পর্ব-৩
আকলিমা খানম জোহর এবং আসরের নামাজ একসাথে পড়ে সবার জন্য আবার চা বানিয়ে বুবলির হাতে আগে বড় একটি মগ ভর্তি করে দিয়ে আবার চলে গেলেন। যেতে যেতে বলে গেলেন, আমার শুধু তিনটি ছেলে। কোনোদিন আমার একটি মেয়ে না থাকার জন্য দুঃখ বা শূন্যতা ছিল না। আগে ভাবতাম ছেলে বিয়ে দিলেই মেয়ে আসবে।আজ এইটুকু সময়ে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার একটি মেয়েও থাকা দরকার ছিল!
তন্ময় বললো, আম্মা, তুমি ওর ভেতর মেয়ের কী দেখলে? ও তো পরেই আসছে জিন্স-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপরে যেখানা পরে আছে, তা ওড়না হিসাবে নয়, উত্তরীয় হিসাবে পরেছে! দেখো কবিতা লেখা…। যদিও উত্তরীয়-ওড়না দুটি শব্দের মানে একই।
আকলিমা খানম ফিরে গিয়ে সবার জন্য চা এনে সন্ময়সহ দুই বউয়ের হাতে হাতে নিজেই সে চা তুলে দিলেন। আজ তিনি সবার কাপেই একটু বেশি করে চা ঢেলে ফেলেছেন। যা সবার হাতেই ছলকাচ্ছে।
দ্বিতীয় কাপ চা খেয়ে বুবলি চলে যেতে উঠে পড়লো।তন্ময় বললো আমি আসছি একঘণ্টা হয়নি আর তুমি চলে যাবে? বসো আমিই এগিয়ে দিয়ে আসবো!
বুবলি হেসে বললো, তোমার সাথে যাব না। যেভাবে এসেছি, সেভাবে একই যাব বলে ভেবে ফেলেছি! আচ্ছা, তোমাকে ফোন করে পাইনি কেন?
আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। দোকানে ঠিক করতে দিয়েছি। মেকানিক বলল, আরো ক’দিন সময় লাগবে। ওরা রোগ ধরতে পারছে না!
বুবলি তার দুটি ফোনের একটি থেকে সীম খুলে রেখে তন্ময়কে দিয়ে বলল, এটা রাখ। তোমার ফোন ফিরে এলে ইচ্ছে করলে আমারটা ফিরিয়ে দিতেও পার নাও পার!
তন্ময় ছিঁটকে পিছনে ফিরে বলল, না না এ তুমি কিছুতেই আমাকে দিতে পারবে না! আমি আমার মা বাবার তৃতীয় সন্তান। একটু আদর যেমন বেশি পেয়েছি, তেমনি অভাবের ভাগটাও আমার ভাগে বেশি পড়েছে। তাই আমিও সব টানাপোড়েন সইতে শিখেছি এবং সেই ফিলিংটা আমাকে একধরনের আত্মপ্রসাদ এনে দেয়! তারপর বুক চাপড়ে বলল, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান…।’ অনভ্যস্ত কণ্ঠে এটুকু বলে তন্ময় থেমে গেল। কিন্তু নির্ভুলভাবে দীর্ঘ কবিতাটি বুবলি আবৃত্তি করল। আর তাতে তার প্রতি সবার মুগ্ধতা বেড়ে গেল।
তন্ময় বললো, তোমাদের বলেছিলাম না, ও কী চিজ, ধীরে ধীরে টের পাবে!
ফোন নিয়ে মৃদু বাদাবাদির ও কবিতা আবৃত্তি পর বুবলি তার ফোনটি আবার ব্যাগে ভরে রাখে। তারপর আকলিমা খানমের দিকে চেয়ে বলল, আপনার ছেলেকে আমি ফোনটি ধার দিতে চেয়েছিলাম। নিলো না! আপনাকে আমি একটি জিনিস দিতে চাই।নেবেন?
আকলিমা খানম না বুঝেই বললেন,কি দিতে চাও?
বুবলি তার ব্যাগ থেকে দুটি চুড়ি বের করলো।আকলিমা খানম হাত বাড়িয়ে বললেন, দাও।’ বুবলি আকলিমা খানমকে চুড়ি দুটি দুহাতে পরানোর পর আকলিমা খানম হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, জানো সোনাদানার ওপর আমার কোনো লোভ কোনোকালেই ছিলো না। তবে এরকম সব জিনিস খুব কিনতাম। তন্ময়ের বাবার সাথে কখনো চারুকলা, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমির পাশ দিয়ে গেলে রিকশা থামার আগেই লাফিয়ে নেমে পড়তাম। এসব কিনতে। আর সেই যুবতী বেলায় গাওছিয়া মার্কেটে গেলে দুর্দাড় করে আগে এ ধরনের মালা-চুড়ি-দুল এগুলো কিনে নিতাম। তারপর নিজেরও বয়স হলো, বউদের আবার এসবে দেখি কোনো আকর্ষণ নেই। তাই এখন এসব কেনাকাটার অভ্যেসও চলে গেছে।
বুবলি বলল, আমি তো ইংলিশ স্কুলে পড়েছি। ছোটবেলা থেকে আমারও পরার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বিভিন্ন উপলক্ষে সেই ছোটবেলা থেকেই আমি মায়ের জন্য কিনতাম। এখনো কেনার অভ্যাস রয়ে গেছে। মায়ের স্পর্শ পেতেই মায়ের গহনা আমি মাঝে মাঝে পরি।আবার খুলে ব্যাগে রেখে দেই!