সন্ধ্যার পর, বাতিঘর থেকে বেরিয়ে আমরা বাংলামটর মোড়ে এসে দাঁড়াই। আমি আর এহসান মাহমুদ। এহসান সাংবাদিক। কবি, ঔপন্যাসিক এবং তরুণ বুদ্ধিজীবীও। বাংলামটর মোড়ে গাড়ির ত্রিমুখী ছুটে যাওয়া দেখছি। এহসান বাসায় ফিরবে। কোনো খালি সিএনজি দেখলেই সে চঞ্চল চোখে তাকিয়ে দু’কদম হেঁটে যায়, আবার ফিরে আসে। সেই সময় আচমকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কথাটা বলল, ‘আপনি তো এখন আন্তর্জাতিক লেখক।’
এ কথার কী মানে, কেন এহসান কথাটা বলল; উত্তর না দিয়ে একবার আড়চোখে তাকাই।
আমার প্রতিক্রিয়াহীন নীরবতা খেয়াল করে এহসান বিভ্রান্ত হয়ে চশমার উপর দিয়ে তাকালো। সে যে-কোনো বিষয়কে টান মেরে রাজনৈতিক হাওয়া মিশিয়ে দেয়। আমি কোনো ভাবান্তর দেখালাম না।
এর মধ্যে গল্পকার ও সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ ফাহাদ এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। এহসান তাড়া দেখায়। বাসায় যাবে। সিএনজি না পেয়ে একটা তিন নম্বর লোকাল বাস দেখে সে দৌড়ে উঠে যায়।
আমি আর ফাহাদ। ফাহাদ যাবে গুলশানে, কালাচাঁদপুর। আমার গন্তব্য মগবাজার। ফাহাদের হাতে সদ্য প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকার নতুন সংখ্যা। বলল, বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়েই আপনার উপন্যাসটা পড়ব।
আমি মৃদু হেসে রাস্তা পেরিয়ে মোড়ের পূর্বদিকে চলে আসি।
ফাহাদ বলল, চলেন, হেঁটে যাই মগবাজার পর্যন্ত।
হাঁটতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু অনেক প্রতীক্ষার পর, ‘দেশ’ পত্রিকা হাতে পেয়েছি। বুকের ভেতর আনন্তের বুদ্বুদ। মন উচাটন। দ্রুত বাসায় ফিরতে চাইছিলাম। হলো না।
ফাহাদের অনুরোধে হাঁটতে আরম্ভ করি।
কথা। আরও কথা। একটি কথা শেষ হয়। অন্য একটি কথা এসে মুখ বাড়ায়। কথায় কথায় একসময় আমরা মগবাজার মোড়ে এসে পড়ি।
ফাহাদ বলল, ভাই, চলি। দেখা হবে।
প্যান্টের পকেটে কি একবার ভ্রাইব্রেট হলো? কী ভেবে মুঠোফোন বের করে দেখি, দুটো মিসকল। একটি ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের, অন্যটি এক বন্ধুর।
ফাহাদকে ফোনটা দেখিয়ে বলি, চলি। সাবধানে যান। দেখা হবে।
ইমদাদুল হক মিলন বাংলাদেশের খুবই পরিচিত ও পপুলার লেখক। দীর্ঘদিন দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক তাঁর সঙ্গে খুব বেশি কথা হয় না, দেখাও নয়। আমি কালের কণ্ঠে যখন কাজ করতাম, তখনও যে খুব কথা হতো, এমন নয়। তবে গত এক সপ্তাহে মিলন ভাই দুদিন ফোন করেছেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার উপন্যাসের বিজ্ঞাপন দেখে একদিন; অন্যদিন ‘দেশ’ বাংলাদেশে এসেছে কিনা, জানার জন্য।
মগবাজার মোড়ে বিচিত্র গাড়ির শব্দ। কোলাহল। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাসার গলিতে ঢুকে মিলন ভাইকে ফোন করি।
মিলন ভাই, আমি হাঁটছিলাম তো, আপনার ফোন টের পাইনি। সরি।
ফোনের ওপারে তাঁর হাসিমুখ টের পাই। বললেন, না না, কোনো অসুবিধা নেই। দেশ-এ আমি তোমার ‘কাঞ্চনফুলের কবি’ উপন্যাসের প্রথম পর্বটা পড়ে শেষ করলাম।
আমি অবাক; ‘দেশ’ পত্রিকা হাতে পেয়ে গেছেন?
হ্যাঁ। খুব ভালো শুরু করেছ, ভাই। খুব ভালো। উপন্যাসের ভাষাটা একদম জীবনানন্দের উপযোগী। আর খুব সুন্দর।
আপনার ভালো লেগেছে, জেনে আমারও ভালো লাগছে।
নিশ্চয়ই। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, তোমার উপন্যাসটার জন্য। কারণ এর আগে জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা তোমার গল্পগুলো আমি পড়েছি। পড়ে একটা জিনিস আমি বুঝেছি, তুমি দীর্ঘদিন এই মানুষটাকে নিয়ে গবেষণা করেছ। এই উপন্যাসে তার প্রমাণটা আছে। একাধারে তুমি জীবনানন্দের জীবনের কথা বলে যাচ্ছ, কিন্তু তোমার লেখার আঙ্গিকটা হচ্ছে উপন্যাসের। দ্যাটস ভেরি গুড। তোমার টেকনিকটাই আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
থ্যাংক ইউ মিলন ভাই। আমি খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
তুমি আমাদের মুখটা উজ্জ্বলও করেছ। ‘দেশ’ পত্রিকায় তোমার উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, এটা আমাদের বাংলাদেশের জন্যও অনেক বড় ঘটনা, মাসউদ।
থ্যাংক ইউ।
এই যে ব্যাপারটা, তোমার উপন্যাসটা কে কীভাবে দেখছে, আমি জানি না। তবে আমি আমার জায়গা থেকে টু বি অনেস্ট, তুমি ব্যাটা অনেক বড় কাজ করেছ। গুড। তোমাকে আমার শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।
থ্যাংক ইউ, মিলন ভাই।
আর একটা কথা।
জি, বলুন, প্লিজ।
আমার উপর তোমার কোনো রাগ-অভিমান থাকলে মুছে ফেলো ভাই।
না না, তা কেন। ঠিক আছে। আপনাকে কি ভোলা যায়, মিলন ভাই।
থ্যাংক ইউ, মাসউদ। একদিন সময় করে এসো, কেমন। আমরা আড্ডা দেব।
আচ্ছা।
থ্যাংক ইউ। ভালো থেকো।
.
মগবাজার, ঢাকা।
২৪.১.২০২২
[লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের]