রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলা সাহিত্যের নয়, বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে বিশ্বের তুলনামূলক সাহিত্যের একটি সর্বাগ্রগণ্য নাম। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর রচনার নান্দনিক, দার্শনিক, কাঠামোগত, আন্তঃসাংস্কৃতিক, পারিবেশিক এবং একবিশ্বকেন্দ্রিক মানবতাবাদী চেতনার উত্তরোত্তর পুনর্বীক্ষণ ও পুনর্মূল্যায়ন হয়ে চলেছে। কেবল তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন-কেন্দ্রিক গবেষক সম্প্রদায় কিংবা তাঁর স্বপ্নাশ্রিত জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের গবেষক ও সংগীতশিল্পীরাই নয়, সারা বিশ্বের মানব কল্যাণকামী সারস্বত সমাজ তাঁর রচনার পাঠ, পুনর্পাঠ, বিশ্লেষণ, নবায়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাকে নব আঙ্গিকে উপস্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, ফলে বিংশ শতাব্দীর এই নান্দনিক কূটাভাস একবিংশ শতাব্দীর শিল্পস্রষ্টা ও ভোক্তার কাছে এক নবায়িত অবয়ব নিয়ে হাজির হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি ক্রমাগত নন্দিত, পঠিত ও বিবেচিত হওয়ার কারণে তাঁর উপস্থিতি সর্বত্রই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের এই কালোত্তর উপস্থিতিই একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
স্বীকার্য যে, উত্তরকালে রবীন্দ্র প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে একটি কবিতার কথা বিশেষভাবে এসে পড়ে। তিনি তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের জন্য কিছু সহজ সরল অথচ সুষ্পষ্ট বার্তা রেখে গেছেন। এই বার্তাগুলোর একটি হচ্ছে সনাতনকে গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষেত্রে নবীন প্রজন্মের মনোবীক্ষণ। একশো বছর পরের কোন কবিও যে তার কবিতা কৌতূহল ভরে পড়বে এ বিশ্বাস তাঁর ছিল। একশত বছর আগের যৌবনের সৃষ্টিশীলতা আর একশত বছর পরের যৌবনের সৃষ্টিশীলতায় প্রাকরণিক প্রভেদ থাকলেও প্রেরণাগত প্রভেদ তেমন ধর্তব্য নয়। সৃষ্টিশীলতার জন্য তিনি চঞ্চলতার কথা বলেছিলেন, পুলকরাশির কথা বলেছিলেন আর তার সৃষ্টিকে নিখিলের মর্মে আঘাত করতে পারার শক্তির কথা বলেছিলেন। শতবর্ষের ব্যবধানে বসন্ত গানে প্রভেদ থাকবেই, আর থাকবে তার নির্মাণ-কুশলতায় দূরত্ব। এটি কালিক অগ্রগমণে সৃষ্টিশীলতার নবায়ন। একুশ শতকের কবির প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই বার্তাও সবিশেষ প্রাসঙ্গিক। ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি চিত্রা কাব্যগ্রন্থের, এর আগে কবি রচনা করেছিলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ নামে অন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নতুনদা এবং নতুন বৌঠানের সঙ্গে অবকাশ যাপনের সময়ে লিখেছিলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। মূলত এই কবিতাটি রচনার সময়েই কবি তাঁর সৃষ্টিশীলতার কালিক সীমানা অতিক্রমের বিষয়টি উপলব্ধি করেন। যে কারণে কবিতার শেষের দিকে তার উচ্চারণ ছিল এরকম: ‘কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ/দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।’ ইতোপূর্বে স্বপ্নে কুললক্ষীর কথা শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর উত্তরসূরি কবিরাও নিজের অন্তর্লোক থেকে পেয়েছিলেন কিছু শুভ বার্তা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম নতুনের কেতন উড়িয়ে বাংলা সাহিত্যে পদার্পণ করেন, কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন আমার এ পায়ের ধ্বনি শোনো আর সব হারানো পুরনো’। শ্রেষ্ঠ কবিরা মনোজাগতিক দর্শন থেকে এভাবেই অভিনবত্বের তথ্য পেয়ে যান।
রবীন্দ্র সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। তাঁর প্রতিবেশের নাম প্রকৃতি ও প্রাণবিশ্ব এবং তাঁর আদিঅন্তহীন সীমানাসীমান্তহীন আধারের নাম এই মহাবিশ্ব ও তার ঈশ্বরআশ্রয়ী অস্তিত্ব। বিংশ শতাব্দীর নিরীশ্বরতা, ভঙ্গুরতা, চূর্ণচিত্র, পোড়োজমি ও নৈতিকতাহীনতা, সর্বোপরি উগ্র জাতীয়তাবাদের আক্রমণাত্মক বিকাশ আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এখানকার নগর সভ্যতায় ইটের গাঁথুনির আড়ালে আবডালে মানুষ বাস করছে কীটের সংকীর্ণতায় ও কূটিলতায়। এখানে অরণ্যের সুষম শান্তিময়তা তূলনামূলকভাবে অনেক বেশী প্রার্থিত। বৈদিক তপোবনের আদলে গোটা পৃথিবীকে একটি শান্তির আবাসযোগ্য নিকেতনে পরিণত করা এবং মানুষের কর্মমুখরতাকে একটি পরিকল্পিত শ্রীনিকেতনে বিকশিত করাই ছিল ঋষি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নকল্পনা। অথচ এই একবিংশ শতাব্দীতে এটি আর কোন দিবাস্বপ্ন নয়, বরং এক আলোকোজ্জ্বল বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা। পরিবেশ দূষণে আক্রান্ত ও সমুদ্রজলের উচ্চতায় শংকিত এই পৃথিবী ও তার সংগ্রামী সন্তানেরা আজ পুরো পৃথিবীকেই সবুজের আচ্ছাদনে একটি বসবাসযোগ্য কর্মভবনে রূপান্তরিত করতে চায়। এটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ও সৃষ্টিজাত একটি কর্মপরিকল্পনা। ‘রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর বৃক্ষরোপন-উৎসব প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞানী না হয়েও প্রায় শতবর্ষ আগে, বৃক্ষের অবদান যে অপরিসীম, এই দূরদৃষ্টি পোষণ করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বৃক্ষ না থাকলে জীবন বাঁচবে না। পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হবে। জীবের আহার জুটবে না। জীবজগৎ পাবে না নির্মল বায়ু’ ১। তিনি প্রায় পঁচাশি বছর আগে বাংলা ১৩৩৩ সালে ‘বৃক্ষবন্দনা’ নামে কবিতা রচনা করেছিলেন। বৃক্ষবন্দনা কবিতার অংশবিশেষ :
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহবান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ;
উর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-’পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।
রবীন্দ্রনাথ গাছকে কখনো বলেছেন ‘আদিপ্রাণ’। কখনও আবার অভিহিত করেছেন মাটির ‘বীর সন্তান’ হিসাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানব জাতির উদ্ভব হয়েছে বর্তমান আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ‘আফ্রিকা’-কে কেন্দ্র করে একটি কবিতা রচনা করেছেন, যে কবিতায় রূপকের আশ্রয়ে পৃথিবী এবং গ্রহের উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টি প্রকাশিত ঃ
উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে
স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বার বার করছিলেন বিধ্বস্ত,
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা-নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা।।
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর সুগভীর সম্পর্কের বিষয়টিও আমাদের অজানা নয়।
কবি রবীন্দ্রনাথের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, একালের কৃষিকর্মে যে বিপ্লব এসেছে তার স্বপ্নস্রষ্টার নাম রবীন্দ্রনাথ। ছেলেবেলা থেকেই গ্রামবাংলার সঙ্গে কবির সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর ১২ বছর বয়সে লেখা ‘অভিলাষ’ কবিতায় কৃষকের দুঃখ কষ্টের চিত্র ফুটে উঠেছে। এই কবিতায় কবি বলেছেন: ‘রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক’, আবার বলেছেন: ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ’। ‘পল্লি-পুনর্গঠনে তাঁর প্রয়াস অতি শ্রদ্ধেয়। কৃষি ও কুটির শিল্পের বিকাশে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর চেষ্টা অবিস্মরণীয়। পুত্র ও জামাতাকে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছেন কৃষিবিদ্যা শিখতে, যন্ত্র দিয়ে চাষের পরীক্ষা করেছেন, তাঁতিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বয়ন-বিদ্যালয়, চাষিরা যাতে সহজে ঋণ পায় তার জন্য স্থাপন করেছেন কৃষিব্যাংক। শ্রীনিকেতনের সবটাই তার এই পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার নমুনা’২। রবীন্দ্রনাথ গ্রামোন্নয়নে অগ্রসর হয়েছেন দুটি প্রধান উদ্দেশ্য সামনে রেখে, একটি গ্রামগুলিকে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বের মতো আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে স্বশাসিত করে তোলা, দ্বিতীয়টি স্বশাসিত গ্রামে সমবায়ের ভিত্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করা। এই লক্ষেই তিনি শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। ‘একটিতে আছে বিশ্ববিদ্যার আরাধনা, অন্যটিতে শিল্প-কৃষি ও পল্লী সংগঠনের প্রয়াস। এই দুই মিলিয়েই শিক্ষার সম্পূর্ণতা বা সার্থকতা এমনই মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ’৩। তিনি বলেছেন ‘আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে শুধু তার শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে গ্রহণ করাটা মানুষের কর্তব্য নয়। বরং মনুষ্যত্বের আদর্শের সঙ্গে, সামঞ্জস্য রেখে যন্ত্র ও প্রযুক্তিকে নতুনভাবে নির্ধারণ করাই জরুরী’ (পল্লীপ্রকৃতি)। কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
মানুষ যে পৃথিবীব্যাপী গোত্রীয় বিভিন্নতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধারণ করেও এখন এক আন্তর্জাতিয়তাবাদী অভিন্ন বিশ্বের কল্পনা করছে এবং তার বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, এটিও সমন্বয়বাদী রবীন্দ্রনাথের ইতিবাচকতার ফসল। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ মানব মিলনের কথা বলেছেন, সমস্ত ব্যর্থতার অবসান ঘোষণা করেছেন এবং সবশেষে উচ্চারণ করেছেন, ‘মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ’। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও সমরাভিযানের মধ্যেও মানুষের সৃষ্টিশীল অভিব্যক্তিকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন এবং মানুষের উপরে বিশ্বাস অটুট রেখেছেন। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে মানব সভ্যতার নবস্ফূরণের মুহূর্তে আমরা যে নতুন বিশ্বঐক্যের রূপকল্প রচনা করছি, তারও উৎস প্রকল্পকের নাম রবীন্দ্রনাথ। এই রবীন্দ্রনাথ কেবল বৈদিক যুগের অতীতচারী স্বাপ্নিক রবীন্দ্রনাথ নন, বরং অনাগত কালে ও কালান্তরে এক আবশ্যকীয় সংযোগ-সেতু। এ সেতুর আরেক নাম হতে পারে মানুষের সভ্যতালীন ইতিবাচকতা নবায়িত অগ্রযাত্রা।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে ভারতভাবনা। সৃষ্টিশীল রচনার পাশাপাশি এই মনিষী প্রায় পুরোজীবন অতিবাহিত করেছেন শিক্ষা ভাবনায়। ‘ভারতবর্ষের শিক্ষাভাবনায় রবীন্দ্রনাথ দুটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। প্রথমটি ছিল আদি ভারতে শিক্ষা ও জ্ঞানের যে ধারাক্রম গড়ে উঠেছিল তা অনুসরণ করা। আর দ্বিতীয়টি ছিল সমকালীন প্রয়োগমূখী শিক্ষা’৪। তপোবনের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভারতবর্ষে এই একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেছে, এখানকার সভ্যতার মূল প্রস্রবণ শহরে নয়, বনে’। ইউরোপের শিক্ষা ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ছিল, কেননা এই শিক্ষার মধ্যে তিনি স্থূলতা ও লোভ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর মতে, যান্ত্রিক উন্নতিকেই ইউরোপ মহাঅর্জন বলে চালাতে চেয়েছে। অথচ ভারতবর্ষে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করা হয়েছে এবং ভারতবর্ষের শিক্ষায় ভোগকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। এ দেশের শিক্ষার ভাষা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের অসন্তোষ ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন ‘ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশেই শিক্ষার ভাষা এবং শিক্ষার্থীর ভাষার মধ্যে আত্মীয়তা-বিচ্ছেদের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় না’। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর শিক্ষা ভাবনায় ভারতের তপোবনের ঐতিহ্য এবং ইউরোপের আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে বলা যায়, ‘দ্য পোয়েট উইথ দ্য হেড অব আ থিংকার’। কবিকে এই অভিধাটি দিয়েছিলেন সাংবাদিক ডিমিট্রি ম্যারিয়ানক, যিনি ১৯৩০ সালের ১০ আগষ্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এ প্রকাশিত আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যেকার সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন।
স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত হয়েছেন বিচিত্র আঙ্গিকে, যেমন লেখায়, তেমনি রেখায়। ভানুসিংহের পদাবলীতে প্রথাগত শব্দ-ছন্দ-রূপকল্পনির্ভর যে স্থির কাঠামোর কবিতা দেখি, তার নির্মাণ প্রক্রিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে করতে একসময় জীবনের অন্তিমলগ্নে এসে প্রান্তমুক্ত এক বন্ধনহীন মুক্তকাব্যের ইশারা দিয়েছেন, একই সঙ্গে অবোধ শিশুর বিপন্ন বিস্ময়ে সৃষ্টিরহস্যের কূল কিনারা না করতে পারার কথা বলেছেন, অর্থাৎ কবিতায় তিনি প্রথাগত বন্ধন ও বাণী থেকে বিযুক্ত হয়েছেন। ‘প্রথম দিনের সূর্য’ শীর্ষক কাব্যিক উচ্চারণে সেই কাঠামো- মুক্তি ও বাণীমুক্তির বীজ অঙ্কুরিত। আর একবিংশ শতাব্দীর বাংলা কাব্যে প্রান্তমুক্তি, কাঠামোমুক্তি ও বাণীমুক্তির পর যে বিস্ময়াশ্রিত রহস্যময়তা কবিতার শরীর হিসেবে বিবেচ্য, তাও রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা সঞ্জাত, তাই একবিংশ শতাব্দীর নবায়িত কাব্য নিরীক্ষায়ও তিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে প্রাসঙ্গিক।
শিল্পসৃষ্টির বাইরে রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার অগ্রগমনের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে উন্নত অনুন্নত মানুষের প্রতিযোগিতা বা আধিপত্যবাদিতা নয়, বরং তাদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর জীবৎকালে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং এই সত্যের বিভিন্ন রূপ প্রত্যক্ষ করে নিজস্ব এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অন্তর্শক্তির সঙ্গে যন্ত্রশক্তির সমন্বয় ও প্রয়োগ একটি জাতিকে কিভাবে সমৃদ্ধ ও সশাসিত করে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘চক্ষের সামনে দেখলুম জাপান যন্ত্র চালনার যজ্ঞেও দেখতে দেখতে কি রকম সম্পদবান হয়ে উঠল, সেই জাপানে সমৃদ্ধি আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি, দেখেছি সেখানে স্বজাতির মধ্যে তার সভ্য শাসনের রূপ। আর দেখেছি রাশিয়ার মস্কো নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের, আরোগ্য বিস্তারের কি অসামান্য অকৃপণ অধ্যাবসায় সেই অধ্যাবসায়ের প্রভাবে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যে মূর্খতা ও দৈন্য ও আত্মাবমাননা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে’। (সভ্যতার সংকট, পৃষ্ঠা ৭৪২, ক্রয়োদশ খন্ড, বিশ্বভারতী, পুনর্মুদ্রন-১৪৪২।)
স্বদেশের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণজাত এই বিশ্ববীক্ষণ রবীন্দ্রনাথের ভিতর সৃষ্টি করেছিল এক বিশ্বমানুষের বিকাশমান অস্তিত্ব। তিনি দেখেছিলেন ভারতবর্ষে স্বস্বার্থে হিন্দু মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থাকলেও রাশিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্র অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে অমুসলমানদের বিরোধ ঘটে না। ‘তাদের উভয়ের মিলিত স্বার্থ সম্বন্ধের ভেতরে রয়েছে শাসন ব্যবস্থা যথার্থ সত্য ভূমিকা’ (প্রাগুক্ত)। মানবজাতির বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার জন্য গোত্রে গোত্রে বা বর্ণে বর্ণে বা ধর্মে ধর্মে বিরোধ নয়, বরং সহগামিতাই আরাধ্য। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে এটিই বিশ্বমঙ্গলের উপলব্ধিজাত ব্রহ্মাস্ত্র। আনন্দের কথা, আমরা এটিও পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। ‘সারা পৃথিবীকে মানবতার বাণী শোনাবার স্পর্ধা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময়েই তাঁর মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এক প্রবল ঝড় আসন্ন। এর জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন অন্যের সম্পদগ্রাসে ইউরোপের অপরিসীম লালসাকে। বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ একইসঙ্গে বিধ্বংসী ও আত্মঘাতী’৫। তিনি ৮০ বছর বয়সে অনন্তযাত্রার পূর্বমহূর্তে এক আলোকসভ্যতার রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এ ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিসহ নিষ্কলতাকে বহন করতে থাকবে। জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল’৬। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি কেবল ইংরেজদের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী সকল ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সভ্যতার পুনর্জন্ম হবে না ঔপনিবেশিক প্রভুর আকাশশাসানো প্রাসাদ থেকে, বরং তার পুনর্জন্ম হবে পৃথিবীর দারিদ্রলাঞ্ছিত যে কোন প্রান্তের যে কোন কুটিরের আলোকভিটা থেকে। রবীন্দ্রনাথের এই ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি আজ সত্যরূপ ধারণ করেছে। আর পৃথিবীর কোথাও দৃশ্যত ঔপনিবেশিক প্রভু নেই। ইউরোপ আমেরিকার কথা না হয় বাদই দেয়া হলো, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাটিন আমেরিকার তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহামানবের উত্তরসূরীরা আজ তাদের অন্তরের আলোকে পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করে তুলছেন এবং সভ্যতাকে তার মহাসংকট থেকে সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন।
এটি কেবল একটি প্রসঙ্গ নয়, প্রাসঙ্গিকতা নয়, রবীন্দ্রনাথেরই সত্য দর্শনের বাস্তবতা। এটিই একবিংশ শতাব্দীতে সাদা কালো মানুষের সম্মিলিত জয়, এটিই সভ্যতার জয়।
‘জয় জয় জয়রে মানব-অভ্যুদয়’
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।
এই জয় একবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের নতুন পরিচয়। এটিই মানবতাবাদী ও নান্দনিক ভাষ্য হিসাবে যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথের জয় অক্ষয়।
তথ্য নির্দেশ :
১. চক্রবর্তী, তপন, রবীন্দ্রনাথ : বিজ্ঞানমনস্কতা, মূর্ধন্য, ৪১ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স (বেইজমেন্ট) ডিসেম্বর, ২০১১। পৃষ্ঠা : ২৫।
২. রবি বিচিত্র/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী প্রকাশনা, ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘অশেষ রবীন্দ্রনাথ’ রচনা থেকে গৃহীত। পৃষ্ঠা: ৪৫।
৩. প্রাগুক্ত। স্বপনকুমার ঘোষ রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘পল্লীচিন্তা ও শ্রীনিকেতন’ রচনা থেকে গৃহীত। পৃষ্ঠা: ১৩৫।
৪. মাহমুদ, মজিদ, রবীন্দ্রনাথ : ভারতবর্ষ, মূর্ধন্য, ৪১ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স (বেইজমেন্ট) ডিসেম্বর, ২০১১। পৃষ্ঠা: ৫৬।
৫. রবি বিচিত্রা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী প্রকাশনা, প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৪৫।
৬. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র-রচনাবলী (ক্রয়োদশ খন্ড), জয় বুকস ইন্টারন্যাশনাল, ১৫/বি, মিরপুর রোড, ঢাকা-১২০৫। পৃষ্ঠা: ৭৪৪।