সাহিত্যে নোবেল ২০২১‌: আবদুলরাজাক লিখেছেন আপসহীনভাবে শিকড়হীন মানুষের বেদনা


তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ এ বছর (২০২১) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ৭ অক্টোবর রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি তার নাম ঘোষণা করে।

আবদুলরাজাক গুরনাহ, ৭৩ বছর বয়সি তানজানিয়ার কথাসাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হলো ‘ঔপনিবেশিকতার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে তার আপসহীন সংগ্রাম এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশীয় পরিসরে উদ্বাস্তু মানুষের কণ্ঠস্বরকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরার জন্য।’

আবদুলরাজাক গুরনাহর জন্ম পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবারে, ১৯৪৮ সালে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি উদ্বাস্তু হিসেবে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হন। ১৯৬৩-তে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে জাঞ্জিবার মুক্ত হয়। কিন্তু সেই সময় সে দেশে শুরু হয় আরব-বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে অত্যাচার এবং গণহত্যা।

আবদুলরাজাক গুরনাহ ও তার পরিবার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে পড়লে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। ১৯৮৪ সালের আগে তিনি আর স্বভূমিতে ফিরে যেতে পারেননি।

এই ভূমিচ্যুত হওয়ার বেদনা তাকে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে বাধ্য করে। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্যান্টারবেরির ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট-এ ইংরেজি এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

হাতে তুলে নেন তিনি উওলে সোইঙ্কা, গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো বা সালমান রুশদির মতো লেখকদের সাহিত্য বিষয়ে পাঠদানের কাজ। পাশাপাশি নিজেও কলম ধরেন ভূমিচ্যুত মানুষের বেদনা ও ফেলে আসা দেশের স্মৃতি ও সত্তাকে আশ্রয় করে।

তবে ইংরেজি সাহিত্যের মূলধারার চেনা ছক থেকে বেরিয়ে এসে উপনিবেশ-উত্তর চৈতন্যকে তুলে ধরাকেই প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে মনে করেন আবদুলরাজাক গুরনাহ। ২০০৫-এ প্রকাশিত উপন্যাস ‘ডেসারশন’-এ তিনি এমন এক প্রেমকে তুলে ধরেন, যা তার ভাষায় ‘সাম্রাজ্যবাদী রোমান্স’-এর একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।

তার উপন্যাস ও ছোটগল্পে আবদুলরাজাক গুরনাহ সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেছেন প্রাক-ঔপনিবেশিক আফ্রিকার ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়’-গোছের স্মৃতিকাতরতার পুনর্নিমাণকে। বরং দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা দাস ব্যবসা, ভারত মহাসাগরের দ্বীপভূমিগুলির আকাশে ঘনিয়ে থাকা বিভিন্ন পরস্পর-বিরোধী সংস্কৃতির মেঘকে তিনি লিখতে চেয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন তথাকথিত বিশ্বায়নের অনেক আগেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য ও রাজনীতি জাঞ্জিবারের মতো দ্বীপভূমিতে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল।

রুশদির মতো আবদুলরাজাক গুরনাহও যেকোনও ‘পিছুটান’-কে প্রশ্ন করেন তার উপন্যাসে। সেই ‘টান’-এর পিছনে ক্রিয়াশীল উপনিবেশ ও তার এখনও সক্রিয় বন্ধনগুলিকে বুঝতে চান বারবার। প্রথম উপন্যাস ‘মেমরি অব ডিপার্চার’ (১৯৮৭)-এ তিনি তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লব-স্বপ্নের সেই ভঙ্গুরতাকে লিখে রেখেছিলেন, যার সাক্ষী ছিল এশিয়া ও আফ্রিকার অগণিত দেশের সঙ্গে ভারতও। ১৯৮৮ সালের উপন্যাস ‘পিলগ্রিমস’-এ তিনি এমন এক যাত্রাকে আঁকেন, যেখানে আত্মপরিচয়, স্মৃতি এবং আত্মীয়তার বোধগুলি চলে আসে প্রশ্নের সামনে। ১৯৯৪-এর উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’ তাকে আবিশ্ব খ্যাতি এনে দেয়। পু্রাণকথার সঙ্গে সংলাপ ঘটে সাম্প্রতিকের। উপনিবেশ-নির্ধারিত উপন্যাসের সীমানা অতিক্রম করে এই আখ্যান। ১৯৯৬-এর ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’ এবং ২০০১-এর ‘বাই দ্য সি’-তে নীরবতাকে ভূমিচ্যুত মানুষের এক বড় অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।

তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘আফটারলাইভস’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০সালে। এখনও পর্যন্ত ১০টি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে আবদুলরাজাক গুরনাহর।

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, আনন্দবাজার