আমরাই কেউ না কেউ তৈরি করি তপ্ত বালিয়াড়ি। আমাদের শোবার ঘরে অথবা বাগানে। রোদ জল ঝড় উপেক্ষা করে হাঁটি। একান্তে কী এক মহাকাল বুকে পুষে রাখি তাবৎ তরঙ্গ ও শূন্য আরণ্যকজুড়ে। তা কজন বুঝি! অর্ধেক বয়েসেই চতুরগুণ যাপন মুখস্থ করা অতো সহজ নয়, জেনেও মুখস্থ করি।
অবলিলায় হাঁটে যুগ। অথচ যাপনের কাল্পনিক তরঙ্গ এত শব্দ খোঁজে কেন? কেউ তো ডাকে না অমন! তবু বিনয়ের সেতার কাঁদে! এদিক ওদিক কেউ নেই, চেনা বা অচেনা! তবু কাকে যেনো খুঁজি সঙ্গপোনে। আয়েসে আপনে অক্লেশে কাকে চাই ভুল করে?
ছোটবেলা থেকেই বুঝি, আমি আব্বার মতো স্বভাব পেয়েছি। ওরকমই ত্যাগ করেছি সারাজীবন, কিছুটা একরোখাও। প্রচণ্ড টালমাটাল পরিস্থিতিতেও আব্বাকে খুব স্থির থাকতে দেখেছি। কী রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী সাংসারিক অভাব অনটন বা পারিবারিক জটিলতা- সবের বেলাতেই। প্রচণ্ড ঝোড়োবাতাসেও একফোটা টলতে দেখিনি আব্বাকে।
টলতে দেখিনি কিন্তু সোজা হয়ে সুয়ে থাকতে দেখেছি আব্বাকে অনেক সময়। চুপচাপ, অধো-অন্ধকারে একা। আমি যখন কলেজে তখন খুব খেয়াল করতাম, আব্বা বেশিরভাব সময় লম্বা হয়ে সুয়ে আছে কিন্তু ঘুমোয় নি। বুঝতাম। একইভাবে সুয়ে থাকা ঘুমোনো মানুষ আর না ঘুমোনো মানুষ বোঝা যায়। আমি অন্তত: বুঝি।
এও বুঝি নিজেকে টলতে না দেওয়া মানুষটা যতসব কষ্ট, না পাওয়া, একাকিত্ব এসবের ভেতরে ক্রমেই নিজেকে সেধিয়ে দেয়। তবুও টলে যায় না- এ যেনো স্থির, আরেক ব্যক্তিত্ব। ভেতর থেকে শক্তি ছেকে নিয়ে আসতেই এই স্থিরতা।
কিন্তু কী মর্মান্তিক কী ভয়ঙ্কর গর্তের ভিতরে একটা মানুষের পা থেকে শুরু করে পুরো শরীরটা ঢুকে পড়ছে ক্রমেই ! এবং জেনে বুঝেই সচেতনভাবেই ঘটতে দিচ্ছে এগুলো; সারাজীবন। অথচ টলে যাবার ইচ্ছে নেই ! আবার কিচ্ছু পাবার ইচ্ছেও নেই। হয়ত সাধ ছিলো। ইচ্ছে আর সাধ তো এক নয়! এই যে স্থিরতা, তা কি হাজার না পাওয়া নিয়ে নিদারণভাবে ত্যাগের চূড়ান্ত এক মহিমায় নিজের প্রতি অন্যায় করা নয়।
ত্যাগও এক ধরনের মোহ। সেই মোহকেও ত্যাগ করা প্রয়োজন- আব্বা ! নিজের বেলায় যেমন বুঝি আপনার বেলাতেও অমনই বুঝি।
নিজের প্রতি প্রতিনিয়ত অন্যায় করে যাওয়া মানুষটার উপরে প্রচণ্ড রাগ হয় আমার। ক্ষোভ হয়। ক্ষোভ রাগ জমা হতে হতে বিরাট একটা পাথর আমার উপরেই ভর করে পুনরায়। উপরন্ত দ্বিগুণ স্থিরতা ভর করে আমার ওপর।
আমি তাহলে যাবো কোথায় ! আর কতটা ভাঙনের ভেতরে পা দিয়ে এভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! সারাজীবন পরগাছাই থেকে গেলাম। অথচ গাছ হতে চেয়েছিলাম। গাছ হবার কথা ছিলো- হব না !
স্বাধীনতা পছন্দ করা মানুষদের নিজের জন্যে কিচ্ছু থাকে না, কেউ থাকে না। শুধু নিজে ছাড়া। শুধুমাত্র নিজের মনের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকলে সঙ্গী হিসেবে কেউই থাকে না। সবার প্রয়োজনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার উপলব্ধি কেমন, তা কে বুঝবে !
আর কেউ যখন বোঝে না তখন নিজেকে নিজেই বুঝতে হয়।সেইটুকু না হলে বেঁচে থাকার আর পথ থাকে না।