সাদা কার্বন (পর্ব-৫) ॥ ইসমত শিল্পী


সাদা কার্বন পর্ব-৫

তার সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। বিরোধও না। পার্থক্য ছিল ঢের।আমি ছিলাম খোলা বই। সে ভীষণ গোপন। আমার ‘কঠিন’ পছন্দ, গোপনীয়তা নয়। তবু আমি পড়তে চেয়েছিলাম। গোপন মানেও তো একরকমের অজানা। অজানাকে জানার কৌতূহল দমিয়ে রাখা যায় না। অজানাকে জানার কৌতূহল, এক ধরনের সাধ। দুর্বোধ্যকে পড়তে চাইবার সাধ ও আকাঙ্খা নিয়েও বেঁচে থাকা যায়, অবলিলায়, আনন্দে।

এ প্রত্যয় নিয়েই এতটা বছর কাটলো! সমস্ত আনন্দ ঢেলে দিলাম সেখানে। এর মূল্য নেই, না থাকুক- আমার কাছে এমন উজাড়ের মূল্য আছে। আমার কাছে আমি কী তা আমি জানি; এটা জানা সবথেকে জরুরি।

এখানেই ছিলো আমার সাথে তার চরম অমিল। আমি স্রেফ কাট-কাট কথায় অনেকবার বোঝাতে চেয়েছি, “নিজেকে বোঝো”- এই দর্শনটা বুঝলেই কোনো সমস্যা থাকে না। এসবই চর্চার বিষয়। নিজেকে নিজেই চর্চা করতে হয়।এসব বই পুস্তকে থাকে না। নিজের কাছ থেকেই নিজে জীবনভর শিখতে হয়, শেখা যায়। এটাই রিয়েলাইজেশন…।

কিছুতেই সেটা বুঝলে না! তোমার ভেতরে একশ ভাগ দৈন্যতা-এই বোধের। কে জানতো, এ দৈন্যতা কখনো ঘুচবে না! কিছুতেই না! মানুষের মধ্যে সহজাত বলে একটা ব্যাপার আছে, যা জন্মসূত্রে পাওয়া। যা নিয়ে সে জন্মায়-নতুন করে শিখতে হয় না।একটা সময় পরে আর শেখাও যায় না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই জিনিস এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় জিন এর মাধ্যমে।পরবর্তী সময়ে মানুষ শিখতে থাকে। মনুষ্য জীবনে এমন কিছু সময় আছে যা তাকে বিশেষ বিশেষ কাজে পটু হতে সাহায্য করে।নির্দিষ্ট সময়টা পেরিয়ে গেলে শত চেষ্টাতেও আর তাকে সে বিষয়টা রপ্ত করানো যায় না।যেমন, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো; এরকম কিছু দক্ষতা।

সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধও গড়ে ওঠে অতিশৈশবেই। আমাদের বর্তমান সমাজ মূল্যবোধ ও নীতিবোধহীনতার এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে। শৈশবের শেখা মূল্যবোধ ও নীতিবোধ মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।এই শিক্ষাটা মানুষ লাভ করে পরিবার থেকে এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে।

আর থাকে অর্জন, মানুষের অভিজ্ঞতার দ্বারা।জন্ম থেকে মৃত্য অবধি আমরা অর্জন করতে থাকি।সবারই একেক রকম অর্জন থাকে সারাজীবনে। তোমার অর্জন জটিল ও রহস্যময়। জটিলতা নীতি আদর্শের ভিত্তিতে নেতিবাচক।তোমার মধ্যে মিশে আছে এমন সব জটিলতা, যাকে ভুল করে কঠিন ভেবেছিলাম।কঠিন হলে আমার থেকে সুখী এবং খুশি আর কেউ হতো না! আর আমার অভ্যাস সবসময়ই খোলা চোখে জীবন দেখা।

শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছি, শিখেছি খোলা মনে মেনে নেওয়া, মানিয়ে চলা।প্রাণ খুলে হাসতে চাওয়া আমার প্রাণপণ চেষ্টা।বলেছি অসংখ্যবার, একটাই তো জীবন! এই-আর কটা বছর-ই তো, একসাথে হাসতে হাসতে গড়িয়ে দেওয়া যেতো না বলো ? যেত- কিন্তু তোমার লোভ সবকিছুকে নষ্ট করলো।অনেক কিছু পাবার লোভ। ক্ষমতার লোভ।জয়ী হবার লোভে মরিয়া হয়েছো সবসময়।প্রাপ্তিতে তুষ্টি নেই তোমার।দখলদারিত্ব বজায় রাখার প্রবণতা প্রবল।তোমাকে পড়তে পড়তে অনেক বেশি জেনেছি, হয়তো তোমার থেকেও বেশি।কতকিছু জেনেও পাশে থেকে তোমাকে পরিশীলিত করবার বাসনায় নিজেকে উচ্ছন্নে দিয়েছিলাম।আমার লোভ ছিলো না কিছুতে কোনোদিনই।উদার হয়েছি বলেই কি এমন ফাঁকি দিতে হয়।

মানুষ নিজের সাথে ঠিক বোঝাপড়া করতে না জানলেও একটা বোঝাপড়া করে নিতে জানতে হয়।আমি সেভাবেই করেছিলাম।তুমিও করেছিলে, তোমার মতো করে। জটিল অজানায়।আমার বোঝাপড়াটা ছিলো বিশ্বাসে। আস্থায়, অবিচল গতিময়তায়। তাই কিছু না পেয়েও আস্থা আর বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে থেকেছি।সেটািই কাল হলো।তোমার সবকিছুই ছিলো সাজানো; ফাঁকি, আস্থাহীন আড়ষ্টতার। সাবলিলতা না থাকলে সেখানে স্বস্তি থাকে না।

তোমার সাথে আমার এতটা অমিল বুঝেও মেলাতে গিয়ে ঘা খেয়েছি অনেক। ফিরে আসিনি। হাল ছেড়ে দেওয়া আমার ধাতে নেই। দোষ- সবকিছু ঠিকঠাক করতে চাওয়ায়।
আসলে আমার থেকে তুমিই বেশি অস্বস্তিতে কাটালে! তুমি যা না, তার ই প্রকাশ ঘটাতে গিয়েছো, এতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছি আমরা দুজন।আচ্ছা, এখন কি স্বস্তিতে আছো?

ফাঁকি আর চুরির ভেতরে কখনও কোনও স্বস্তি থাকতে পারে না। এ আমার বিশ্বাস।আমি তোমাকে বহুবার বলেছি, ‘তোমাকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না জেনেও আমি বিশ্বাস করতে চাই।কারণ বিশ্বাসের মাঝে আছে ভীষণ রকমের তৃপ্তি আর স্বস্তি।বিশ্বাসের মাঝে আছে ভীষণ শান্তি।’ বলেছি, তোমাকে তুমি বিশ্বাস করো বা না করো, আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করি- এটাকে অন্তত বিশ্বাস করো!

তুমি অনেক কিছু অর্জন করেছো, ক্ষমতা দখল করার জন্য জয়ী হবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে, ভাবতেও লজ্জা লাগে আমার! এখন তুমি জয়ী কিন্তু স্বস্তিতে আছো কি? ক্ষমতা দিয়ে আর যাই হোক স্বস্তিতে থাকা যায় না। তৃপ্তি আসে না কিছুতেই। এই বিরাট শূন্যতা নিয়ে আমি কষ্টে থাকলেও অস্বস্তিতে নেই।