সাহিত্যে পুরস্কারের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ সাহিত্যিকদের। শত-সহস্র অভিযোগের পরও বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে এখন পর্যন্ত সাহিত্য সংশ্লিষ্টরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার বলে মেনে আসছেন। আর এরপরই আলাওল পুরস্কারকে বিবেচনা করা হয়। বিশেষত এই পুরস্কারগুলোর মনোনয়নপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। এসব পুরস্কার থাকার পরও নতুন করে আসছে ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার’।
সম্প্রতি ঘোষিত পুরস্কারটি এবারই প্রথম দেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুরস্কারটি হবে দেশের সবচেয়ে নির্মোহ-মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার।
কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার’ দেওয়া হবে মাত্র তিন ক্যাটাগরিতে। এগুলো হলো : (১) প্রবন্ধ, (২) কথাসাহিত্য ও (৩) কবিতা শাখা। পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। আর পুরস্কার দেওয়া হবে ২০২২ সালের শুরুর সপ্তাহেই। কিন্তু কারা পাচ্ছেন প্রথমবার এই পুরস্কার, তা নিয়ে ইতোমধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে সাহিত্য সমাজে।
প্রবন্ধে যাদের নিয়ে সাহিত্যমোদীরা আলোচনা-সমালোচনায় ব্যস্ত, তারা হলেন— তপন বাগচী, মাসুদুল হক ও হামীম কামরুল হক। নব্বই দশকের কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক তপন বাগচী। কবিতা ও শিশুসাহিত্য ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে—‘সাহিত্যের এদিক-সেদিক’, ‘সাহিত্যের কাছে-দূরে’, ‘চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান’, ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ’, ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’, ‘মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ’, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: চন্দ্রাহত অভিমান’, ‘নির্বাচন সাংবাদিকতা’, ‘নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার’, ‘তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ’। প্রবন্ধে তার এই মৌলিক কাজের জন্য তিনি আলোচিত।
মাসুদুল হক মূলত কবি ও কথাসাহিত্যিক। অনুবাদ ও গবেষণায় তার সমান আগ্রহ রয়েছে। তার প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থ ৬টি । প্রবন্ধ-গবেষণাগ্রন্থ হচ্ছে—‘বাংলাদেশের কবিতার নন্দনতত্ত্ব’, ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’, ‘দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ: দিনাজপুর’, ‘জীবনানন্দ দাশ ও অন্যান্য’। তার সম্পদিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে—‘কবিতা সিরিজ’, ‘এই সময় এই স্রোত’, ‘মৃত্যূত্তীর্ণ: ইয়াসমিন’, সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘সেলিনা হোসেন’, লিটল-ম্যাগ সম্পাদনা ‘শ্রাবণের আড্ডা’। প্রবন্ধ, সম্পাদনা ও গবেষণায় তিনি সার্থকতার পরিচয় দিতে পেরেছেন।
হামীম কামরুল হক পত্রপত্রিকায় লিখে আসছেন বিশ শতের অন্তিমকাল থেকে থেকে। তার প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে—‘জাদুবাস্তববাদ’, ‘ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিবেচনা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা: গতিপ্রকৃতি ও পাঠ বিবেচনা’। এছাড়া যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘লেখার শিল্প লেখকের সংকল্প’, ‘অসমাপ্ত একাত্তর মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়’। তার বইয়ের সংখ্যা কম হলেও ‘ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য’ বিবেচনা বইটি তরুণদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। তরুণ গল্প লেখকরা বইটিকে দিকনির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
এদিকে কবিতায় যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তারা হলেন—আসাদ মান্নান, বিমল গুহ ও মাহমুদ কামাল। এর মধ্যে আসাদ মান্নান মহান মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের প্রথম সারির অন্যতম শক্তিশালী কবি। কাব্যবুননে তিনি নিজস্ব ধরন, কৌশল বা রীতি স্বকীয় প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। বাংলা কবিতায় তার নিজস্ব বলয় সৃষ্টির বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি মেরুকরণ বলা যেতে পারে। বাংলা ভাষার কবি ও কবিতায় তিনি বিশেষ জায়গায় অবস্থান করে আছেন। কবি আসাদ মান্নান একজন সুপরিচিত এবং সুনন্দিত নাম। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামাজিক আন্দোলনের তার কবিতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। তার বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার পাশাপাশি বেশ কিছু গদ্যও রচনা করছেন। ‘সুন্দর দক্ষিণে থাকে’, ‘হে অন্ধ জলের রাজা’, ‘সৈয়দ বংশের ফুল’, ‘ভালোবাসা আগুনের নদী’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘সূর্যাস্তের উল্টোদিকে’, ‘দ্বিতীয় জন্মের দিকে’, ‘তোমার কীর্তন’, ‘যে-পারে পার নেই সে-পারে ফিরবে নদী’, ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ‘প্রেমের কবিতা’ প্রভৃতি তার অন্যতম কাব্যগ্রন্থ।
বিমল গুহ’র কবিতায় স্বাজত্যবোধ, স্বাধীনতার স্মৃতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, ১৫ আগস্টের কালো অধ্যায়, মানুষের বিবেক, প্রকৃতি ও ধরন উঠে এসেছে নিগূঢ় বাস্তবতায়। তার কবিতায় একদিকে যেমন গৌরবমাখা; অন্যদিকে বিষাদের কালো ছায়া ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই আবার অন্ধকার ভেদ-করা অন্য এক আলোর সকাল দেখা দেয়। যে কারণে তিনি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে আহ্বান জানিয়েছেন। তার কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে—‘অহংকার, তোমার শব্দ’, ‘সাঁকো পার হলে খোলা পথ’, ‘স্বপ্নে জলে শর্তহীন ভোর’, ‘ভালোবাসার কবিতা’, ‘কবিতাসমগ্র’, ‘নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘প্রতিবাদী শব্দের মিছিল’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘বিমল গুহের কবিতা সংকলন’, ‘আমরা রয়েছি মাটি ছুঁয়ে’, ‘প্রত্যেকই পৃথক বিপ্লবী’ ও ‘বিবরের গান’ প্রভৃতি।
কবি মাহমুদ কামাল একাধিক কাব্যগ্রন্থ এবং বহু গ্রন্থের প্রণেতা। সজিব ও সৃষ্টিশীল লেখক হিসাবে সব সময় সচল। বাংলাদেশ ও ভারতে সমানভাবে সমাদৃত তিনি। একটি পুরো জীবনকে তিনি কবিতা তথা সাহিত্যের জন্য নিবেদন করেছেন। কবি মাহমুদ কামাল ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠাতা ও স্বীকৃতি পেয়েই তৃপ্ত নন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান সাহিত্য সাধনাকে প্রণোদনা জাগাতে সব সময়ই তৎপর রয়েছেন। নানা বয়সের নানা স্থানের কবিদের আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরতেও সফল হয়েছেন তিনি। তার কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে—‘বাকিটুকু অদ্ভুত আঁধার’, ‘মুখোশের ভেতরে মুখোশ’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘ব্যাকুল শব্দেরা’, ‘যাবো না তবু যাই’, ‘কাব্য সমগ্র’, ‘মুহূর্তের কবিতা’ প্রভৃতি।
এছাড়া, কথাসাহিত্যে আলোচনায় রয়েছেন রুমা মোদক, প্রশান্ত মৃধা ও আকমল হোসেন নিপু। এর মধ্যে রুমা মোদকের শুরুটা আরও অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগৎকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোয় সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ। তার গল্প অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। নদীর নাম ভেড়ামোহনা, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস: হবিগঞ্জ জেলাও অন্যতম কীর্তি।
প্রশান্ত মৃধা মূলত কথাসাহিত্যিক। তার জন্ম ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর বাগেরহাটে। কলেজে শিক্ষকতায় যুক্ত। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি প্রবন্ধ ও কলামসহ বিভিন্ন ধরনের গদ্য লেখেন। ব্যক্তিগত ও রম্য রচনায়ও আগ্রহী। বইয়ের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘বাঙলার পাঠশালা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার’, ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ এবং ‘কাগজ তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার’। তার উল্লেখযোগ্য বই—‘হারিয়ে যাওয়া জীবিকা’, ‘বিগতকালের অনুমান’, ‘ডুগডুগির আসর’, ‘জল ও জালের তরঙ্গ’, ‘আপন সাকিন’, ‘কুহক বিভ্রম’ ও ‘যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী’।
আকমল হোসেন নিপু পেশায় সাংবাদিক। তার বইগুলো হচ্ছে—গল্প: ‘জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ’, ‘বুড়ি চাঁদ ডুবে যাবার পরে’, ‘আমরা খুব খারাপ সময়ে বেঁচে আছি’, ‘সাদা কাপড়ের শোক’, ‘রাতটা পূর্ণিমার ছিল’, উপন্যাস: ‘হলুদ পাখির ডাক অথবা অন্ধকারের নদী’, ‘ভূমিপুত্র অথবা হাওর পুরাণ’, ‘হীরামতি ও তার রাঁধুনীকাল’। তার ‘নির্বাচিত গল্প’ গ্রন্থ বেরিয়েছে ২০২০ সালের বইমেলায়।
প্রবন্ধে যে তিন জনের নাম উঠে এসেছে, তারা প্রত্যেকেই সম্মানিত হওয়ার দাবি রাখেন। কাকে রেখে কাকে দেওয়া হবে এ পুরস্কার; তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে আয়োজকদের। কবিতায় যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তারাও কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নেই। ফলে একজনকে নির্বাচন করা জটিল হয়ে পড়বে। এরপরও বিচারক তথা নির্বাচকদের নির্মোহভাবে যেকোনো একজনকেই বেছে নিতে হবে। কথাসাহিত্যে কাকে দেওয়া যায়, এ নিয়ে গলদঘর্ম হতে হবে নিশ্চয়ই। তারা তিনজনই সমান যোগ্য। তবে কে পাবেন কথাসাহিত্যে চিন্তাসূত্র পুরস্কার, তা সময়ই বলে দেবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন প্রতিবছরই কোনো না কোনো পুরস্কার দিয়ে থাকে। একেকটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নিয়ম একেক রকম। চিন্তাসূত্রের সদ্যঘোষিত সাহিত্য পুরস্কার কমিটিও তাদের নীতিমালা ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ীই তারা পুরস্কার দেবে। পুরস্কার নিয়ে যেহেতু সবারই কমবেশি আগ্রহ থাকে, তাই বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনাও হয়। চিন্তাসূত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানা যায়, প্রবন্ধ-গবেষণা, কথাসাহিত্য-নাটক, কবিতা-গানে বিশেষ অবদানের জন্য প্রতিবছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এ পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হবে। আর বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় প্রতিবছর মাত্র একজনকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হবে। মনোনীত ব্যক্তির নাম ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি প্রকাশ করা হবে।
আয়োজকরা বলেছিলেন, চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কারের জন্য কোনো লেখককে কোনো বই জমা দিতে হবে না। চিন্তাসূত্রই যোগ্য সাহিত্যিকের বই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংগ্রহ করবে। তারা তাদের সিদ্ধান্তে এখনো অবিচল আছে। কেননা তাদের ভাষায়, পুরস্কার দেওয়া হবে মনোনীত সাহিত্যিকের সর্বশেষ দশ বছরের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করে। কোনো একক বই বা পাণ্ডুলিপির জন্য নয়।
সুতরাং চিন্তাসূত্র কর্তৃপক্ষ যদি তাদের নীতিমালা অনুযায়ী পুরস্কার দিতে পারে, তাহলে আলোচনার জন্ম দিতে পারবে। যেটা লক্ষ করা যাচ্ছে নাম ঘোষণার আগেই। এখনই সাহিত্যজনরা বিভিন্ন জনের নাম ধরে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় চিন্তাসূত্রের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে যারা এ বছর পাচ্ছেন না, তারা যে ভবিষ্যতেও পাবেন না, এমন কোনো নীতিমালা নেই বলেই মনে হচ্ছে। এবার না হলেও পরবর্তী সময়েও আপনার হাতে উঠতে পারে চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার। যারা পুরস্কার পাবেন, তাদের অগ্রিম অভিবাদন জানিয়ে রাখছি। জয় হোক চিন্তাসূত্রে, চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কারের।