সপ্তম পর্ব
দারুণ একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে আশালতার। স্বপ্নটা দেখে সে ভোরের দিকে। ঘুম ভাঙার পর পরই তার কানে ভেসে আসে মোরগের ডাক। ভোর হয়ে গেছে সেটা সে বুঝতে পারে। তারপরও সে বিছানা থেকে ওঠে না। স্বপ্নটা নিয়ে ভাবে। নজরুলের কোলে মাথা রেখে সে শুয়ে আছে। নজরুল তার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছেন। পরম তৃপ্তি অনুভব করছে সে। তৃপ্তি অনুভব করতে করতেই তার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর থেকে নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য তার মনটা উতালা হয়ে ওঠে। কখন নজরুলের কাছে যাবে তা নিয়ে ভাবে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। তার মন পড়ে আছে নজরুলের কাছে। তার সঙ্গে দেখা করার অজুহাত খুঁজছে সে। কিন্তু তার মা কিংবা কাকীমা কেউ না বললে সে যেতে পারছে না। যাওয়াটা শোভন দেখায় না। তাছাড়া কেউ যদি বলে, তোর কোনো কাজকর্ম নেই নাকি! তুই নজরুলের কাছে বার বার কেন যাস? তখন সে কি জবাব দেবে? এসব চিন্তাও তার মাথায় আসে। সে মনে মনে ভাবে, কাকীমার কাছে গেলে নিশ্চয়ই তিনি কোনো কাজের কথা বলবেন। তখন আর কারো কিছু বলার সুযোগ থাকবে না।
আশালতা তার কাকীমার কাছে যায়। তার আশপাশে ঘুরঘুর করে। অপেক্ষা করে, কখন তিনি বলবেন, যা নজরুলের কাছে গিয়ে দেখ, ওর কী লাগবে, না লাগবে।
বিরজা দেবী তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি দুপুরে কী রান্না হবে; রাতের জন্য কী হবে এসব নিয়ে ঝি-চাকরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। আশালতাকে দেখেও যেন তিনি না দেখার ভান করছেন। তিনি কাজের লোকদের নানা রকম নির্দেশনা দিচ্ছেন। নির্দেশনা দেয়া শেষ হওয়ার পর আশালতার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কি রে দুলি; কিছু বলবি?
আশালতা আমতা আমতা করে বলল, না মানে কোনো কাজ করতে হবে কি না তাই খোঁজ নিতে এলাম।
বিরজা দেবী কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তুই দেখ তো দুলি নজরুলের কিছু লাগবে কি না।
বিরজা দেবীর কাছ থেকে এই কথাটাই আশালতা শুনতে চাচ্ছিল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে আশালতার চেহারা অন্যরকম হয়ে গেলো। সে আর দেরি করল না। দৌড়ে নজরুলের ঘরের দিকে ছুটে গেলো। গিয়ে সে দেখলো, নজরুল গভীর মনোযোগে লেখালেখি করছেন। আশালতা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল নজরুলের দিকে। নজরুলের কথা বলার ধরন, তার হাসি, তার হাঁটাচলা সবকিছুই তাকে বিমুগ্ধ করছে। তার কবিতা, গান তাকে খুব করে টানছে। সেদিন নজরুল তাকে যে কবিতাটা উপহার দিয়েছে সেটি আশালতাকে আরো বেশি আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। কবিতাটি তার মনে বারবার দোলা দেয়। সে নিজের অজান্তেই কবিতাটি মুখে আওড়ায়।
‘হে মোর রানী!
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয় কেতন লুটায়
তোমার চরণ-তলে এসে।’
আশালতা মনে মনে ভাবে, এ কবিতা যে তাকে নিয়েই লেখা। সে জানে, নজরুল তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে। নজরুলকেও সে অসম্ভব ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার পরিণতি কী তা নিয়ে সে ভাবে না। ভাবতে চায় না।
হঠাৎ নজরুলের চোখ পড়ে আশালতার দিকে। নজরুল তাকে উদ্দেশ করে বললেন, কি ব্যাপার! তুমি একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছো যে!
আশালতা বলল, আপনাকে দেখছি।
নতুন করে কি দেখছ?
প্রতিদিনই মনে হয় একজন নতুন মানুষকে দেখছি।
নজরুল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকায় আশালতার দিকেন। তিনি আবেগাপ্লুত কণ্ঠে আশালতাকে ডাকেন, প্রমীলা আমার কাছে এসো।
আপনার এখন লেখার সময়। এ সময় এখানে থাকা কি ঠিক হবে?
ঠিক হবে কি না সেটা আমি বুঝব। তুমি এসো তো!
আশালতা এটাই চেয়েছিল। নজরুল বলুক। তাহলেই সে থাকবে। তা না হলে সে তার সময় নষ্ট করবে না। সে একপা দুইপা করে নজরুলের কাছে এগিয়ে গেলো। নজরুলের মুখোমুখি দাঁড়াল। নজরুল বললেন, বসো না!
আশালতা বসলো না। সে কখনো নজরুলের দিকে তাকায়। আবার কখনো মাথা নীচ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নজরুল তাকে উদ্দেশ করে বলে, শোন প্রমীলা; তুমি কাছে থাকলে আমার লেখা আরো ভালো হয়।
আশালতা হাসি হাসি মুখ করে বলল, কী যে বলেন!
সত্যি বলছি প্রমীলা। তুমি আমার অনুপ্রেরণা।
কথাটা শুনে ভীষণ একটা ভালোলাগা কাজ করে আশালতার। মনের ভেতরটা নাচন দিয়ে ওঠে। কিন্তু সে তার এই আনন্দ প্রকাশ করতে পারে না। লজ্জায় তার চেহারা লাল হয়ে যায়। সে কী বলবে তা ভেবে না পেয়ে বলে, আপনাকে চা দিই?
না। চা দিতে হবে না। তুমি আমার কাছে থাকলেই আমি খুশি।
অন্য কিছু খাবেন?
বললাম তো! আমার কিছু লাগবে না। তুমি এখানে বসে থাকো।
বারে! শুধু শুধু কেউ বসে থাকে?
নজরুল বললেন, তুমি সত্যি করে বলো তো প্রমীলা; এখানে থাকতে তোমার ভালো লাগে না?
আশালতা ইতিবাচক মাথা নাড়ে।
তাহলে যেতে চাচ্ছো কেন?
আশালতা কোনো কথা বলে না। সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নজরুল আবারও তাকে উদ্দেশ করে বলল, প্রমীলা তুমি বসো।
আশালতা খাটের এক কিনারে বসলো। নজরুল টেবিলে লেখার খাতা গুটিয়ে রেখে গান ধরল।
‘আসে বসন্ত ফুলবনে
সাজে বনভ‚মি সুন্দরী।
চরণে পায়েলা রুমঝুম
মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি।’
(চলবে)