আমার তৃতীয় উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ আসছে এ মাসের (মার্চ) ২৫ তারিখের পরে বইমেলায় ‘কথাপ্রকাশ’-এর স্টলে। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল।
কথা ছিল তৃতীয় উপন্যাস হবে ‘স্কয়ার ওয়ান‘। কিন্তু ওই দেড় লাখ শব্দের, ওই একশর ওপর চরিত্রের বিশাল গ্রন্থের কাজে তাড়াহুড়া করলাম না। ওটা আসবে এ বছরের শেষ ভাগে আশা করি।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ আগেই লেখা ও প্রকাশিত এক নভেলা ছিল। বেরিয়েছিল পাঁচ বছর আগে ‘সমকাল‘ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। বন্ধুরা পড়ে অনেক ভালো বলেছিল গল্পটাকে, গল্পের ভাষাকে। ‘সমকাল’-এর ওই প্রায় ২০,০০০ শব্দের মধ্যে প্রমাণ সাইজ কোনো উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গ উপাদান বিদ্যমান ছিলই। আর সেই ২০১৫ সালেই এর অধ্যায় টু অধ্যায় ড্রাফটিং-ম্যাপিং-ডায়াগ্রাম সব আমার করাই ছিল এক নীল নোট বইয়ের ৩৪ পৃষ্ঠাজুড়ে। তা নিয়েই কাজ করলাম গত দেড় মাস। দাঁড়িয়ে গেল প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস—‘আন্ডারগ্রাউন্ড’।
একসঙ্গে পাঁচটা গল্প চলছে এতে পাশাপাশি: এক ভাই তিরিশ বছর পরে তার হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইকে খুঁজছে দূর এক দেশের লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এই বর্তমানে; দুই বন্ধু হিসাব মেলাতে চাইছে শৈশবের বরিশালে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর এক নিপীড়নের ঘটনার সঙ্গে পরের এক মাথা-ঘোরানো সাম্প্রদায়িক খুনের; নায়কের বিলিয়নিয়ার বন্ধু বলছে যে, সে ভেঙেচুরে শেষ ও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া এক স্বদেশী ছোটভাইকে সাহায্য করতে রাজি কেবল সেই ছোটভাইয়ের স্ত্রীর শারীরিক সঙ্গ পাওয়ার বিনিময়েই।—ব্যক্তিগত এসব গল্পের সূত্র ধরে নায়ক বুঝতে চায় পরিস্থিতির কোন জংশনে এসে ব্যক্তির জীবনের কাহিনিগুলো ব্যক্তিগতকে পেরিয়ে ইতিহাসের দুয়ারে এসে মেলে? বুঝতে চায়, রাষ্ট্রের কোন প্রাণহরণকারী ইচ্ছার থেকে একজন ব্যক্তি মানুষ হঠাৎ ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে?
শেষের এই প্রশ্নই তাকে টেনে নিয়ে যায় বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলস্তামের বর্বর হত্যাকাণ্ডের দিকে। তাকে বলা হয়, সব লেখকের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করবার জন্য ১৯৩৮ সালে ওসিপের কলম যে থামিয়ে দেওয়া হল, সেই ঘটনার আদ্যোপান্তটুকু বোঝা গেলেই জানা যাবে এই পৃথিবী ও এর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদগুলো কারা চালায়, কীভাবে চালায় এবং কেন তারা তা ওভাবেই চালায়, আর কেন ঠিক নির্দিষ্ট ওই একভাবে সিস্টেমটা চলে বলেই টিকে থাকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা?
পৃথিবীকে বোঝাবুঝির এমন এক টালমাটাল মুহূর্তে নায়কের সেই বিলিয়নিয়ার বন্ধু তাকে জানায়—না, সে ভুল; মাটির ওপরে ওভারগ্রাউন্ডে আসলে কোনো সত্যই নেই, সত্য আছে কেবল আন্ডারগ্রাউন্ডে, যেহেতু যা কিছু ঘটে তা কিছু ঘটানো হয় আন্ডারগ্রাউন্ড থেকেই। এবার আমরা মুখোমুখি হই আন্ডারগ্রাউন্ডের এক প্যারালাল পৃথিবীর, যেখানে ন্যায়-অন্যায়, বিচার-অবিচার, প্রেম-ঘৃণা, আমাদের স্বাধীনতা ও সেই স্বাধীনতা হরণকারী শোষণ ও জুলুম, এই সবকিছুর হিসাব আর বোঝাবুঝি ধনী ও গরীবে সম্পূর্ণ আলাদা। কেন?
মাটির ওপরের প্রকাশ্য পৃথিবী আর মাটির নিচের গোপন পৃথিবীর মধ্যে পার্সপেক্টিভের এত ফারাক থাকলে বর্তমান সিস্টেমের পক্ষে কী করে সম্ভব মানবসমাজের জন্য কোনো বৃহত্তর ঐক্যসূচক অর্থ খাড়া করা? তো, এভাবে কতদিন টিকবে আর এই সিস্টেম? কবে শেষ হবে এই অনাচার ও তামাশার, উন্নয়নের বর্ণচ্ছটা ও জনগণের দাবির নামে হালাল হওয়া সব নিষ্ঠুর ব্যবস্থার? আর শেষ হওয়াটা কি আদৌ জরুরি?
সঙ্গত কারণেই আন্ডারগ্রাউন্ডের সেই দুনিয়াকে দেখবার পরে নায়ক বুঝতে পারে কেন জঘন্য ওই কাণ্ডটা ঘটেছিল বরিশালে, কেন তার বড় ভাই পালাচ্ছে নিজের মায়ের কাছ থেকেও, কেন লোভের হিসাব চিরকালই করা হচ্ছে হয় টাকা না-হয় নারী শরীরের কারেন্সিতে, আর কেন ওসিপ মান্দেলস্তামদেরকে মরতেই হচ্ছে ক্ষমতা-মেশিন চালু রাখবার বৃহত্তর স্বার্থে। এসব যতই তার বোধগম্য হয়ে উঠতে থাকে, ততই তার ভাবনা এবার ঘুরপাক খেতে থাকে একটা মাত্র প্রশ্নকে ঘিরে—পৃথিবীর কোনোকিছুই যদি ভালভাবে না চলে, যদি বিপ্লব সে কারণে অনিবার্যই হয়ে ওঠে, তো সেই বিপ্লবের পরে কী?
[ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের ]