এ বছর ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন রুমা মোদক। কথাসাহিত্যে তিনি এ পুরস্কার পান। রুমা মোদক একাধারে গল্পকার, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকর্মী। জন্ম ১৯৭০ সালের ৭ মে, হবিগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- নির্বিশঙ্ক অভিলাষ, নির্বিশঙ্ক অভিলাষ, ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি, প্রসঙ্গটি বিব্রতকর, গোল, মুক্তিযুদ্ধের তিনটি নাটক, অন্তর্গত। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন পুরস্কার, লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চা এবং সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক সাইফ বরকতুল্লাহ।
সাইফ: কথাসাহিত্যে চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
রুমা মোদক: কথাসাহিত্যে এটাই আমার প্রথম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার। এর আগেও গল্প লিখে একাধিক পুরস্কার পেয়েছি। তখন এই যে আপনারা কথাসাহিত্যিক অভিধায় ডাকছেন, আমার সে পরিচয় ছিল না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ইউনিলিভার ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ প্রমোট করার জন্য একবার ভালোবাসার গল্প নামে প্রতিযোগিতায় গল্প আহ্বান করলো। পঞ্চাশজন গল্পকারের একজন হিসেবে পুরস্কার পাওয়ার জন্য দেশের প্রায় সব কয়টি পত্রিকায় আমার নাম ঘোষণা করলো। গল্পগুলো খুব সম্ভব সাপ্তাহিক ২০০০ প্রকাশ করলো। হুমায়ূন আহমেদ বিচারক হিসেবে কয়েকপাতা সমালোচনামূলক ভূমিকা লিখলেন। সবই হলো। কিন্তু পুরস্কার আমার হাতে পৌঁছালো না। কেন তা আজও জানি না।
তারপর অবশ্য আরও দুয়েকবার এরকম বিচ্ছিন্ন একটা-দুটো গল্পের জন্য পুরস্কার পেয়েছি। নামে পরিচিত না হলেও আর্থিক প্রাপ্তি হিসেবে বেশ ছিল। এরকম একটি পুরস্কারের টাকা আমার সন্তানদের জন্মের সি সেকশনের সময় কাজে লেগেছিল। বৈশাখী টিভির সেরা গল্পকারের পুরস্কার পেয়েছিলাম যে গল্পটি লিখে, সাহিত্যিক অমর মিত্র সে গল্পকে খুবই দুর্বল গল্প হিসেবে আমার পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। আসলে ধান ভানতে এতো শিবের গীত গাওয়ার কারণ, আমাদের সাহিত্য পুরস্কার গুলোর প্রায় সব কয়টি পক্ষপাতিত্বমূলক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ পুরস্কার ব্যাপারটি আসলে আপেক্ষিক।
চিন্তাসূত্র প্রথমবারের মতো এ কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য আমাকে নির্বাচিত করেছে। বিষয়টি আমার জন্য কিছুটা অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাহিত্য পুরস্কার গত কয়েকবছর ধরে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ফলে পুরস্কারপ্রাপ্তি গৌরবের চেয়ে বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। পুরস্কারপ্রাপ্তির পর আনন্দ প্রকাশের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পুরস্কারটি কতটা নিরপেক্ষ তার প্রমাণ হাজির করা। পুরস্কার বা পদক যিনি বা যাঁরা দেন, তাঁরা মূলত এর মাধ্যমে লেখকদের সম্মান জানান। তাঁরা নিশ্চয়ই পাঠকও বটে। লেখক হিসেবে তাঁদের মূল্যায়নকে অসম্মান করার হিম্মত আমার নেই। তাই পুরস্কারকে লেখক জীবনের অমূল্য অর্জন বলে মনে করি। চিন্তাসূত্র এবার প্রথমবারের মতো পুরস্কার দিচ্ছে। কাজেই সেটা কতটা পক্ষপাতিত্বহীন কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধতার ঊর্ধ্বে কিংবা নিরপেক্ষ তা ভবিষ্যৎ বলবে।
সাইফ: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার গুণাবলি কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? গল্প লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক কী বলে মনে করেন?
রুমা মোদক: এটা বলা খুব মুশকিল। এই যে লেখার টেকনিক বা ক্রাফট বা শৈলী সেটাই লেখকের স্বাতন্ত্র্য। একেকজন লেখক একেকরকম করে ভাবেন, বলেন। কারও ভাবনাকেই আমি বাতিল করার অধিকার রাখি না। আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগা না লাগা কোনো স্বতসিদ্ধ সিদ্ধান্ত নয়। কেউ ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, কেউ শৈলীকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, কেউ বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন। কেউ আখ্যানকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, কেউ আখ্যানহীনতাকে। আমি পাঠক হিসাবে কাউকেই বাতিল করি না, লেখক হিসাবে তো করিই না। তবে পাঠক হিসাবে আমার কাছে আখ্যান আর ক্রাফট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ভাষা তো কমিউনিকেশনের মাধ্যম। ভাষার বাহুল্য আখ্যানকে দুর্বল করবে এটা প্রত্যাশা করি না। আবার পাঠক কমিউনিকেট করতে পারবে না ভেবে দুর্বল ভাষায় লেখাও প্রত্যাশা করি না। পাঠকের উপর আমার অগাধ ভরসা।
সাইফ: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?
রুমা মোদক: এর উত্তরটা বোধহয় প্রথম প্রশ্নেই দিয়েছি৷ এই যে আমি পুরস্কার পেয়েছি, এখন যতই বলি চিঠি পাওয়ার আগে রকিবুল ইসলামকে চিনতামই না, অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। হা হা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অবিশ্বাস যে খুব অমূলক তাও তো নয়। অভিজ্ঞতাই তো এসব বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে যাই হোক এসব বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
সাইফ: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, করপোরেট পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সাহিত্যসংগঠনগুলো থেকে দেওয়ার পুরস্কারের মধ্যে আপনি স্পষ্ট কোনো পার্থক্য দেখেন? কোন পুরস্কারকে আপনার নিরপেক্ষ ও বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়?
রুমা মোদক: হায়! সব প্রশ্নের উত্তর দিলে তো শত্রু তৈরি হবে। লেখকের পাঠক তৈরি দরকার, শত্রু নয়।
সাইফ: আপনি তো কথাসাহিত্য ছাড়াও নাট্যচর্চা করছেন। কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
রুমা মোদক: আমি কথাসাহিত্যিক। এই পরিচয়টাই অর্জন করতে চাই। আগে পরে কিছু নেই। নাটকও আমি মনে করি সাহিত্যই। আমি থিয়েটার চর্চা শুরু করেছি বেশ পরে। নাটক লেখাও পরে। শুরুটা হয়েছে ছোট গল্প দিয়ে।
সাইফ: কথাসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
রুমা মোদক: পড়তে পড়তে। আমার পড়া শুরু শরৎচন্দ্র দিয়ে। পরে পড়েছি ঠাকুর মার ঝুলি, সুকুমার রায়। লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভেতরে দানা বেঁধেছে পথের পাঁচালী পড়ে, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে পড়ে।
সাইফ: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
রুমা মোদক: সাহিত্যচর্চা বেড়েছে, চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। দ্রুত নাম করতে ইচ্ছুক লেখকরা এতে জড়িয়ে পড়ছেন। এ নিয়ে আমাদের দেশে কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা নেই।কপিরাইট আইনটিতে বিশাল ফাঁক। লেখকদের মূলত অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হয়, জীবনাভিজ্ঞতা থাকতে হয়। মানুষের কাছে যেতে হয়। সর্বোপরি থাকতে হয় দায়বোধ। বর্তমান সাহিত্যচর্চা দেখলে বোধ হয় এসবের গুরুত্বই সবচেয়ে কম। বরং গোষ্ঠীবদ্ধতা, পিঠ চাপড়ানো, ব্যক্তিগত অবস্থান বা পদমর্যাদা ইত্যাদিই বেশি বিবেচ্য।
সাইফ: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
রুমা মোদক: সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী—নানাজনের দ্বারা নানাসময় প্রভাবিত হয়েছি। কিন্তু লিখতে গিয়ে নিজের স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করার ক্ষেত্রে সদা সতর্ক থেকেছি।
সাইফ: আপনার সমসাময়িক ও অনুজদের মধ্যে কার কার গল্প আপনাকে আকৃষ্ট করে কিংবা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
রুমা মোদক: অনুজ বা সমসাময়িক। এরকম প্রশ্ন অনেকেই এড়িয়ে যাবেন। আমি কয়েকজনের নাম বলবো, কিন্তু হয়তো কয়েকজন বাদও পড়বে। তবু যে নামগুলো মনে আসছে- দীপেন ভট্টাচার্য, সৈয়দ মনজুরুল হক, নাসরীন জাহান, কুলদা রায়, ইমতিয়ার শামীম, আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নী, আশান উজ জামান, সাদিয়া সুলতানা, স্মৃতি ভদ্র, সাদিক হোসেন, অনির্বান প্রমুখ।
সাইফ: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
রুমা মোদক: ওরে বাবা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। ক্ষমা করবেন। নিজের কাজটা যেনো করে যেতে পারি ধ্যানের সাথে, দায়বদ্ধতার সাথে, আপাতত এটুকুই ভাবছি।