুই রকমের অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে। কিন্তু একই মুখে দুই রকমের দাঁড়ি কি আজকালের ফ্যাশন কিনা বুঝলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর প্ল্যাটফের্মর বাঁধানো আসনে সে বসল। পাশে ক্র্যাচটা রেখে। অহ বলাই তো হয় নি তার একটা পা পুরোপুরি নেই। কালো প্যান্টের খালি অংশটা যতটা সম্ভব গুটানো। মানুষ এক পা দিয়ে কিভাবে এত দ্রুত হাঁটতে পারে সম্ভবত এটাই আমাকে বেশি বিস্মিত করেছিল।
এবার আমি সামনে থেকে মানুষটাকে দেখলাম। সে কাউকেই খেয়াল করছে না। ভীষণ শক্ত একটা মুখ। সে সম্ভবত ট্রেনের জন্যও অপেক্ষা করছেনা। সে বেশ শক্ত মুখে একটা করে সিগারেট ধরাচ্ছে। মুখে রেখেই ধোঁয়া ছাড়ছে। এভাবে কয়েক টান দিয়েই সামান্য পোড়া সিগারেটের অংশ থু করে তার একটা পায়ের নিচে ফেলে পিষে দিয়ে আবার আরেকটা ধরাচ্ছে। নাহ কেউ এলো না। সে বেশ ছটফট করে উঠে দাঁড়ালো। আমিও তার পিছু নিলাম।
এখন ও অতীত:
আজকাল কি হয়েছে, আমি কোনভাবেই নিজের কোন বিষয় তেমন একটা মনে করতে পারি না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলতে পারি। যেমন: ফিনিক্সের মনের কথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। মানে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। আমরা যেমন আমাদের খুব কাছের মানুষের চাহনি, কথা, হাসি কান্না বা আচরণে অনেক কিছু বুঝে যাই। অনেকটাই তেমন কিন্তু সেখানে যেমন কিছুটা দ্বিধা কাজ করে। ঠিক বেঠিকের হিসেব মিলাতে বসি। ফিনিক্সের ব্যাপারে বা আরও কিছু মানুষের ব্যাপারে ব্যাপারটা তেমন না। আমি পুরোপুরিই সত্যিটাই বুঝি।
অহ আবার ভুলেছি! ফিনিক্সের পরিচয় দেইনি। ও সেই মানুষটা যাকে আমি ষ্টেশনে দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। এই কদিনে আমি তার নামটা জানতে পারিনি। তাকে অবশ্য কেউ কিছু নামে ডাকেও না। তাই আমিই তার নাম ফিনিক্স দিয়েছি। যে পাখি আগুনে পুড়ে আবার জীবিত হয়ে যায়।
ফিনিক্স নির্দিষ্ট কোথাও থাকে না। একদিন সে শহরের নিম্নমানের কোন হোটেলে থাকে, আবার কোনদিন তাকে আমি শহরের ফুটপাতেও রাত বা দিন কাটাতে দেখি। একেক সময় একেক মানুষ তার সামনে সাদা কাগজ ফেলে চলে যায়। সে কাগজটা উঠিয়ে পড়ে। তারপর সেই কাগজের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। সেখানে তার পরবর্তী থাকার স্থানটাও উল্লেখ থাকে। সে সেইভাবেই সেখানে থাকতে চলে যায়। ফিনিক্স সম্ভবত তাকে যাতে চেনা না যায় তাই তার চেহারার বিভিন্ন দিক বিভিন্ন রকমের করে রাখে। ইচ্ছা করলে ধুলোর বাহানা দিয়ে মুখে রুমাল আঁটতে পারে। কিন্তু সেটা করে কোনই লাভ নেই এটা সে জানে।
হঠাৎ একদিন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা হাসপাতালে। কেন আমি এখানে এসেছি তাও জানি না। সময়ের হিসেব আমার কাছে বহুদিন হলো বেশ গোলমেলে। একটা পঁচিশ ছাব্বিশ বছয় বয়সী নারীর সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তার প্রচণ্ড ব্যাথা সারা শরীরে। বাজেভাবে একটা প্রাইভেট গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছে। নারীটির স্বামী বেশ ছুটাছুটি করছে। তাদের গাড়ির ড্রাইভার মারা গিয়েছে সেই দুর্ঘটনায়। ভদ্রমহিলার জ্ঞান নেই, তাকে নিয়ে সবাই হুলস্থুল করছিল ঠিক। কিন্তু তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেবার পর তার স্বামী চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন। তাদের আড়াই বছরের একটা বাচ্চা ছিল ঐ গাড়িতে। তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ এলো অনেক কথা কাজ হলো কিন্তু বাচ্চাটিকে পাওয়া গেলো না। সে কি মৃত নাকি জীবিত ছিল তাও সেই দম্পতি জানতে পারেনি।
এরপর ত্রিশ বছর কেটে গিয়েছে। সেই হারানো সন্তানকে আর তারা পায় নি। কিন্তু ওই নারীটা বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর তাদের আর কোন সন্তান হয়নি। ভদ্রমহিলা খানিক মনমরাও থাকতেন। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন একটা বাচ্চা পালক নিবেন। একটা মহিলা নিজে থেকেই বলেছিল সে তার বাচ্চাটা পালক দিতে চায়। মানে তখনও সে গর্ভবতী। একজন চেনাজানা মহিলা এই বিষয়টি জানতো। সে ওই দম্পতিকে বিষয়টি জানায়।
ওই গর্ভবতী মহিলা বলেছিল বাচ্চাটি হলে তারপর ওর নাম পরিচয় সব জানিয়ে দিবে এই দম্পতিকে। কিন্তু ভাগ্যের কি লীলা! ওই মা বাচ্চাটি হবার সময় মারা যায়। এরপর পরিচয়হীনভাবেই বাচ্চাটিকে পালক নিয়ে নেয় সেই দম্পতি। আমি না ঠিক কারও নাম মনে রাখতে পারছি না। শুধু বিভিন্ন মানুষ আর তাদের ঘটনাগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। ঠিক সেইভাবেই বলে যাচ্ছি..।
এখন:
ফিনিক্স আজ বেশ মধ্যম মানের একটা হোটেলে আরাম করে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। আমি ওর মাথার কাছাকাছি একটা সোফায় বসা। ওর মাথার নীচে বালিশ নেই। ওর আর একটা দারুণ বিষয় আছে। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে। দরজার পাশেই তার ক্র্যাচ রেখে এক পায়ে লাফিয়ে লাগিয়ে চলে। খুব আজব লাগে। ওর এক পায়ের ভাসমাস্য ক্ষমতা অসাধারণ। অনেক রাতে সে হালকা একটু ঘুমায়। বারে বারে একটা ছোট মানুষের ছবি বের করে দেখে। এটা কে? সে নিজে নাকি তার আপন কেউ? তার চেহারার সাথে বেশ মিল আছে।
অহ আমার এখন মনে পড়ছে। ওই যে দম্পতি, সেই সন্তানহারা মা। সেও ঠিক এইভাবে তার ছোট বাচ্চাটার অনেকগুলো ছবি বিছানায় ছড়িয়ে নিয়ে বসে থাকেন। তাকান না শুধু বাছানাময় ছড়িয়ে নিয়ে রাখেন। তাদের পালক ছেলেটিও এখন অনেক বড় হয়েছে। এমনিতেই তাদের বিশাল অবস্থা। তার উপর তাদের সেই পালক ছেলেও এখন ভাল ব্যবসাপাতি করে। মহিলার স্বামীও বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। হঠাৎ একদিন অফিসে সে স্ট্রোক করে মারা যান। চিকিৎসক এমনটাই বলেছিল। এরপর থেকে মহিলাটিও খুব চুপচাপ হয়ে যায়।
শুধু অতীত:
ফিনিক্সের বয়স তখন আড়াই। একটা ভয়াবহ অপরাধী একটা পুকুর পাড়ে তাকে পায়। অদূরে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছিল। কিন্তু সে বাচ্চাটিকে অক্ষত অবস্থায় পায় এবং তাদের একটা আস্তানা ছিল সেখানে বাচ্চাটিকে নিয়ে যায়। এটা মূলত বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের নিয়েই গড়ে উঠা একটা গোপন আস্তানা। এখানে নিখোঁজ বাচ্চাগুলোকে এনে রাখা হয়। এরপর এদের বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়। ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, হত্যাকাণ্ড, পাচার করা, বিভিন্ন অংগ প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া ইত্যাদি বহুবিধ কার্যক্রম এইসব বাচ্চাদের নিয়ে চলে।
আমি দেখতে পেলাম আড়াই বছরের বাচ্চাটি যে চুরি করলো, সেই লোকটিই ছিল সেই পালক ছেলেটির বাবা। সে তার স্ত্রী ও গর্ভের সন্তানকে ফেলে পালিয়ে আসে। সে কোথাও থিতু হবার লোক ছিলোই না আসলে। কি মনে করে হুট করে পালিয়ে থাকা অবস্থায় এই মেয়েকে বিয়ে করে। এরপর এক মাসের মাঝেই সে মেয়েটিকে ছেড়ে আসে। সে অবশ্যও জানতও না যে তার স্ত্রী গর্ভধারণ করেছিল। সম্ভবত জানলেও সে থাকতো না।
আস্তানায় ফিনিক্স বড় হতে হতে একটা সময় সে এখানে নিয়ে আসার পুরো ঘটনাই জানতে পারে। তার একটা পা আস্তানায় গোপনে অপারেশন করে কেটেও ফেলা হয়। কারণ তাকে দিয়ে বিভিন্ন জায়গাতে ভিক্ষা করানো হবে। এরপর হয়তো তার আরও হাত পা কাটা যেত। কিন্তু বারো বছর বয়সে প্রথম যে কাজটা করে সে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। সেটা হলো এই আস্তানায় যে লোকটা তাকে এনেছিল, তাকে সে খুন করে এবং আস্তানা থেকে পালিয়ে আসে।
এরপর সে একজন ঘাঘু মহাজনের সাক্ষাৎ পায়। সেখানেই সে প্রশিক্ষণ পায় কিভাবে অতি সুক্ষ্মভাবে মানুষ খুন করতে হবে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন সে পেশাদার খুনি। সে থাকে সব আইনের আড়ালে, হত্যার হুকুমকারিদের মধ্যমণি হয়ে এবং তাদের শিকারদের আজরাইলের হাতে তুলে দেবার দায়িত্বে।
আবার এখন:
ফিনিক্স আজ সাদা রঙের শার্ট পরেছে। আজ দুপুরে সে একটা চিরকুট পেয়েছে। আমি অবশ্য চিনি সেই ব্যক্তিকে। যে এই চিরকুট ফিনিক্সকে পাঠিয়েছে। সেই মহিলা, যার বাচ্চাটা আর পাওয়া যায় নি। সে তার পালক ছেলেটিকে খুনের জন্য ফিনিক্সকে চিরকুট পাঠিয়েছে।
কি অবাক লাগছে! ঘটনা জটঘট পাকিয়ে যাচ্ছে? না না তেমন জটিল কিছু নয়। ওই মহিলা জানতে পেরেছে তার পালক ছেলেটি আসলে একটা অমানুষ। সম্পত্তির লোভে সে তার স্বামীকে অফিসে কফিতে বিষাক্ত দ্রব্য মিলিয়ে দিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু আইন কানুন সব হাতে নিয়ে সে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছে। কিন্তু মহিলা সব বিষয় বুঝে গিয়েছে। এমনকি এটাও বুঝেছে, তার পালক ছেলে আর তার প্রেমিকা মিলে এখন তাকে খুন করার পরিকল্পনা করছে।
আচ্ছা আমি কে? আমার কিছুই তো মনে পড়ছে না। কেমন অশান্তি লাগছে! আচ্ছা আজ আমি ফিনিক্সের সাথেই যাবো। দেখি ও কিভাবে খুনটা করে।
প্রতিদিন বেশ রাত করেই পালক সেই মানুষটা বাড়ি ফিরে। নিজেই গাড়ি চালিয়ে নেয়। বেশ কদিন হলো সে কিছুটা বিষণ্ণ। একটা নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ আছে। সেখানে সে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সিগারেট খায়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজও দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে দেখে অযথাই আমার কেমন জানি মায়া মায়া লাগছে। আমি তো তাকে চিনিও না। তাহলে মায়া কেন লাগবে? আর আমি তো জানি সে কতটা নিষ্ঠুর একটা মুখোশধারী খুনি। সে তার আপন বাবার মতই একজন ভয়াবহ অপরাধী। পার্থক্য শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থানে। তাও মায়া লাগছে। একটা হত্যাকারিও তাহলে মাঝে মাঝে মানুষ হয়ে যায় কি?
ফিনিক্স এগিয়ে যাচ্ছে পালক মানুষটির কাছে। নির্বিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। সাঁই সাঁই করে কটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। ফিনিক্স মুখে একটা সিগারেট নিয়ে লোকটার কাছে আগুন চাইলো। লোকটা ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই ফিনিক্স ওর ক্র্যাচটা উঁচিয়ে সূক্ষ্ম একটা পোঁচ দিল লোকটার গলায়। লোকটা গলা চেপে হুট করে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে আলো আধারিতে মিলিয়ে গেল। আমি দেখলাম ওই পালক লোকটির গলা দিয়ে কোন আওয়াজ হচ্ছে না। সে ছটফট করতে করতে একটা সময় নিথর হয়ে গেলো।
মুহূর্ত বর্তমান:
অহ অহ আমার এখন মনে পড়ছে। আমি তো এই পালক লোকটার প্রেমিকা। আমি আর সে মিলিয়েই তো পরিকল্পনা করে তার পালক পিতাকে হত্যা করেছিলাম। এই লোকটা যখন তার পালক মাকেও খুন করার পরিকল্পনা করছিল। তখন আমি তাকে বাঁধা দিয়েছিলাম। এতটা আর দরকার নেই। কিন্তু সে শুনতে চায়নি। আমার সাথে লোকটার বনিবনা নষ্ট হয়ে গেলো। এরপর সে আমাকেই ভয় পেতে শুরু করলো।
অহ অহ আমার মনে পড়ছে সব। সেই তো লোক মারফৎ খবর নেয় এই শহরে সব থেকে দক্ষ পেশাদার খুনি কে আছে। এরপর সে ফিনিক্সের সন্ধান পায়। ফিনিক্স আমাকে অতি যত্নে তার কারিগরি খুনি হাতে হত্যা করে। যে মুহূর্ত থেকে সে আমাকে খুন করেছে, সেই মুহূর্ত থেকে আমি তার সাথেই আছি। কারণ আমি সেই মহিলার হারানো ছেলেটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। যদিও আমি মৃত হয়েও জীবিতদের শুনতে পাই আর সে জীবিত হয়ে মানুষদের লাশ বানায়।