খেয়াল কোনো দুর্বলতম শব্দ নয়। ‘খেয়াল’ যতটা কাব্যিক তার থেকে বহুগুণ দরকারি ও অর্থবহনকারি শব্দ। নানাভাবে জীবনে খেয়ালের দরকার হয়। আমরা তার কতটুকুই বা বুঝি ! যে পায় না স্যেই বোঝে-দরকার কতটা জরুরি জীবন চলতে। না পাওয়ার অভাবটা সেইই নিদারণভাবে বোঝে- যে পায় না। তাতে আবার ভাবনার কি হলো ? এই প্রশ্নও ভাবায়। ভাবনা আসে বলেই ভাবতে হয়। সেই বশেই খেয়াল শব্দ নিয়ে ভাবতে বসেছি।
তবে বলি। কারোর প্রতি খেয়াল রাখাকে কেউ যখন শেকল বা বন্ধন মনে করে তখন তাকে ছেড়ে দিতে হয়। মুক্ত করে দিতে হয়। মুক্তি কি এর নাম ? বোঝার বিষয় এটাও যে, শৃঙ্খলা আর শেকল তো এক না। তাহলে মুক্তি কেনো ? শৃঙ্খলায় থাকাকে বন্ধন ভাবলে তার সাথে শব্দ-যুদ্ধে রপ্ত হওয়া আহাম্মকের কাজ।
বরং স্বাধীনতা দিতে হয়, তার ক্ষতি হবে জেনেও। কারণ ভালোবাসা এবং দরদকে যদি নেতিবাচক হিসেবে অপরের কাছে পরিগণিত সে বহু কষ্টের। বোঝা দরকার দরদ হলো মায়া, ভালোবাসা এবং তাকে বন্ধন বা শৃঙ্খল মনে করা হলো মায়া ও দরদের অপমান। অন্য কেউ অপমান করলে হাসতে হাসতে হজম করার শক্তি আমার আছে। তাই বলে নিজেকে নিজে অপমান হতে দেইনা কখনো। যে কোনো মূল্যেই হোক নিজেকে রক্ষা করাই ধর্ম, বড় তপস্যা। তাতে যা ক্ষতি হলো, হোক।
ভেতরে বাহিরে রক্ত ঝরিয়ে এক সংসার-জীবন থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার সাহস হয়েছে সেদিন। যেদিন নিজেকে চরমভাবে অপমানিত হতে দেখেছি। তার আগে অবধি দশ বছরেও সেই জায়গা থেকে তো নয়ই সেখানকার মানুষগুলোকেও মাথায় করে রেখেছি। অটল একটা দায়িত্ববোধ থেকেই সকল অপমান নিজেই মাথা পেতে নিয়েছিলাম। তা অনেক কিছুর বিনিময়ে, অনেক কিছু খুইয়ে। অনেক বছর ধৈযে; এটাই আমার স্বভাব। মনে হয়, সবথেকে বাজে স্বাভাব, সবকিছুর শেষ পর্যন্ত দেখা। শেষ পর্যন্ত দেখা মানে লেগে থাকা। লেগে থাকতে থাকতেই জীবনটার অর্ধেকখানি বা তারও অধিক পিছিয়ে রেখেছি। যেখানে পৌছনোর কথা ছিলো- একশোভাগ, আমার যোগ্যতা এবং ক্ষমতা অনুযায়ী সে পর্যন্ত তো যাইইনি। বরং পিছিয়ি থেকেছি সবকিছু থেকে। নিজের যা পাবার কথা, হবার কথা, এমনকি যা আমার অধিকারভুক্ত সেখানেও বিশাল এক গর্ত বানিয়ে চলছি আজীবন। শূন্যতার গহ্বর। সেই শূন্যতাকে আবার জলাধার ভেবে নিয়ে সামনে চলার শক্তিও অর্জন করি চরমভাবে।
কিছু স্বভাবের জন্যে নিজেকেই নিজে গালি দিই প্রায়ই। কারণ এই শেষ পর্যন্ত দেখতে দেখতে জীবনের অনেক ক্ষতি হয়ে যায় যা কোনোকিছু দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। সময় কী পূরণ করা সম্ভব অন্য কিছুতে ! এই এক জীবন থেকে সময় যে দিয়েই চলেছি; দিয়েই চলেছি। আর কি কিছু রইলো বাকি !
ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম, আমি আব্বার মতো স্বভাব পেয়েছি। ওইরকমই ত্যাগ করেছি সারাজীবন, কিছুটা একরোখাও। প্রচণ্ড টালমাটাল পরিস্থিতিতেও আব্বাকে খুব স্থির থাকতে দেখেছি। কী রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী সাংসারিক অভাব অনটন বা পারিবারিক জটিলতা- সবের বেলাতেই।
প্রচণ্ড ঝোড়োবাতাসেও একফোটা টলতে দেখিনি আব্বাকে।
টলতে দেখিনি কিন্তু সোজা হয়ে সুয়ে থাকতে দেখেছি আব্বাকে অনেক সময়। আমি যখন কলেজে তখন খুব খেয়াল করতাম, আব্বা বেশিরভাব সময় লম্বা হয়ে সুয়ে আছে কিন্তু ঘুম নয়। বুঝতাম। ঘুমোনো মানুষকে আর না ঘুমোনো মানষকে বোঝা যায়। আমি বুঝি।
এও বুঝি ওই যে নিজেকে টলতে না দেওয়া মানুষটা যতসব কষ্ট, না পাওয়া, একাকিত্ব এসবের ভেতরে ক্রমেই নিজেকে সেধিয়ে দিচ্ছে। তবুও টলে যাবে না- এ এক যেনো স্থির ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কী মর্মান্তিক কী ভয়ংকর গর্তের ভিতরে একটা মানুষের পা থেকে শুরু করে পুরো শরীরটা ঢুকে পড়ছে ক্রমেই ! এবং জেনে বুঝেই সচেতনভাবেই ঘটতে দিচ্ছে এগুলো; সারাজীবন। অথচ টলে যাবার ইচ্ছে নেই ! আবার কিচ্ছু পাবারও নেই। না পাওয়াগুলো নিয়ে কী নিদারণভাবে ত্যাগের চুড়ান্ত এক মহিমায় নিজের প্রতি অন্যায় করা !
নিজের প্রতি প্রতিনিয়ত অন্যায় করে যাওয়া মানুষটার উপরে প্রচণ্ড রাগ হয় আমার। প্রচণ্ড ক্ষোভ হয়। ক্ষোভ রাগ জমা হতে হতে বিরাট একটা পাথর উপরন্ত আমার উপরেই ভর করে পুনরায়। আমি তাহলে যাবো কোথায় ! আর কতটা ভাঙনের ভেতরে পা দিয়ে এভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, আব্বা !
এখন যেমন নিজের বেলায় বুঝি। বুঝি, আব্বার বেলাতেও ঠিক এমনটাই হতো। স্বাধীনতা পছন্দ করা মানুষদের নিজের জন্যে কিচ্ছু থাকে না, কেউ থাকে না। শুধুমাত্র নিজের মনের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকলে সঙ্গী হিসেবে কেউই থাকে না। সবার প্রয়োজনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার উপলব্ধি কে বুঝবে ! আর কেউ না বুঝলে নিজেকে নিজেই বুঝতে হয়। সেইটুকু না হলে বেঁচে থাকার পথ কোথায় !